স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার
ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক!
পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। আগামীকাল বাড়াদি পশ্চিমপাড়া ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। আপনাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়নামাজসহ ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
ঈদের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে আমাদের এলাকায় মাইকিং শুরু হয়ে যেত। তারও আগে আমরা আমাদের পাড়ার তেমাথায় জড়ো হয়ে সবাই মিলে চাঁদ দেখতাম। কে সবার আগে চাঁদ দেখতে পারে, সেটা নিয়ে ছোটদের মধ্যে চলত নীরব প্রতিযোগিতা। কেউ একজন দেখতে পেলেই বাকিদের দেখিয়ে দিত।
আর কোনো কারণে চাঁদ না দেখা গেলে পাড়ার একমাত্র টিভিই ছিল আমাদের ভরসা। সন্ধ্যা থেকেই আমরা সালামদের বাসায় ভিড় করতে শুরু করতাম। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঘোষণা করা হতো।
এরপরই বাজানো করা হতো কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর গান—
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।।’
এরপর সবাই মেহেদির পাতা সংগ্রহে লেগে যেত। পাড়ার বিভিন্ন মেহেদির গাছ থেকে পাতা তুলে এনে সেটা শিল–পাটায় মিহি করে বেটে সবার হাতে দেওয়া হতো। হাতের প্রতিটি আঙুলের নখ মেহেদিপাতার প্রলেপে ঢেকে যেত। আর হাতের তালুর মধ্যে দেওয়া হতো একটা বড় গোলাকার ফোটা। এরপর আমরা সযত্নে সেই হাত নড়াচড়া করাতাম, যেন কোনোভাবেই হাত থেকে মেহেদিপাতার প্রলেপ ঝরে না যায়। এরপর সেটা শুকিয়ে গেলে তুলে ফেলা হতো। তারপর হাত ধুয়ে সর্ষের তেল দেওয়া হতো। সর্ষের তেল দিলে রংটা দারুণ ফুটে ওঠে। কার হাতের মেহেদির রং কত গাঢ় হলো, সেটা সবাই সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতাম।
আমরা প্রচণ্ড রকমের উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। ঘুমের মধ্যে ঈদের নামাজ পড়া নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখতাম আমরা। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কলপাড়ে দৌড়। কলে চাপ দিয়ে টিনের বালতি ভরা হতো। এরপর নতুন সাবান দিয়ে একে একে সবাই গোসল করতাম। অনেকেই পুকুর থেকে গোসল করে আসত। মা একেবারে সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। আব্বা আমাদের গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিতেন। এরপর চোখে সুরমার প্রলেপ।
হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোট বোতলে থাকত আতর। সেই আতর এক টুকরা ছোট তুলায় ভিজিয়ে সেটা দিয়ে বুকে–পিঠে মেখে নিতাম। তারপর সেটা ডান কানের ওপরের দিকের ভাঁজে গুজে রাখা হতো। আমরা খুব সজাগ থাকতাম, যেন সেটা কান থেকে পড়ে না যায়। ঈদগাহে রওনা দেওয়ার মুহূর্তে মা আমাদের এক টাকা বা দুই টাকা দিয়ে দিতেন মজা কিনে খাওয়ার জন্য। দোকানের সস্তা খাবারগুলোকে আমরা এককথায় বলতাম মজা। এ রকম নামকরণের কারণ হয়তোবা এগুলো আমাদের আনন্দ দিত, সেই জন্য।
তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মা সবাইকে প্লেটে সেমাই খেতে দিতেন। আমরা ছোটরা তাড়াহুড়া করে সামান্য সেমাই মুখে দিয়েই ঈদগাহের উদ্দেশে ছুট দিতাম। আব্বার হাতে থাকত বড় শীতলপাটি। রাস্তায় যেতে যেতে পাড়ার সব বন্ধুরা একসঙ্গে হয়ে যেতাম।
তারপর ঈদগাহের উদ্দেশে যাত্রা করতাম। যতই ঈদগাহের কাছাকাছি যেতাম, ততই ঈদগাহের মাইকে হুজুরের ঘোষণা স্পষ্ট শুনতে পেতাম। ঈদগাহে ঢোকার রাস্তার দুই পাশে আমাদের পাড়ার পাল এবং বৈরাগী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন খাবারের দোকান দিতেন। আমরা ঈদের নামাজ আদায় করে প্রথমেই নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি সেরে নিতাম। তারপর ঈদগাহ থেকে বেরিয়েই বাইরের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে কিনে নিতাম আট আনা বা এক টাকা মূল্যের পাঁপড় ভাজা। সেটা খেতে খেতেই ফিরে আসতাম।
বাসায় ফিরেই আমরা মেতে উঠতাম বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলায়। খেলাধুলার পাশাপাশি এর–ওর বাড়ি যেয়ে খেয়ে আসতাম। আর বিকেলবেলা আমরা সবাই শিরনি নিয়ে হাজির হতাম সমাজে। শিরনি বলতে ছিল খিচুড়ি। প্রতি পাড়াতেই একাধিক সমাজ থাকত।
আমাদের পাড়ায় দুটো সমাজ ছিল। একটা ছিল আমাদের পাড়ার মাতুব্বর মন্টু চাচাদের বাড়িতে, আরেকটা ছিল বাগাড়িদের বাড়িতে। বাগাড়িরা যেহেতু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতেন, তাই আমরা যেতাম ওনাদের সমাজে। সব বাড়ির শিরনি এসে গেলে সেগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া হতো। এরপর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বৃত্তাকারে গোল করে বসিয়ে শিরনি বিলি করা হতো। ঈদের দিন রাতে টিভিতে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ দেখার মধ্যে দিয়ে শেষ হতো আনন্দমুখর ঈদের দিনটি।
প্রবাসের ঈদের আনন্দ একটু আলাদা ধরনের। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলাম, কারণ ছেলেমেয়েকে নিয়ে চাঁদ দেখতে যাব। ইফতার শেষ করেই বাসার পাশের ভিক্টোরিয়া পার্কে চলে গেলাম, যেখান থেকে পশ্চিম আকাশটা পুরোপুরি দেখা যায়। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমরা চাঁদ মামার দেখা পেলাম না। অবশেষে অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপের খুদে বার্তা থেকে জানলাম, শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে, আগামীকাল ঈদ। এরপরই বাসার টিভিতে ইউটিউবে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গান ছেড়ে দিই।
পাশাপাশি বেজে চলে মিলন মাহমুদের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’ গানটি। গানটির চিত্রায়নের ভিডিও দেখাই আর ছেলেমেয়েকে বাড়িতে ফেরার টানের কথা ব্যাখ্যা করি। বলি, কোনো আনন্দই আসলে আনন্দ হয়ে ওঠে না, যদি না সেটা আমরা আপনজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারি। এ বিষয়টা ওরা আগে ঠিক বুঝত না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাদের আবেগটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। তাই সেদিন তারা আর ইউটিউব দেখা নিয়ে ঝামেলা করে না।
এরপর রাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুটলাম মুদিদোকান টুকিটাকিতে। সেখানে চাঁদরাতের মেহেদি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। গিয়ে দেখি, বিশাল ভিড়। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে মেয়ের হাতে মেহেদি দিয়ে নিলাম। এত সময় অপেক্ষা করতেও কারও বিরক্তি নেই। সবার মুখেই উৎসবের হাসি। প্রবাসে ঈদকে সামনে রেখে চলে বিভিন্ন প্রদর্শনী। সেখানে বাহারি রঙের ঈদের পোশাক পাওয়া যায়। পাশাপাশি সেসব জায়গায় মেহেদি দেওয়ারও ব্যবস্থা থাকে। সেসব প্রদশর্নীতে গেলে মনে হয় যেন ঈদের আগের রাতে দেশের ঈদের বাজারে এসেছি।
এরপর গভীর রাত পর্যন্ত চলল ঈদের রান্না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছেলেমেয়ে দুটোকেও তুলে দিলাম। এরপর সবাই গোসল করে নতুন কাপড় পরে নিলাম। এবার অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার ঈদের জামাতের আয়োজন করেছিল আমাদের বাসার কাছের ভিক্টোরিয়া পার্কে। আমাদের বাসা থেকেই ঈদের মাঠের বয়ানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঠিক যেমন ছোটবেলায় আমরা ঈদগাহ থেকে হুজুরের বয়ান শুনতে পেতাম।
সেমাই দিয়ে মিষ্টিমুখ করে ছেলেমেয়ে দুটোকে সঙ্গে নিয়ে নামাজে চলে গেলাম। পার্কের খোলা মাঠটা যেন হয়ে উঠেছিল দেশের ঈদগাহ ময়দান। মাঠের প্রবেশপথে বিভিন্ন কাউন্টারে রাখা ছিল ডোনাট আর জিলাপি। পর্দা দিয়ে আলাদা করে ছেলেমেয়েদের ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রায় তিন হাজার লোক একসঙ্গে নামাজ আদায় করল। নামাজের শেষে চলল কোলাকুলি। আমরা জিলাপি নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম। এই জিলাপির স্বাদ সব সময়ই কেন যেন আলাদা হয়। হয়তোবা এটা আমাদের মনের আবেগের কারণে।
বাসায় ফিরে এসে সবাই মিলে শুরুতেই প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। এরপর ওনারাও বেড়াতে এলেন। এভাবেই ঈদের সারাটা দিন ব্যস্ততায় কেটে গেল। ঈদ উপলক্ষে এমন অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও যাঁদের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না।
পাশাপাশি বাচ্চারাও একটা বিনোদনের সুযোগ পায়। সব বাচ্চা এক জায়গায় হলে তাদেরকে আর বলে দিতে হয় না, তারা কী করবে। তারা নিজেদের মতো করে নিজেরা খেলা আবিষ্কার করে খেলতে থাকে। এবার ঈদ ছুটির দিনে হওয়াতে একটু বাড়তি আনন্দ যোগ হয়েছিল। এরপর রাত জেগে চলে ঈদের গান–নাটক দেখা। প্রবাসে বসেও আমরা ঈদের ‘ইত্যাদি’ দেখতে ভুলি না কখনোই। পরদিনও আমরা দূরে–কাছের বন্ধুদের বাসায় বেড়িয়ে সময় পার করলাম। তার পরদিন সোমবার আবার কাজে ফিরে গেলাম।
পাশাপাশি চলে অন্তর্জালের মাধ্যমে দেশে ফেলে আসা স্বজন–বন্ধুদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। এটা সব সময়ই বাড়তি আনন্দ যোগ করে। আর দেশের সবকিছুই তো এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়। একটাই শুধু দুঃখ যে তাদেরকে ছুঁয়ে দেখা যায় না। প্রবাসে আসলে ঈদের আনন্দ এক দিনে শেষ হয় না। এই আনন্দ চলতে থাকে সপ্তাহব্যাপী, কখনো মাসব্যাপী। কারণ, ঈদ শেষ হলেও চলতে থাকে ঈদ পুনর্মিলনী।
প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে উৎসবের দিনগুলোতে একটু অবসর পাওয়া যায়। এই অবসরগুলোয় বারবার দেশে ফেলে আসা স্বজন ও সময় নিয়ে আমরা আবেগতাড়িত হই। অন্যান্য আর দশটা সাধারণ দিনে দেশের কথা, স্বজনের কথা মনে না পড়লেও উৎসবের সময়গুলোতে সব একসঙ্গে মনে পড়ে যায়। বাকি জীবনটা কেটে যায় এক ধরনের দোদুল্যমানতায়। তবুও বাস্তবতার কষাঘাতে জীবন বয়ে চলে। উৎসবের দিনগুলোতে সবার মনের মধ্যেই একই গান বেজে চলে—স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।