কিংবদন্তি হিথ লেজার: জন্ম যাঁর জোকারের জন্য
পরনে তাঁর একেবারে সস্তা মূল্যের বেগুনি রঙের স্যুট, সমগ্র মুখমণ্ডল পুরু মেকআপে ঢাকা আর দুই ঠোঁট ছাড়িয়ে ওপরের সমান্য অংশ লাল রঙের লিপস্টিকে জড়ানো। আর সেই সঙ্গে বিখ্যাত অট্টহাসি, হা...হা...হা....! তাঁর মধ্যে নেই কোনো ধরনের সুপার পাওয়ার। তারপরও গোটা বিশ্ব কাবু হয়ে যায় তাঁর কথা, ধূর্ততা আর কূটবুদ্ধির জালে। ভিলেন অথচ নায়কের চেয়েও তিনি বড়। দিন শেষে তাঁর প্রতি ভালোবাসায় সবার অশ্রুসিক্ত। কখনো কী এমনটি ভাবা যায়? সাধারণত আমরা যেকোনো সিনেমায় কী দেখি? বিশেষ করে সুপারহিরো সিনেমায়। নায়ক হচ্ছেন সত্য, ন্যায় ও মানবতার প্রতীক। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে সে বিশেষভাবে সম্মানিত।
অন্যদিকে ভিলেন সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলাকে নষ্ট করতে চান। পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা তাঁর কাজ। নায়ক আর ভিলেনের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত নায়ক জয়লাভ করে এবং মানুষ তাঁকে ঘিরে অনুপ্রেরণা খুঁজতে চায়। সিনেমার শেষে ভিলেনকে নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হয় ভিলেনকে নিয়ে। তবে এমন একটি ভিলেন চরিত্র রয়েছে, যা গতানুগতিক সব ধরনের ভিলেন চরিত্র থেকে আলাদা। এ চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি রুপালি পর্দায় চরিত্রটিকে এক অনবদ্য রূপে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সমাজের রূঢ় বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অভিনীত এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে। বদলে দিয়েছেন অতীতের অনেক ইতিহাসকে। তাই এ সিনেমায় কাজ করা নায়কের চরিত্রের চেয়ে শেষ পর্যন্ত ভিলেনের চরিত্র অধিকমাত্রায় ঠাঁই পেয়েছে দর্শকদের মনে।
বলছিলাম ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’–এর বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত সিকুয়েল ‘দ্য ডার্ক নাইট’–এর ইতিহাস। এ সিনেমায় ক্রিস্টোফার নোলান হিথ লেজারের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন জোকারের এক ভিন্ন রূপ। সিনেমার শুটিংকালে নোলান কী কখনো ভেবেছিলেন, হিথ লেজারের অভিনয় দক্ষতায় সুপারহিরোকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিলেনকে সবাই আপন করে নেবে। আর মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পরেই তাঁর এ সিনেমা কালজয়ী হয়ে উঠবে?
হয়তো নোলান কখনো এভাবে ভাবেননি। এমনকি তিনি যখন ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজ নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ডিসি ভক্তদের অনেকে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছিল। কেননা ক্রিস্টোফার নোলান একেবারে ভিন্ন আবহে ব্যাটম্যানকে তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন। কমিকের বাইরে গিয়ে একেবারে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি পর্দায় ব্যাটম্যানকে ফুটিয়ে ধরার পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন।
ব্যাটম্যানকে নিয়ে অতীতে অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, তবে নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলোজি’ ব্যাটম্যান সিরিজের অন্য সব সিনেমা থেকে একেবারে আলাদা। আর আলাদা হবে না কেন? ক্রিস্টোফার নোলানের চিন্তাধারা আমাদের মতো কখনো সরলরৈখিক নয়। তাই যাঁরা শুরুতে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হন, নোলানের দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলোজি নিছক কোনো সুপারহিরো ফিল্ম সিরিজ নয়, বরং এক অনন্য সাধারণ শিল্প হিসেবে নোলানের ডার্ক নাইট ট্রিলোজিকে আখ্যা দিলেও ভুল কিছু বলা হবে না।
সুদর্শন হিথ লেজারকে খলনায়ক জোকারের চরিত্রে শুরুতে অনেকে মেনে নিতে পারেননি ঠিকই, তবে স্থিরচিত্র আর ট্রেলারের ঝলক দেখে দর্শক আর টুঁ শব্দটি করতে পারেননি। মনে পড়ে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমায় জোকারের ফার্স্ট এন্ট্রির কথা?
গোথাম শহর থেকে অন্যায় ও অপরাধ পুরোপুরি মুছে যায়নি। তাই শহরটি তখনো অশান্ত আর নৈরাজ্যে পরিপূর্ণ। এ রকম পরিস্থিতিতে একদল ডাকাত এ শহরে একটি ব্যাংক লুটের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। ডাকাত দলের প্রত্যেক সদস্যের মুখে মাস্ক পরিহিত ছিল, সার্কাসের জোকারেরা ঠিক যে ধরনের মাস্ক পরে ওই একই ধরনের মাস্ক দিয়ে তারা তাদের মুখ জড়িয়ে রেখেছিল। ব্যাংক লুটের পাশাপাশি তারা নিজ দলের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা করছিল। কেননা এ দলের যিনি প্রধান ছিলেন অর্থাৎ, যিনি তাঁদের এ ব্যাংক ডাকাতির কাজে প্রলুব্ধ করেছিলেন, তাঁর লজিক ছিল, সদস্যসংখ্যা যত কম হবে; ভাগে অর্থের পরিমাণ তত বেশি হবে। তাই যতটা সম্ভব কাজ চলাকালীন, অন্যদের মেরে ফেলার জন্য তিনি সবার মগজ ধোলাই করেছিলেন। এ ধারাবাহিকতায় ব্যাংক লুট শেষে শুধু একজন বেঁচে থাকে। তাঁকে উদ্দেশ্য করে আহত এক ব্যাংক অফিসার বলে উঠেন, ‘যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন, তিনি পরে আপনাকেও মেরে ফেলবেন। কেননা এ শহরের অপরাধীদের কিছু রীতিনীতি রয়েছে। তাঁরা সামনে থেকে সব ধরনের অপরাধ করেন। লোভে পড়ে তাঁরা আপনার মতো ফালতু লজিকের চালাকি করে নিজেদের লোককে হত্যা করেন না। আপনার মতো বেঈমান অপরাধীদের তাঁরাই মেরে ফেলেন।’
তখন বেঁচে যাওয়া ওই ব্যক্তি আহত ব্যাংক অফিসারের কাছে এসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি জীবনের যা কিছু তোমাকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে গিয়েও মেরে ফেলতে পারে না; তা অবশ্যই তোমাকে পুরোপুরিভাবে বদলে দেয়। তখন তোমার নিজস্ব রীতিনীতি তৈরি হয়। তখন তোমার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।’
এরপর তিনি তাঁর মুখ থেকে মাস্ককে সরিয়ে নেন। এ প্রথমবার আমরা দেখতে পাই জোকারকে যিনি ছিলেন ওই ডাকাত দলের লিডার।
যদিও সিনেমার প্রথম অংশে আমরা জোকারের নেতৃত্বে এক দল ডাকাতকে ব্যাংক লুট করতে দেখি, তবে সত্যি কথা বলতে গেলে জোকারের নগদ অর্থ কিংবা পার্থিব কোনো সম্পত্তিকে ঘিরে কোনো ধরনের লোভ ছিল না। জোকার এমন এক সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে নিয়ম আর শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না। নৈরাজ্য হবে এ সমাজের মূলভিত্তি। এ কারণে ব্যাটম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ের একপর্যায়ে যখন তিনি হেরে যাচ্ছিলেন, তখনো তিনি হাসছিলেন। ব্যাটম্যানের নীতি হচ্ছে, তিনি কখনো কোনো অপরাধীকে হত্যা করেন না। তিনি তাঁকে আইনের হাতে তুলে দেন। জোকার মনেপ্রাণে চাইছিল ব্যাটম্যান তাঁর নীতি থেকে সরে আসুক। এ কারণে ব্যাটম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যখন মনে হচ্ছিল যে জোকার মারা যাবেন তখনো তিনি এ ধরনোর চাওয়া থেকে হাসছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যাটম্যান তাঁর নীতিতে অটল ছিলেন। এ কারণে জোকারকে তিনি হত্যা করেননি। তাঁকে পুলিশের সঙ্গে সমর্পণ করেছিলেন।
জোকারের মতে, আমরা সবাই আইনের দৃষ্টিতে সব কিছু বিবেচনা করি। কখনো কোনো অপরাধীর চোখ দিয়ে কোনো দিয়ে কোনো জিনিস দেখার চেষ্টা করি না। কেন কীভাবে তাঁরা অপরাধী হয়ে আসছে অথবা তাঁরা কেন অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে, সেদিকটি আমরা কখনো ভেবে দেখি না। জোকারের ভাষ্য অনুযায়ী, ভালো আর খারাপ এ দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তার মতে সমাজের চোখে আজকে যে মানুষটি সম্মানিত এবং যে মানুষটি ন্যায়ের প্রতিমূর্তি হিসেবে সকলের কাজে বিবেচিত হন, পরিস্থিতি তাঁকেও বদলে দিতে পারে। তিনিও তার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণভাবে ১৮০ ডিগ্রি বাঁক নিতে পারেন। সিনেমার শেষে আমরা তেমনটি দেখি, হার্ভি ডেন্ট যিনি গোথাম শহরে একজন নামকরা আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে সবার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন; জোকারের প্ররোচনায় তিনিও সম্পূর্ণভাবে বদলে যান। হোয়াইট নাইট থেকে তিনি পরিণত হন টু ফেসে। একসময় গোথাম শহরের মানুষ যাঁকে হিরো হিসেবে শ্রদ্ধা জানাত, তিনি খলচরিত্রে রূপান্তরিত হয়ে যান। অর্থাৎ, ক্রিস্টোফার নোলান প্রচলিত সুপারহিরো সিনেমার সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দুর্নীতি, রাজনীতি, নৈরাজ্য, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ সবকিছু মিলিয়ে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমার মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ মনস্তত্ত্বের অবতারণা ঘটিয়েছেন। যার ফলস্বরূপ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আজীবন জায়গা দখল করে নিয়েছেন অভিনেতা হিথ লেজার এবং নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান। প্রথমবারের মতো পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে হিরোর চেয়ে তাঁর বিপরীতে কাজ করা ভিলেনকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে বেশি। দর্শক আর সমালোচকদের দৃষ্টিতে তাই সর্বকালের সেরা ভিলেনের তকমা জোটে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ এর জোকারের। এ সিনেমার প্রত্যেকটি ডায়ালগ ছিল হৃদয় স্পর্শ করার মতো। আর জোকার চরিত্রটি ছিল একটি আদমস্তক দর্শন ভান্ডার। ১৮৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বাজেটের সিনেমাটি আয় করে এক বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর সেই সঙ্গে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ পরিণত হয় কিংবদন্তিতে। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সর্বকালের সেরা খলনায়কদের তালিকায় সবাইকে পেছনে ফেলে ১ নম্বরে অবস্থান করছে হিথ লেজারের জোকার। একটা সুপারহিরো সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৯.০, এমনটি কখনো কল্পনা করা যায়?
১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পার্থে হিথ লেজারের জন্ম হয়। ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
হিথ লেজার তাঁর জীবদ্দশায় খুব বেশি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পাননি। বলাবাহুল্য, এক জোকার চরিত্র দিয়েই ভক্তকুলের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন। আর সেজন্য প্রথমবারের মতো কোনো কমিক বুকের চরিত্রে অভিনয় করে হিথ লেজার ২০০৯ সালে পেয়ে যান শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রের অস্কার।
২০০৮ সালের ২৪ জুলাই যখন ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সব প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। তার আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। অর্থাৎ, জীবদ্দশায় তিনি তাঁর সাফল্য আর অর্জনকে দেখে যেতে পারেননি। আজকে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাঁর বয়স হতো ৪৪ বছর, হয়তো বা আরও অনেক মাস্টারপিস সিনেমায় তিনি তাঁর অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে অন্য এক স্থানে নিয়ে যেতে পারতেন।
নিয়তি তাঁর প্রতি ছিল বড়ই নির্মম। যত দিন পর্যন্ত এ পৃথিবী টিকে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত রিয়েল জোকার আর রিয়েল অ্যানার্কিস্ট হিসেবে হিথ লেজার আমার সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন।
২০১৯ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা টড ফিলিপস ‘জোকার’ নাম একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। ডিসি কমিকের আইকনিক চরিত্র জোকার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এ সিনেমা বানিয়েছিলেন। এ সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৮.৪ এবং সিনেমার মূল চরিত্র। অর্থাৎ, জোকার চরিত্রে অভিনয় করেন পোর্টো রিকোতে জন্ম নেওয়া ওয়াকিন ফিনিক্স। ২০২০ সালে তিনি এ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে অস্কার জিতে নেন। পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনিও অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে হিথ লেজার ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা। তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘আই অ্যাম স্ট্যান্ডিং হেয়ার অন দ্য শোল্ডার অব হিথ লেজার।’ ৪৪তম জন্মবার্ষিকীতে অকালপ্রয়াত এ নায়কের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।