ইস্তাম্বুলের ঈদলিপি
তুরস্কে চলছে বসন্তকাল। ইদানিং রাত হলে জানালার খিড়কি খুলে ভোর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি জানালার পাশে। রাতভর নাকের কাছে বসন্তের ওলাওঠা বাতাস এসে নাসিকা টানতে থাকে। ভোর হলে বসন্তের বাতাসে ফুলগুলো উপচে পরে আমায় ভৎসনা দিয়ে বলে ওঠে ‘ঈদ মোবারক’।
তুরস্কে হয়ে গেছে ঈদ। ঈদ উপলক্ষে টানা তিন দিন সব ট্রান্সপোর্ট—ট্রাম, বাস, মেট্রো ট্রেন বিনামূল্যে বিনা মাসুলে, বেগার হিসাবে অবাধ যাতায়াতের সুব্যবস্থা ছিল।
ঈদ নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস দীর্ঘ ও প্রাচীনতম। মাসখানেক আগে থেকেই ‘ঈদ পরিকল্পনালিপি’ টানিয়ে রেখেছি দেয়ালের দিকে। দেশ থেকে পাজামা-পাঞ্জাবিও আনিয়েছি বটে, অথচ ঈদখানা কাছাকাছি আসতেই যত মন খারাপি এসে চেপে বসে আছে কাঁধে। আর আমার এসব মন খারাপি দেখে বসন্তেরা আমায় ভর্ৎসনা দিয়ে ‘ঈদ মোবারক’ বলছে।
ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল সেরে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলেছি সমস্ত অপবাদ, ভর্ৎসনা ও মন খারাপি। তুর্কী আতরের ঘ্রাণ কিছুটা তীব্র। তবে- অসম্ভব সুবাসিত ও সারগন্ধ, সঙ্গে ঐতিহ্যের বাস। যেন ইস্তাম্বুলের দার্জিলিং শহরের অত্যাধিক সৌন্দর্যকেও হার মানায় এর সুবাস।
ঈদ উপলক্ষে এ সমস্ত আতর সুরমা গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়েছি প্রাচীন তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ‘আয়া সোফিয়া মসজিদে’ ঈদ নামাজে অংশ নেয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষ। ঈদের ছুটিতে জার্মান ফ্রান্স ও ইউরোপে বসবাসরত মুসলিমেরা কাছাকাছি দেশ তুরস্ককেই বেছে নেয় ঈদ উব্যাপনের শ্রেষ্ঠ ঠিকানা হিসাবে। শুরুতে আমি তাদের ঐতিহাসিক সমগামে অংশ নেওয়ার দুঃসাহসিকতা দেখালেও পরক্ষণেই পিছু হটেছি।
ডরমিটরির বাগানে ঈদের নামাজ সেরে তুর্কি ট্রেডিশনাল ঈদ উদ্যাপন করেছি ছাত্রাবাসেই। ঈদ সালামির বেজাকে ভরপুর আয়োজন করেছে গভর্মেন্টের ছাত্রাবাস কমিটি। আমি এসব আয়োজনের অংশ হিসেবে বিপুল পরিমাণ আনন্দ উপহার দিয়েছি বটে, সে সঙ্গে হাতিয়েও নিয়েছি বিপুল ‘ঈদ সালামি’।
যাক, সে কথা থাক, ট্র্যাডিশনাল তুর্কী ঈদ শেষে বেরিয়ে পড়েছি ট্র্যাডিশনাল বাঙালি ঈদের খোঁজে।
ইস্তাম্বুলের একদম মধ্যিখানে অবস্থিত ফাতিহ মহল্লার ‘এশিয়া লাউঞ্জে’ প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় তুর্কীপ্রবাসী বাঙালিদের ঈদ। এশিয়া লাউঞ্জ রেস্টুরেন্টটির কিছুটা কাছাকাছি যেতেই কানের কাছে বেজে উঠেছে—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’।
ইস্তাম্বুল শহরে এই শব্দ আমার কাছে সত্যিই মধুর মতো ছিল। সারাটা বছর বলকান আর তুর্কীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা আমার কাছে বাংলা শব্দ মধুর চেয়ে কম কি আর? আমি সেদিন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি ইস্তাম্বুলপ্রবাসী বাঙালিদের ঈদ উৎসব। বিদেশে বসবাসরত কোনো বাঙালির কর্ণকুহরে এসব বাংলা গানের কবিতা পৌঁছে গেলে হৃদয়ের গহিনে ফুটে ওঠে বৈশাখ, আষাঢ়, শ্রাবণ, বসন্ত।
আজকাল লক্ষ করলাম, কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঈদ নিয়ে দীর্ঘ কবিতাটি বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনের জাতীয় সংগীতে রূপ নিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি প্রবেশ করেছি বাঙালিদের আয়োজিত ‘বাসাত ঈদ পুনর্মিলনী মিলমেলা’য়। অংশ নিয়েছি ট্রেডিশনাল বাঙালি ঈদ কোলাকুলি, সেমাই, চিনি পর্বে। পরক্ষণে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন বাংলাদেশেই আছি। যেন ঈদ উদ্যাপন করছি ঢাকার কোনো শাহী মহল্লায়।
আজকাল পড়াশোনার চাপে বা সময়ের অভাবে এসব বাঙালিদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার সুযোগ হয় না। তবুও ঈদের দিনে সালামির মতো সংস্কৃতি মিস হয়নি তুরস্কে বসেও। ‘বাসাত ঈদ পুনর্মিলনী’ আয়োজনের পরিচালক ওমর ফারুক হেলালি সাহেব কাছে ডেকে ধরিয়ে দিলেন ‘ঈদ সালামি’।
ঈদের দিন দাওয়াত গ্রহণ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ঈদের দিন মধ্যাহ্নভোজে ইস্তাম্বুলের এক বাঙালি পরিবারের ঈদ দাওয়াতে অংশ নিলাম তুরস্কের ন্যাশনাল ছাত্র ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক বিভাগের সভাপতি মোহাম্মদ তানভীর সাহেবের সঙ্গে।
সেখানে আয়োজনে ছিলো বাঙালি ট্রেডিশনাল খাবার; ডাল, ভাত, বেগুন ভাজা, গরুর মাংস, সালাদ, খেজুর গুড়ের পায়েস, সেমাই ও মাঠা। দেশে এসব ঈদ খাদ্য অহরহ হলেও বিদেশে বসবাসরত বাঙালিদের কাছে মধুর পাত্র।
বিদেশে বসবাসরত বাঙ্গালিদের এসব উৎসবমুখর ঈদ উদ্যাপন দেখলে মাঝেমধ্যে মনে হয় বাঙালি মুসলমান পৃথিবীর বুকে বসন্তের মতো ফুটে আছে। পৃথিবীর গাছগুলো যেমন সাড়া বছর বসন্তের অপেক্ষা করে আর বসন্ত এলে তিরতির করে ফুটে ওঠে পৃথিবীর বুকে। ঠিক তেমনই বাঙালি মুসলমান যেনো সারাটা বছর অপেক্ষা করে ঈদের জন্য। ঈদ এলে তিরতির করে ফুটে ওঠে দেশ কিংবা প্রবাসের বুকে।
এদিকে তুরস্কে যেহেতু চলছে বসন্তকাল। এখানে বসবাসরতদের জন্য একই সঙ্গে ঈদ আবার বসন্ত। বাংলায় যেমন বৈশাখী ঈদ। তুরস্কে তেমন বাসন্তী ঈদ।
*লেখক: মাহামুদুল হাসান সুনান খান, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক শহীদ মনুর আলকান ইমাম হাতিব লিসেসি, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক,
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস dp@prothomalo.com