ঢাবির অর্জন ও ঐতিহ্য বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যার বিশালসংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্র গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এটা একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যার ছাত্ররা জাতির স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে বাংলাদেশ হতো না। দেশের রাজনৈতিক বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। এই স্বীকৃতির প্রমাণ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি একটি জাতীয় অনুষ্ঠান (ভাষাশহীদ দিবস) পরিচালনা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান কমে যাওয়া এবং বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রতুল আর্থিক সামর্থ্য। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট যেখানে বছরে ১০২ মিলিয়ন ডলার, হার্ভার্ডে তা ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্বমানের নোবেল বিজয়ী শিক্ষক ও বিশ্বমানের গবেষণা অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারত, যা বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে উঁচু স্থান পাওয়ার প্রধান শর্ত। শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়ার জন্য বাংলাদেশের ধনিক ও রাজনৈতিক এলিট শ্রেণিকে দায়ী করে তিনি বলেন, এই শ্রেণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিত্যাগ করেছে। উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তাদের আস্থা বা ভালোবাসা নেই। তাই নিজেদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়িয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দেন। তাঁদের বেশির ভাগই আর দেশে ফিরে আসেন না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি জাতি বঞ্চিত হয় তাঁদের সেবা থেকে। নিজের সন্তানকে পাঠাতে হয় না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের ব্যাপারে এলিট শ্রেণির কোনো আগ্রহ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ও মুজিব শতবর্ষের তিন মাসব্যাপী উৎসবের অংশ হিসেবে আয়োজিত দুটি ওয়েবিনারের প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয় গত ৩১ জুলাই। বাংলা একাডেমি পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক, শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। প্রথমটি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গণতন্ত্র বনাম গুণতন্ত্র (মেরিটোক্রেসি)’ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রতিথযশা শিক্ষক উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ। ‘দ্য রোল অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ইন প্রমোটিং জেন্ডার রাইটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন’ শীর্ষক দ্বিতীয় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রোভিসি এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের ভিজিটিং অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। এই প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক যোবাইদা নাসরিন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সংগঠনের সভাপতি দেওয়ান গৌস সুলতান ও যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আবু আকবর আহমদ ইকবাল।

প্রবন্ধের আলোচক অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাশূন্যতার প্রক্রিয়া বিষয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এলিট শ্রেণির নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র–শিক্ষকদের প্রায় সবাই প্রান্তিক কৃষকের সন্তান। তবে তিনি দেশের নীতিনির্ধারক এবং এলিট শ্রেণি কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহেলার বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, দেশের ধনিকেরা বিনিয়োগ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সশস্ত্র বাহিনী তাদের সন্তান ও সদস্যদের জন্য গড়ে তুলেছে নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়। শোনা যাচ্ছে, পুলিশ বাহিনীরও আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। তিনি গবেষণায় আর্থিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবহেলার শিকার হচ্ছে দাবি করে বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারদের চেয়ে সরকারি আমলারা বেশি পিএইচডি বৃত্তি পান।

‘দ্য রোল অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ইন প্রমোটিং জেন্ডার রাইটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন’ শিরোনামে দিনের দ্বিতীয় ওয়েবিনারের মুখ্য আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির সহ–উপাচার্য এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভিজিটিং অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। এর ওপর আলোচনা করেন অধ্যাপক যোবাইদা নাসরিন। মূল প্রবন্ধে মাহবুবা নাসরীন বলেন, দেশে নারী শিক্ষা বিস্তারে গত ১০০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে; যেমন রোকেয়া চেয়ার প্রতিষ্ঠা, বিবাহিত ও গর্ভবতী শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থানের সুযোগ প্রভৃতি।

আলোচক অধ্যাপক যোবাইদা নাসরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষতান্ত্রিকতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে বিলম্বের ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, মধুর ক্যানটিনের সামনে শহীদ মধুসূদন দের ভাস্কর্য শোভা পেলেও তাঁর স্ত্রী ও ক্যানটিনের সহপরিচালক শহীদ যোগমায়া দের কোনো ভাস্কর্য নেই। একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পুরুষ হলে পরিচালিত গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা গবেষণা হলেও রোকেয়া হলে গণহত্যার ওপর কোনো কাজ হয়নি। আর্টস ফ্যাকাল্টি ভবনের অনেক ফ্লোরে এখনো নারীদের জন্য কোনো টয়লেট নেই। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরাও এখন পর্যন্ত ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীসহ কয়েকজন বিশিষ্ট অ্যালামনাই। রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী বিপ্লবী লীলা নাগের নামে কোনো হলের নামকরণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ১০০ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের রাজনীতি ও মেধা বিকাশে পালন করেছে নিয়ামক ভূমিকা। তবে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথম ৫০ বছর দুই ক্ষেত্রে সমানতালে ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তী ৫০ বছরে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে। তিনি এ অধঃপতনের জন্য ছাত্র–শিক্ষকদের অন্ধ দলীয় আনুগত্যের রাজনীতি প্রধানত দায়ী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার ছাত্র–শিক্ষকেরা সম্পূর্ণভাবে দলীয় রাজনীতির লাইনে বিভক্ত। তিনি বলেন, ছাত্র–শিক্ষকদের অবশ্যই রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকবে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার দেশের মেধা বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দলীয় রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ক্লাসরুম, আবাসিক হল ও প্রশাসন পরিচালনা–বলয়ের বাইরে রেখে জ্ঞানচর্চা ও দক্ষতা বিকাশকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্ধুতে স্থান দিতে হবে। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধিতে বিশ্ববিদ্যালয় সফল হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি দেশে গবেষণা অবকাঠামো, যেমন সায়েন্স ল্যাবরেটরি ইত্যাদি নির্মাণে বিনিয়োগ করার জন্য প্রবাসী শিক্ষানুরাগী ও অ্যালামনাইদের প্রতি আহ্বান জানান।

ওয়েবিনারে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের সভাপতি ও ওয়েবিনারের সঞ্চালক দেওয়ান গৌস সুলতান। তিনি বলেন, দ্বিশতবার্ষিকীর দ্বিতীয় ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয় গতকাল শনিবার। দ্বিশতবার্ষিকীর মহোৎসব অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেটার লন্ডনের ব্রেন্টউডের ইডেন গার্ডেনস ভেন্যুতে। এতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে সদয় সম্মতি জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিশতবার্ষিকীর বিশেষ স্যুভেনির। দেওয়ান সুলতান যুক্তরাজ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধুর সব অনুরাগী, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বকে সব অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণ, প্রচার ও স্পনসরশিপের মাধ্যমে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানান।