বছর দুয়ের তফাত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ হতে পদদ্বয়কে যথেষ্ট ব্যবধান বজায় রাখতে হয়েছে। পাঠ্যকর্ম চুকিয়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি সংকুলানের নিমিত্তে মনোযোগ নিবিষ্ট করার প্রয়াসে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অক্ষি মেলে নয়নজুড়ানোর কিঞ্চিৎ সময় বের করা প্রায় দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হওয়ার দরুণ, বিদেশি গুটিকয়েক অদ্ভুত স্মৃতি হৃদয় ক্যানভাসে বর্ণিল তুলির নির্মল আঁচড়ে স্বপ্নিল অবয়বে এক অদৃশ্য দৃশ্যপট রচনা করে রেখেছে। স্মৃতির আয়নায় সেই অদৃশ্য দৃশ্যপটের কিছু কিছু দৃশ্য হঠাৎ ক্ষণিকের তরে দৃশ্যমান হয়ে স্মৃতির অধ্যায়কে বারংবার নবায়ন করে রাখে। স্মৃতির আলোড়ন সহসাই আমাদের আবেগআপ্লুত করে হৃদ্যন্ত্রে কম্পন তৈরি করে। কিছু কিছু স্মৃতির লহরি কর্মে উদীপ্ত করে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নবদিগন্তের সূচনা প্রতিষ্ঠা করে থাকে। কিছু স্মৃতি হৃদয়কোণে ঝংকার তুলে আপনাতেই হেসে ফেলে। আবার কিছু কিছু স্মৃতি আমাদের নিমগ্ন করে রাখে সদাজাগ্রত সুবিশাল জলসমুদ্র মোহনায়। যার কূল-কিনার কিংবা আদি-অন্ত সীমানা সমস্তটাই অজানা।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের আবির্ভারের জন্য জার্মান জনজীবনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে অদ্ভুদ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সুস্থ মানুষ হয়েও অসুস্থ রোগী সেজে থাকতে হয়। সর্বত্রই ফেস মাস্কের উপস্থিতি নজর কেড়ে নিচ্ছে। তাইতো স্টুটগার্ট শহরকে আবাসিক হাসপাতাল ভাবলেও কোনো অংশে ত্রুটি হবে না। জার্মান জনগণ ফেস মাস্ককে অতিরিক্ত পোশাক ভেবে একরকম অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। সর্বস্তরের জনসাধারণ যেন নির্বিঘ্নে টিকা নিতে পারে, সেই লক্ষ্যকে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। তবে বেদনার কথা হল, পাবলিকের কাছে ওয়েবসাইটগুলোর কদর অকস্মাৎ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার দরুন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার পর্বতপ্রমাণ আশা খাটো হতে হতে প্রায় শূন্যের ঘরে গিয়ে অস্থান নেওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ কোন উপায় উদ্ভাবন করতে না পরে, গভীর রজনীতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাভের চেষ্টা চালানোর সংকল্প পাকা করলাম। প্রশান্তির নিদ্রাকে কবরস্থ করে, মধ্যরজনী অবধি জাগ্রত নয়নে অপেক্ষারত রইলাম। অবশেষে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতেই চক্ষুজোড়া মিউজিয়ামের আসবাব হয়ে গেল। কেননা, মিলিসেকেন্ডের ব্যবধানে সমস্ত ফ্রি স্লটগুলো সুনামির বেগে উধাও হয়ে গেল। পুনরায় ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার চেষ্টা–তদবির চালানোর কোনোরূপ ত্রুটি বাকি রইল না। তবে আশানুরূপ সফলতা অর্জনের নাম–নিশানাও উদ্ধার করতে পারলাম না। ফলাফল, ওয়েবসাইট কর্তৃক অর্ধচন্দ্র পাওয়ার শতভাগ সম্ভবনা স্পষ্ট উপলব্ধি করে, আপনা হইতে মান-সম্মানের সহিত কেটে পড়লাম। এরকম অপ্রত্যাশিত অর্ধচন্দ্রের অভিজ্ঞতার ইতিহাস রচনা করে, অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হৃদয়ে প্রাণহীন কম্পিউটারকে বেশ কয়েকটি কড়া কথা শুনালাম।
মেজাজের উত্তেজনা চরম অবনতি হওয়ার কারণে রাত্রিকালের নিদ্রা যাপন তেমন সুবিধার হয় নাই। যদিও শয়নকাল খানিকটা বিলম্বিত হয়েছিল, কিন্তু নিদ্রা কেটেছে কাকডাকা ভোরে। নিত্যদিনের ন্যায় কর্মস্থলে গিয়ে, সহকর্মীদের সঙ্গে টিকাবিষয়ক জ্ঞান আদান–প্রদান করার একটা উপলক্ষ বের করলাম। সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে, টিকা পাওয়ার কোনো সহজতর অজানা তথ্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে, গোয়েন্দা কাহিনীর শার্লক হোমসের চরিত্রে নাম লিপিবদ্ধ করলাম। অনুসন্ধানপূর্বক এতদূর খবর আবিষ্কার করলাম যে তারা প্রায় প্রত্যেকেই টিকা গ্রহণের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিশ্চিত করেছেন।
সবশেষ, এক সহকর্মী কর্তৃক ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করে, তাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। যেকোন ব্যক্তিগত চিকিৎসকের চেম্বার হতে, টিকা গ্রহণের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাভ করার সরকারি নির্দেশনার চূড়ান্ত সংবাদ শুনিয়ে তিনি আমাকে ধন্য করলেন। টিকা গ্রহণের সময় নির্ধারণ হয়েছে পরদিন বেলা ১০টায়। টিকার পর্ব খতম করে রুটিরুজির সন্ধানে সরাসরি কর্মস্থলে হাজির হতে হবে, সেই কথাই বারংবার স্মরণ করে, গৃহ হতে অফিসের ল্যাপটপটা অনিচ্ছায় অতিরিক্ত মূল্যবান বস্তু গণ্য করে, নিজের সঙ্গে বহন করতে একরকম বাধ্যই হলাম।
উল্লেখ্য, জার্নানিতে প্রায় প্রতিটা শহরে নানা প্রকার যানবাহনের যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় বর্ণিল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। চার-পাঁচ প্রকারের ট্রেনসেবা আছে। যেমন, এস-বান (S-Bahn), ইউ-বান (U-Bahn), আঞ্চলিক ট্রেন, আন্তনগর ট্রেন এবং চায়ের টঙ্গের মতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাসের যাত্রী ছাউনিগুলো, যাত্রীর অপেক্ষায় দিবা–নিশি সর্বক্ষণই অপরিতৃপ্ত বেদনায় প্রহর গুনে উন্মুখ দৃষ্টিতে পলক মেলে রাখে। আমার গৃহচিকিৎসকের ডেরা অবধি পৌঁছবার লক্ষ্যে এস-বানই (S-Bahn) সর্বাপেক্ষা উত্তম হওয়ার দরুণ, পদদ্বয়কে এস-বান ট্রেনস্টেশনে চালিত করলাম। সাত মিনিটের ব্যবধানে স্টেশন উপস্থিত হলাম। মাসিক টিকিট থাকায় কোনো ভাবনা–চিন্তায় নিমগ্ন না হয়ে, পরম আনন্দে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনের স্বচ্ছ বাতায়নে অক্ষি মেলে দূর-দূরান্তের সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃশ্যসমূহ অবলোকন করতে করতে একরকম আনমনে হয়ে গেলাম। যাই হোক, কোনোরকম বিপত্তি ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত ট্রেন স্টেশনে যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম। করোনা টিকা এখন অতি মূল্যবান বিধায় অন্য সব কিছুই মূল্যহীন মনে হচ্ছিল। তাই ডিজিটাল ম্যাপটাকেই আদর্শ প্রতীক মেনে, তাতে অঙ্কিত ডিজিটাল পথের ডিজিটাল পথিক হয়ে, ধীরে ধীরে এক কদম দুই কদম করে চিকিৎসকের দুয়ারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। চিকিৎসকের বৈঠকখানায় বুড়া-বুড়ি, দুজন মধ্যবয়সী রমণী, একজন শুঁটকির মতো রোগাপাতলা ভদ্রলোক আর আমি, মোট ছয়জন মানুষ তীর্থের কাকের মতো ঝিমাচ্ছি। ইতিমধ্যে বুড়া-বুড়ি ও মধ্যবয়সী রমণীরা টিকার পর্ব চুকিয়ে ফেলেছেন, আর তা তাদের হস্তে পরিহিত স্বল্প শুভ্র পট্টিই প্রমাণসূচক চিহ্ন বহন করছে। আমি স্বাস্থ্যবিমার কার্ডখানা চিকিৎসকের সহকারীর নিকট জমা দিয়ে, খানিকটা স্বস্তির সঙ্গে ঘরের কোম্পানি বায়োএনটেকের টিকার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম। কিছুক্ষণ পরে মায়াবিনী চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি আমার নামখানা কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখে আমার পানে একঝলক তাকিয়ে মুচকি হেসে ফেললেন।
চিকিৎসক: তুমি তো আমিমুল।
আমি: হ্যাঁ।
সাধারণত জার্মানিতে অপরিচিত জনসাধারণের জন্য ‘আপনি’ সম্বোধন বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে তার সম্বোধনে ‘তুমি’ শুনে, তাঁকে একটু বেশি মাত্রায়ই বন্ধুসুলভ মনে হলো।
চিকিৎসক: কেমন আছো?
আমি: হ্যাঁ, ভালো আছি।
চিকিৎসক: তোমার ই–মেইলখানা আমি আগা–গোড়া পড়েছি। (মিট মিট হাসছে)
আমি: অসংখ্য ধন্যবাদ।। (মিট মিট হাসছি)
চিকিৎসক: অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাতে কষ্ট হয়েছে ?
আমি: হুঁ।
চিকিৎসক: টিকার সুচে কিন্তু একটু ব্যথা হবে, হুম?
আমি: সমস্যা নাই।
চিকিৎসক: তোমার পরবর্তী টিকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমি দিয়ে রেখেছি, তারিখটা নিয়ে যেয়ো।
আমি: অবশ্যই।
টিকার পর্ব খতম করে, টিকা গ্রহণের প্রমাণ নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে হস্তে একখানা শুভ্র পট্টি লেপন করে দিলেন। সবশেষ, তাঁর নিজস্ব নাম অঙ্কিত একখানা কলম আমার শার্টের পকেটে পুরে দিয়ে, হাসিময় বদনে বিদায় জানালেন।
চিকিৎসকের চেম্বার থেকে ট্রেন স্টেশনে হাজির হলাম। কয়েক মিনিট সময়ের ব্যবধানে দুইটা স্টেশন বজ্রবেগে অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আর আমিও অফিসের অগ্রে গমনের নিমিত্তে ভিন্ন আরেকটি ট্রেন ধরার লক্ষ্যে নেমে পড়লাম এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ স্টেশনটা আমার পূর্ব থেকেই অত্যন্ত পরিচিত। কেননা শিক্ষাজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত মারফত এ স্টেশনের সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম মিতালি রচিত হয়েছে। তাই অপেক্ষারত এ মুহূর্তে, পূর্বেকার কিছু অমলিন স্মৃতি হৃদয়ের আয়নায় স্বল্পক্ষণের তরে অকস্মাৎ ভেসে উঠল। স্মৃতির স্রোতে সিক্ত হয়ে আমি যেন ধ্যানমগ্ন শিলাখচিত জীবন্ত ভাস্কর্য বনে গেলাম।
হঠাৎ করে পশ্চাৎ দিক হতে এক গম্ভীর জার্মান শব্দ ভেসে এল।
এনসুলডিগোং_(দুঃখিত, একটু শুনছেন)।
পশ্চাৎ দিক ফিরে দেখি এক ভয়ানক সুন্দরী তরুণী বিনয়ের সঙ্গে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার রূপের বিবরণ কলমের আঁচড়ে নির্মিত শব্দে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা একরকম দুষ্কর কর্মই মনে হচ্ছে। তার সৌন্দর্যের মহিমা প্রকাশের নিমিত্তে ব্যবহৃত বিশেষণের ভাণ্ডারেও টান পড়ে যাবে। তবুও কিছু একটা না লিখলে কী যেন একটা বাদ পড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। গায়ের রং বিচারে অতি উজ্জ্বল, তার সহিত হালকা হলুদের সংমিশ্রণে উজ্জ্বলতায় বাড়তি শান জুগিয়েছে বললে বিশেষ কোনো ত্রুটি হবে না। উচ্চতায় আমার থেকে ইঞ্চিখানিক উঁচু বলেই ধারণা করলাম। স্বাস্থ্যগত বিচারে অতি মাত্রায় সচেতন বলে মনে হলো, তাই একে তাপমাত্রার ন্যায় নাতিশীতোষ্ণ লিখেই ক্ষান্ত হলাম। মাথায় সোনালী কেশ, কাঁধ অবধি গড়িয়েছে। অক্ষিযুগল আসমানী, তার সঙ্গে সূক্ষ্মতম ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। সর্বাঙ্গ মার্জিত ও রুচিশীল বুননে নির্মিত স্কার্টে আবৃত, যা কিনা কিঞ্চিত হাঁটু ছাপিয়ে বেশ খানিকটা নিচে গড়িয়েছে। পদদ্বয় কৃষ্ণ বুট জুতায় আবৃত। কাঁধে চামড়ার নির্মিত মধ্যম ধাঁচের একটা ব্যাগ ও হাতের মোবাইলখানা চামড়ার মোড়কে মোড়ানো।
আমি: আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি? (ভি কান ইস মিয়া জি হেলফেন?)
তরুণী: প্রধান ট্রেন স্টেশনের ট্রেন কোনটা?
তার প্রশ্ন শ্রবণ করে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। কেননা, যার জবানিতে এত সাবলীল জার্মান উচ্চারিত হয়, অধিকন্তু দৃষ্টিদর্শনে জার্মান রূপে রূপায়িত, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্তটাই অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। তবে কিছু দিন যাবত স্টুটগার্ট শহরে ট্রেনের যাত্রীসেবা উন্নত করার প্রয়াসে, ট্রেনলাইন মেরামত ও নুতুনত্ব সংযোজনের কার্যাবলি সম্পাদিত হচ্ছে। তাই নবাগত ব্যক্তি বিশেষের নিমিত্তে এ দানবাকার ট্রেন স্টেশনে, ট্রেনের গতি প্রকৃতি নিরূপণ করা মাঝেমধ্যে একটু কষ্টসাধ্য ও শক্ত কর্মই বটে। তরুণীর প্রশ্নের জবাবের জন্যে জার্মান থেকে ইংলিশ ভাষাকেই উত্তম ভাষা বিনিময় মাধ্যম বলে বিবেচনার করলাম। কারণ, আমার অতিশয় পারদর্শীপূর্ণ জার্মান শ্রবণ করে, তিনি আবার তার জার্মান ভাষাই নড়বড়ে করে ফেলেন কি না, সেই সম্ভবনাকে একবারে খাটো করে দেখাটা সম্পূর্ণই বোকিমি হবে।
আমি: আপনি এস-৩ ট্রেনে যেতে পারবেন।
তরুণী: এস-৩?
আমি: হুঁ।
আমার জার্মান কর্তৃক ইংলিশে এরূপ দ্রুত ছন্দপতন অবলোকন করে তিনি তার হাসিকে আর সংবরণ করতে পারলেন না। তিন এবার ইংলিশেই বাক্য বিনিময় আরম্ভ করলেন। তবে বেদনা সংবাদ হল যে আমারন্যায় দ্রুত ইংলিশ বলার লক্ষ্যে তিনি বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় সমস্তই গুছিয়ে সাজিয়েছেন, শুধু বাক্যের ক্রিয়াটাই মাঝে মাঝে কাটা পড়ে যাচ্ছে।
তরুণী: কিন্তু এস-৩ তো লিস্টে নাই।
আমি: দেখুন, ট্রেনলাইনের কাজ চলছে, তাই একটু গোলমান হচ্ছে। আমিও প্রধান ট্রেন স্টেশনের লাইনেই যাব, সুতরাং আপনি আমার সাথে ট্রেনে চড়তে পারেন।
অতঃপর তাঁকে ভদ্রতাস্বরূপ ডাংকে সুন (আপনাকে অনেক ধন্যবাদ) বলে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে নীরবে কেটে পড়লাম। এরইমধ্যে এস-৩ ট্রেন চলে এল। ট্রেন স্টেশনে যাত্রী সংখ্যাও অনেক, ট্রেনের বিশালতার তুলনায় সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। এস-৩ ট্রেন লিস্টে নাই বলে, সে কি আবার ট্রেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভিমান ছলে স্টেশনেই অবস্থান করল! না কি ট্রেনে উঠেছে ইত্যাদি ভেবে নয়ন অবমুক্ত করতেই দেখি, সে ট্রেনের দরজার বিপরীত পৃষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দরজার পানে পলকহীন দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত স্থাপন করে আছে। যাই হোক, তার উপস্থিতি নিরূপণ করে এতটুকু নিশ্চিত হলাম যে সে তার গন্তব্যে আনন্দের সহিত পৌঁছাতে পারবে। ট্রেনের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুদ্ধ হয়ে গেল, সমস্ত কিছুকে বিদীর্ণ করে অশ্ববেগে ট্রেন ছুটতে লাগল। আর সেই তরুণী যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে এক পা দু পা করে আমার বাঁ পাশের সারির চারটা ফাঁকা আসনের একটাতে খুবই জড়সড় হয়ে বসে পড়ল। আমি স্বাস্থ্যবিমার কার্ড, টিকার সনদ ও হস্তের শুভ্র পট্টিখানা নিরীক্ষা করে, কোনরূপ বেদনার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় কি না তা অনুসন্ধান করতে লাগলাম। তবে আমার কার্যপ্রণালি পাশের সারির আসন হতে যে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ চলছে, তা বুঝতে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হলো না। সেকেন্ড কুড়ি কালের বিবর্তনে সে তার নিজস্ব স্থান ত্যাগ করে, আমার আসনের ঠিক বিপরীত আসনে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করল।
তরুণী: আপনার নাম কি?
আমি: নাম বললাম।
তরুণী: আপনি কী করেন?
আমি: ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নিয়োজিত আছি।
নিজেই তার নিজস্ব জীবনবৃত্তান্তের খানিকটা অংশ উপস্থাপন করে ফেলল। তার নাম ইউলিয়া, রাশিয়ান বংশোদ্ভত, জন্ম স্টুটগার্টের নিকটবর্তী ছোট প্রতিবেশী শহর রয়েটলিঙ্গেন। বয়স পাঁচকে ছাপিয়ে উঠার পূর্বেই জনক-জননীর সঙ্গে বার্লিনের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। দীর্ঘ আঠারোটি বছর অতীত করে, জন্মস্থান ‘রয়েটলিঙ্গেন’–এর প্রতি হৃদয় গহীনে গভীর কম্পন অনুভূত হয়েছে। হৃদয় কম্পনকে প্রশমিত করতে, শান্তির নীড়ের প্রচ্ছন্ন প্রয়াসে সুদূর বার্লিন থেকে রয়েটলিঙ্গেনে পদার্পণপূর্বক, কালক্রমে স্টুটগার্টে অতিথিবেশে আত্মপ্রকাশ রচনা করেছেন।
ইউলিয়া: আপনি কি স্টুটগার্টেই অধ্যয়ন করেছেন?
আমি: হুঁ।
ইউলিয়া: কোন বিষয়ে?
আমি: কম্পিউটার সায়েন্স।
ইউলিয়া: ও, একটু কঠিন, তাই না?
আমি: হুঁ, তাইতো মনে হয়।
ইউলিয়া: আপনি কি একা থাকেন?
আমি: হুঁ, একাই।
ইউলিয়া: আপনার মায়ের সঙ্গে কি কথা হয়?
আমি: অবশ্যই, তবে প্রতিনিয়ত হয় না।
সে এরূপ ধারাবাহিক প্রশ্ন করে যে সামান্যতম স্বস্তি অনুভব করছে, সেই উপসর্গই আঁচ করতে পারলাম। কেননা, তার দীর্ঘক্ষণ যাবত মোবাইল ফোনের মোড়কের এক পার্শ্বকোণ অবিরাম ধারায় খুঁটিয়ে যাওয়ার কার্যাবলি অজান্তেই নিবৃত্ত হয়েছে।
ইউলিয়া: আপনি মনে হয় একটু কম কথা বলেন। (হাসতে লাগলেন)
আমি: আসলে, এই একটু কমই বলি।
ইউলিয়া: হুঁ।
আমি: আপনি কোথায় যাবেন?
ইউলিয়া: বার্লিনে, বিকেলের ট্রেনে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আমি: কর্মস্থল স্টার্ডমিটেতে, প্রধান ট্রেন স্টেশনের এক স্টেশন পূর্বে।
ইউলিয়া: এখানে বড় মার্কেটগুলি কোথায়?
আমি: স্টার্ডমিটেতে।
ইউলিয়া: ও, তাহলে আমি আপনার সাথে স্টার্ডমিটেতে নামব।
আমি: আচ্ছা।
প্রায় কুড়ি মিনিট সময় গত করে ট্রেনটি ঠিকঠাক পাতাল স্টেশন স্টার্ডমিটেতে যাত্রাবিরতির লক্ষ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে কর্মের বেলা দুই ঘণ্টা অতীতে বিলীন হওয়ার দরুন, আমি বিদ্যুৎ বেগে ট্রেন ত্যাগ করে, কর্মস্থলের নিমিত্তে দ্রুততার সহিত পদদ্বয় সঞ্চালিত করলাম। পশ্চাৎ হতে ইউলিয়া আমার নামটা একটু উচ্চস্বরে ডেকে, অলিম্পিকের গতিতে ধাবমান পদদ্বয়ের গতিতে ব্রেক চাপানোর জন্যে বিনয়ের সহিত অনুরোধ করতে লাগল। স্টার্ডমিটে পাতাল ট্রেন স্টেশন থেকে আমার কর্মস্থল প্রায় দৃশ্যমানই বটে, মিনিট তিনেক ব্যাবধানমাত্র। ইউলিয়াও আমার ন্যায় মেঘ ধাবমান পদদ্বয়ের সহিত যথার্থ তাল মিলিয়ে কর্মস্থলের নিচ অবধি অবস্থান করে খানিকটা হাপিয়ে উঠল।
ইউলিয়া: এইটা আপনার অফিস ভবন?
আমি: হ্যাঁ।
ইউলিয়া: সুন্দর তো!
আমি: ধন্যবাদ।
তার কর্তৃক বিদায়ের ডঙ্কা বাজিয়ে, তাকে তার মতো পথ দেখিয়ে দিয়ে, আমি ভবনে প্রবেশ করলাম। অন্তিমবেলায় জারা, এস অলিভার, এইস এন্ড এম ও প্রিমার্ক এর মতো ফ্যাশনেবল বিপণিবিতানসমূহে ছাড় চলার অগ্রিম সংবাদ পরিবেশন করে একখানা ধন্যবাদ কুড়িয়ে নিলাম অবশেষে কর্মস্থলে প্রবেশ করতেই গোরস্থানের নীরবতা উপলব্দি করলাম। সদাচাঞ্চল অফিস আজ নীরবতার চাদরে আবৃত হয়ে অভিমানী রূপ লাভ করেছে। কেননা করোনার ভয়ে ভীত হয়ে, অধিকাংশ সহকর্মীই নিজস্ব গৃহ থেকে কার্যাবলী সম্পাদনের দরুণ, কিছুকাল যাবত কর্মী সঙ্কটে অফিসে নিঃস্তব্ধতা বিরাজমান রয়েছে। আমার এক সহকর্মীর পদচারণায় অফিস মুখরিত হয়ে ছিল বটে, তবে অকস্মাৎ তার পর্বতপ্রমাণ জরুরি প্রয়োজনে, অফিস ত্যাগ করার ছটাকখানেক হস্ত নির্মিত বিবরণের চিরকুট আমার টেবিলে লেপন করে রেখেছে। যাই হোক, অতশত না ভেবে নিজস্ব কর্মে ডুবে পড়লাম। ক্লায়েন্ট মিটিং, টিম মিটিং, কোডিং ইত্যাদি নানান কর্ম সম্পাদনে সময় বয়ে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে, বিকেল গড়িয়ে, সন্ধ্যা আসন্ন, ছয়টা। গির্জার ঘণ্টার ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবল বেগে ধাবিত হলো। কাজকর্মে সাময়িক তালাবদ্ধ ঝুলিয়ে, গৃহপানে ছুটলাম। বৈদ্যুতিক লৌহ ক্যাপসুলে ভর করে, নিম্নে পদার্পণ করা মাত্রই নয়নদ্বয় চরকগাছ বনে গেল। ইউলিয়ার মূর্তিমান উপস্থিতি।
আমি: আপনি এখনও যান নি?
ইউলিয়া: না। (সামান্য হাসছে)
আমি: কোনো সমস্যা হয়েছে?
ইউলিয়া: না। আপনাকে বিদায় জানানোর জন্য অপেক্ষা করছি।
আমি: অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইউলিয়া: আপনার কি পাউসে (দুপুরের বিরতি, বেলা ১টা থেকে ২টা ) ছিল না?
আমি: ছিল, তবে কর্মের চাপের করণে পাউসে নিতে পারি নি।
ইউলিয়া: ও। আমি আরও দুবার পাউসেতে (দুপুরের বিরতি) আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম।
তার কথা শুনে একরকম নির্বাক হয়ে গেলাম। জার্মানিতে সন্ধ্যা ছয়টায় ছুটির ঘণ্টা বেজে যাওয়া একটা নিয়মিত ব্যাপার। আর সেই উপলক্ষ্যে ১৫ মিনিট পূর্বে হতে সে অফিসের নিচে অবস্থান নিয়েছে। একজন মানুষের হৃদয়ের পরিসীমার পরিধি কী পরিমাণ বিস্তৃত হলে, এইরূপ বন্ধুসুলভ আচরণ পরিলক্ষিত হয়, তা ভেবেই একরকম নিথর হয়ে গেলাম। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট সময়ের পার্থক্যে প্রধান ট্রেন স্টেশনে উপস্থিত হলাম।
ইউলিয়া: আপনি কোথায় থাকেন?
আমি: পরের স্টেশনে। খুব বেশি হলে ১০ মিনিটের মধ্যেই গৃহে পৌঁছতে পারব।
ইউলিয়া: আপনি কি আর ১৫ মিনিট থাকবেন? আমার ট্রেন আরও ১৫ মিনিট পর।
আমি: ঠিক আছে।
ইউলিয়া: আপনার কী আজ প্রথম টিকা ছিল?
আমি: হ্যাঁ।
ইউলিয়া: রাত্রে জ্বর আসতে পারে।
আমি: দেখি কী হয়।
ইউলিয়া: আপনি কিন্তু বার্লিনে আসাতে পারেন।
আমি: হুঁ।
ইউলিয়া: বার্লিনেও অনেক ইংলিশ জব আছে।
আমি: হুঁ, দেখি ভবিষ্যতে কী হয়।
ইতিমধ্যে ট্রেন স্টেশনে যাত্রীর ঢল বইতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পদের আন্তনগর ট্রেন ও তাতে চড়ার যাত্রীদের ক্রমাগত ভিড়ে ট্রেন স্টেশনে জনপ্লাবন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঘটিকার ত্রিদণ্ডও সাংকেতিকভাবে বার্লিনের ট্রেনে চড়ার সংকেত প্রদান করছে। কেননা তিন মিনিটের মধ্যেই ইহা বিদায়ের ডঙ্কা বাজানোর নিমিতে পরিপূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আছে। ইউলিয়া ফিলেন ড্যাংক (অসংখ্য ধন্যবাদ) বলে ট্রেনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা মাত্রই ফটক রুদ্ধ হয়ে গেল। রুদ্ধ ফটকের স্বচ্ছ কাচের অন্তরালে সে তার গম্ভীর দৃষ্টি আমার প্রতি দীর্ঘক্ষণ স্থির করে রাখল। ট্রেন অশ্ববেগে অগ্রপানে ধাবিত হয়ে, স্টুটগার্ট ট্রেন স্টেশন হতে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব বর্ধিত করে নিমিষেই অদৃশ্য হওয়ায় মিশে গেল। আমিও এক পা, দুই পা করে লৌহ ক্যাপসুলযোগে স্টেশনের পাতালদেশে গমন করে বাসস্থানে যাত্রার নিমিত্তে আসন্ন ট্রেনের পথ চেয়ে ধৈর্য ধারণ করতে লাগলাম। আর ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় গহীনে এমনটাই উচ্চারিত হতে থাকল ‘ব্যবহারই বংশের পরিচয়।’
*লেখক: সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, স্টুটগার্ট, জার্মানি