সিডনিতে গাড়িবন্দী অবস্থায় শিশুর মৃত্যু এবং একটি মর্মান্তিক ভুল
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ২ ফেব্রুয়ারি সকালের দিকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক শিশুকে গাড়িতে রেখেই বাড়ির ভেতর কর্মব্যস্ত হয়ে যান বাবা। আর এভাবেই বাড়ির বাইরে দাঁড় করা গাড়িতে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে থেকে মারা যায় শিশুটি। চরম দুর্ভাগ্য আর মর্মান্তিক এ ঘটনার খবরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে, কেমন করে হয় এ ভুল?
কয়েক দিন ধরে এ প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছে এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে। বিশ্লেষণ, তর্ক-বিতর্ক, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ছেয়ে গেছে সংবাদ-সামাজিক-গণমাধ্যমসহ আড্ডা, আলোচনা, অনুষ্ঠান থেকে প্রাত্যহিক জীবনের কথোপথনে। শুধু যে এ আলোচনা বাংলাদেশিদের মধ্যে তা নয়, গাড়িবন্দী অবস্থায় প্রচণ্ড গরমে তিন বছর বয়সী এই প্রবাসী বাংলাদেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় অস্ট্রেলিয়াজুড়ে তোলপাড় হয়েছে এবং এখনো রয়েছে এর জের। চুলচেরা বিশ্লেষণ এ ভুল, এ অবহেলার, কী হবে বিচার-আচারসহ আরও অনেক কিছু। অস্ট্রেলিয়ায় বিষয়টি মর্মান্তিকের সঙ্গে স্পর্শকাতরও। কারণ, এ রকম জীবন প্রায় সবারই। প্রায় সবাই শিশু লালন-পালন থেকে কাজ, কাজ থেকে ঘর আবার কাজ এ রকম একটি জীবন-সময়ের মধ্য দিয়েই যান। এ জন্য গাড়িবন্দী অবস্থায় শিশুর মৃত্যুটি স্পর্শ করেছে এখানকার সবাইকে।
দুর্ঘটনার দিন সকালে বড় সন্তান আরাবকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন নেওয়াজ হাসান। কিন্তু গাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল ছোট সন্তান আরিক। বেলা তিনটায় নেওয়াজ বড় সন্তানকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরার সময় গাড়ির পেছনের আসনে অচেতন অবস্থায় আরিককে দেখতে পান। ছেলের এ অবস্থা দেখতে পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়াসহ জরুরি সেবায় কল করেন। কিন্তু প্যারামেডিক এসে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে। সেদিন সিডনির তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরিকের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাখা হয়েছিল। গত পরশু বৃহস্পতিবার দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং গত শুক্রবার বাদ জুমা জানাজার পর শত শত মানুষের আহাজারির মধ্য দিয়ে চিরশায়িত হয়েছে ছোট্ট আরিক সিডনির কেম্পস ক্রিক কবরস্থানে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে তবে এখন পর্যন্ত কারও ওপর কোনো অভিযোগ তোলেনি।
আরিকের দাফনের আগেই একদিন পরিবারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি অনেকক্ষণ। ‘শোকে পাথর’ কথাটির চাক্ষুষ উদাহরণ বনে গেছেন আরিকের মা মারজিয়া শাহানা। দেখায় ভাবলেশহীন মনে হলেও ভাষায় জানান দিয়েছেন তাঁর অপূরণীয় ক্ষতির কথা। শোকার্ত ভাঙা কণ্ঠে অন্যমনস্ক হয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমি কদিন আগেই একটি জামা কিনেছি। আমার ছোট্ট আরিক জামাটি দেখে ভাঙা ভাঙা কথা বলেছিল, এটাতে তোমাকে দেখতে রানির মতো লাগবে মা। জামাটা তোলা আছে। আমি আমার আরিককে যখন আবার কোলে নেব, জড়িয়ে ধরব কিন্তু কাঁদব না, মরদেহের ওপর চোখের পানি ফেলতে নেই, আমি প্রমিজ করছি আমি কাঁদব না। ভাবছি আরিককে দেখতে সেই জামাটা পরে যাব নাকি পরব না।’ আরিকের বাড়িতে তখন মৃতের বাড়ির চাইতেও বেশি মনে হয়েছে ধ্বংসস্তূপ। শিশুটির আকস্মিক এ চলে যাওয়ায় তার পরিবারের সুখ-আহ্লাদ-স্বপ্নভঙ্গের স্তূপ জমেছে বাড়ির প্রতিটা কোনায়। ঘরের বায়ুকণা সটকে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে বাবা–মায়ের আহাজারিকে।
আরিকের বড় খালা আয়েশা সিদ্দিকা বললেন, ‘আরিক খুবই চুপচাপ একটা বাচ্চা ছিল আমাদের, পাশে বসে খেলা করলেও বোঝা যেত না। কাছাকাছি বাসা আমাদের, আমি কতবার গিয়েছি আরিককে ডে-কেয়ার থেকে নিয়ে আসতে, ওকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো ছিল খুব সহজ। খুব অল্পে সন্তুষ্ট একটা বাচ্চা ছিল। আমরা আর কি কাঁদব আমাদের চোখের পানি হয়তো শেষ কিন্তু কষ্ট চাপা দিয়ে আরিকের মা–বাবাকে এখন সামলানোর চেষ্টা করছি। কেবল সন্তান হারানোর বেদনা যে কতটা নির্মম, তা হয়তো কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। তবে প্রবাসজীবনের চাপ আর কর্মব্যস্ততা যে কতটা গুরুতর, তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল আমাদের আরিক। এ দেশে সবারই গাড়ি আছে, কাজ আছে। কর্মঘণ্টায় সবাই মিনিটের হিসাবে চলে বলব না, বলব দৌড়ায়। এখানে বাচ্চাকে দৌড়ে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়, আবার এক মিনিটের মধ্যে কাজে ঢুকতে হয়। এত এত চাপের মধ্যে কত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, মা–বাবার কাছে জীবনের সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে বড় যেটা সেটা-ই হারিয়ে গেল।’
ব্যাংক বিশ্লেষণ পেশার সঙ্গে জড়িত আরিকের বাবা নেওয়াজ হাসান বাসায় বসেই অফিস করেন। আরিককে ডে-কেয়ারে নামিয়ে দেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। আর আরিক ঘুমিয়ে থাকায় তার গাড়িতেই থাকার ব্যাপারটি নজরে পড়েনি নেওয়াজ হাসানের। আর গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকেই কাজে লেগে পড়েন তিনি। আরিকের বাবা একদমই ভেঙে পড়েছেন শোকে। নিজের ভুলকে কোনোভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারছেন না তিনি। কাজের চাপে আরিকের কথা ভুলে যাওয়ার দাবি তাঁর। আগের রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি আরিকের, এ কারণে সকালে গাড়িতে উঠেই পেছনের সিটে বসে ঘুমিয়ে যায় আরিক। তার বাবা নেওয়াজ বলেন, ‘সাধারণত আমি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ছেলের সঙ্গে অনেক কথা বলি, আরিকও এটা–ওটা প্রশ্ন করে। তবে সেদিন ও ঘুমিয়ে থাকার কারণে গাড়ি একদম নীরব ছিল।
আমার ধারণা হয়, সেই নীরবতা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল আরিকের কথা। তবে আমি এখনো মনে করতে পারি না কেন এমনটা হলো, আমার মাথায় কিছুই আসে না, আমি অন্যমনস্কও ছিলাম না, কিচ্ছু না, আমি শুধু ভুলে গিয়েছিলাম। এমন দুর্ভাগ্য যেন আর কারও না হয়, সে জন্য আমি বলব, সব সময় শত ভাগ নয়, ১২০ ভাগ খেয়াল রাখুন আপনার সন্তান কোথায় আছে, কেমন আছে।’ আরিকের চলে যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনের এক চরম সত্যের সাক্ষী হয়ে রইল, কর্মব্যস্ততার মানসিক চাপ। অস্ট্রেলিয়ার ছাপা পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শুরু করে দেশটির গণমাধ্যমে ঢালাও করে আরিকের ঘটনা প্রকাশ করা হয়েছে। এর একটাই প্রধান কারণ, পিতা–মাতাকে আরও সতর্ক করা। প্রবাসে সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত। ঘর মোছা, কাপড় কাচা, গাড়ি ধোয়া, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছুই নিজেদের করতে হয়। বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী। বাংলাদেশে গাড়িতে করে বাচ্চাকে নিয়ে নিয়মিত বাজারে যাওয়া, স্কুলে যাওয়া খুব পরিচিত চিত্র না হলেও প্রবাসে সেটি একদমই নিত্য ঘটনা। আর এত দৌড়ঝাঁপের মধ্যে প্রায়ই বাচ্চাকে গাড়িতে রেখে ভুলে যান মা–বাবা। এটি অভিভাবকের খামখেয়ালি নয়, প্রবাসের নিষ্ঠুর কর্মব্যস্ত জীবন। পৃথিবীতে কোনো বাবাই শিশুসন্তানের প্রতি বেখেয়ালি নন, এটা মর্মান্তিক একটা ভুল কিন্তু এই ভুলটুকুই যেন না হয়। কারণ, জীবনের সব অর্জন শেষ পর্যন্ত সন্তানে এসেই ঠেকে।
লেখক: কাউসার খান, অভিবাসন আইনজীবী ও সাংবাদিক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। [email protected]