আমার ভ্যালেন্টাইন–শেষ পর্ব
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে বের হচ্ছিলাম। কারণ, মেট্রোর সকালের প্রথম ট্রেন যাত্রা শুরু করার আগেই আমাকে মেট্রোস্টেশনে পৌঁছাতে হবে। দীপান্বিতার খোঁজ পেতে প্রতিদিন আমি মেট্রোরেলের উত্তরায় তিনটি স্টেশনের একেকটিতে একেক দিন দাঁড়িয়ে থাকি। এই অপেক্ষা চলে সকালের প্রথম ট্রেন থেকে রাতের শেষ ট্রেন পর্যন্ত।
আমি চুপি চুপি দরজা খুলে বাসা থেকে বের হতে যাব, সে সময় ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বলে উঠল। আমি পেছন ঘুরে দেখলাম বাবা সোফায় বসা। আর মা রুমের বাতির সুইচ বোর্ডের সামনে দাঁড়ানো। বাবা আমাকে বললেন,
—তোমার সঙ্গে তো আমার আজকাল দেখাই হয় না।
—দেখা সাক্ষাৎ কম হওয়াই ভালো। এতে মায়া বাড়ে। মায়া বড়ই খারাপ জিনিস।
—খবরদার, আমার সঙ্গে তুমি জ্ঞানের কথা বলবা না।
—আচ্ছা বলব না।
—আরেকটা বিষয়, তুমি প্রতিদিন ভোরবেলায় চোরের মতো বাসা থেকে বের হয়ে যাও। আবার চোরের মতো মাঝরাতে বাসায় ফেরো। কারণটা কি জানতে পারি?
—আমি আসলে একজন দক্ষ চোর হওয়ার চেষ্টা করছি। আমার জন্য তুমি দোওয়া কইরো।
বাবা এ পর্যায় মা কে বললেন,
—তোমার ছেলেকে আমার সঙ্গে ফান করতে মানা করো। আমি ওর বাবা। দুলাভাই নয়।
—বাবা তুমি আমার আর তোমার মাঝখানে মাকে টানবা না প্লিজ। আমি কি এখন যেতে পারি?
—না। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কথা বলার জন্য আমি সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে বসে আছি।
—বাবা আমার হাতে একদম সময় নাই।
—আমি মাত্র ১০ মিনিট নেব। দেওয়া যাবে?
—ওকে দিলাম। তুমি আমার বাবা। তোমাকে না বলাটা ঠিক হবে না। তবে সময় মাত্র ১০ মিনিট।
আমি বাবার সামনের সোফায় গিয়ে বসলাম। আমার বসার পর মা এসে আমার পাশে বসলেন। বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
—হঠাৎ করে সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি পরা শুরু করলা; কারণ টা কি জানতে পারি?
—সাদা রং পবিত্রতার প্রতীক তাই। তোমারও এখন সাদা পরা উচিত।
—আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তা হঠাৎ লুঙ্গি পরা শুরু করলে কেন?
—লুঙ্গিতে মুক্ত জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। শরীরে আলো বাতাস ঢোকে। খুব শান্তি। তোমারও লুঙ্গি পরে অফিসে যাওয়া উচিত। সেই রকম শান্তি পাবা।
—তোমাকে আগেই বলেছি, আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।
—আচ্ছা করব না।
—শুনলাম তুমি নাকি না ধুয়ে একই পোশাক প্রতিদিন পরো। তাকিয়ে দেখ, বিভিন্ন জায়গায় ময়লা বসে বসে তোমার সাদা পোশাক এখন মাল্টি কালার হয়ে গেছে।
—হু।
—তুমি কি আয়নায় নিজেকে দেখেছ? তোমাকে তো দেখতে ড্রাগ এডিক্টদের মতো লাগছে। গত সাত মাস তুমি সেভ করোনি, চুল কাটোনি। শুনলাম গোসলও নাকি করো না। তোমার শরীর আর পোশাক থেকে যে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, তা কি তুমি টের পাও।
—জি পাই। তবে সেটা এখন আর আমাকে বিরক্ত করে না।
—তা তুমি শেভ করো না কেন? তুমি কি নিজেকে দেবদাস প্রমাণ করতে চাচ্ছ?
আমি চুপ করে রইলাম। বাবা একটু থেমে আবার শুরু করলেন।
—চুল-দাড়ি রাখবা ভালো কথা। একটু সুন্দর করে রাখো। তোমার দুই হাত লম্বা চুল-দাড়ি নিশ্চয় দেখতে কারও ভালো লাগে না।
—হু।
—দাড়ি চুল লম্বা হয়েছে, সেটা তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তোমার মোচ লম্বা হতে হতে যে ঠোঁট ঢেকে ফেলে দাড়ির সঙ্গে মিশে গেছে, সেটা টের পেয়েছ? এখন কোনটা যে মোচ আর কোনটা যে দাড়ি, সেটাই বলা মুশকিল। তোমার যে ঠোঁট আছে, তা–ই তো বোঝা যাচ্ছে না। মোচের কারণে তুমি হাসলে বোঝা যায় না, তুমি হাসছো কি না। কারণ, মোচের কারণে তোমার দাঁতই দেখা যায় না।
—দাঁতসহ হাসি দেখতে চাও, সেটা বললেই তো হয়।
এ কথা বলে আমি বাম হাত দিয়ে মোচকে ওপরে তুলে ধরলাম। দাড়ি-মোচের ফাঁক দিয়ে আমার ঠোঁট বেড়িয়ে পড়ল। এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে দাঁত দেখিয়ে অদ্ভুত করে হাসলাম।
বাবা আমার মোচ সরিয়ে দাঁত দেখিয়ে এই অদ্ভুত হাসি দেখে একটু বিরক্ত হলেন মনে হলো। তিনি বিরক্তি লুকিয়ে বললেন,
—আচ্ছা তুমি এই মোচ ভেদ করে মুখ দিয়ে খাবার আর পানি কীভাবে খাও?
আমি কিছু না বলে উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিল থেকে একটা কলা আর এক গ্লাস পানি নিলাম। তারপর বাবার সামনে এসে আবার বসলাম। গ্লাসটি টি টেবিলের ওপর রেখে কলাটি ছিললাম। এরপর বাম হাত দিয়ে মোচগুলোকে ওপরে তুলে ধরে কলায় কামড় দিলাম। তারপর মোচ ছেড়ে দিয়ে চিবিয়ে কলা খেতে লাগলাম। কলার ওই অংশটুকু পেটে চালান দিয়ে পানির গ্লাস হাতে নিলাম। আবার বাম হাত দিয়ে মোচগুলোকে ওপরে তুলে ধরলাম। ঠোঁট দুটো বেরিয়ে এলো। তারপর গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেলাম। খেয়াল করে দেখলাম, বাবা বিস্ময়ে চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এরপর উনি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—এর মাথা তো পুরো গেছে। ও তো দিন দিন আরও বোকা হয়ে যাচ্ছে।
আমি তো বই হারানোর কথা এখন ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি আবার সেটা মনে করিয়ে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে দিলেন। যে পুরুষ একটা বইকে সামলে রাখতে পারে না। সে তার বউকে প্রোটেক্ট করবে কীভাবে?
মা কিছু না বলে বোকার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারণ, আমার খাদ্য পানি গ্রহণের এই অদ্ভুত স্টাইলে তিনিও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। আমি বাবাকে বললাম,
—বাবা শোনো, প্রেমে পড়লে ছেলেরা একটু আধটু বোকা হয়। এটা কোনো ব্যাপার না।
—এই তুই কোনটাকে প্রেমে বলছিস? জানা নেই শোনা নেই একটা মেয়ের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কথা বলেই প্রেম হয়ে গেল। ফাজলামি করোস।
—বাবা শোনো পৃথিবীতে দুই গ্রুপের মানুষ আছে। প্রথম গ্রুপের মানুষেরা ৪০-৫০ বছর একসঙ্গে থেকেও এক অপরের মনে ঢুকতে পারে না। প্রেম ভালোবাসা তো পরের কথা। আর দ্বিতীয় গ্রুপের মানুষেরা কয়েক ঘণ্টা একসঙ্গে থেকেই হাজার বছরের প্রেম করে ফেলে।
আমার কথা শেষ হতেই মা খুশিতে শিশুদের মতো হাত তালি দিয়ে উঠলেন। বাবা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
—বুঝলাম না তুমি ওর কথায় হাতে তালি দিলা কেন? তোমার হাতে তালি দেখে তো মনে হচ্ছে আমি প্রথম গ্রুপের মানুষ।
—আরে না। আমি হাতে তালি দিয়েছি আমার ছেলের মূল্যবান কথা শুনে। মাশা আল্লাহ, আমাদের ছেলে আস্তে আস্তে দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে।
—দার্শনিক নয়, বলো পাগল হয়ে যাচ্ছে।
—বাবা তুমি ১০ মিনিট চেয়েছিলে। আর মাত্র এক মিনিট আছে। তুমি দ্রুত তোমার কথা শেষ করো।
এ কথা বলে আমি দোতারা হাতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা এতক্ষণ আমার হাতের দোতারার দিকে খেয়াল করেননি। এবার তার চোখ পড়ল দোতারার দিকে। আমার হাতে দোতারা দেখে বাবার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। তিনি অবাক কণ্ঠে বললেন,
—এই তোর হাত এটা কি?
—এটা দোতারা। বাবা, তুমি দোতারা চিন না! আমাকে তুমি অবাক করলে।
—আমি ভালো করেই দোতারা চিনি। কিন্তু এটা তোর হাতে কেন?
—সারা দিন স্টেশনের সামনে স্থির হয়ে অপেক্ষা করি। খুবই বোরিং। ঠিক করেছি, মাঝেমধ্যে দোতারা বাজিয়ে গান গাইব। পথের মানুষদের একটু আনন্দ দেব। তাই এটা গতকাল কিনে ফেললাম। ভাবছি আর সপ্তাহখানেক দীপান্বিতার জন্য অপেক্ষা করব। যদি এর মধ্যে ওর সন্ধান না পাই, তাহলে দেশান্তরি হবো। দোতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে বাংলার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।
—ওই তুই গানের কী জানিস? সুর লয় তাল কিছু জানিস?
—না।
—তুই দোতারা বাজাতে জানিস?
—না, জানি না। যখনই বাজাই শুধু টুং টাং আওয়াজ হয়। কোনো গানের সঙ্গেই সেটা মিলে না। খুবই বিরক্তিকর। আমি ঠিক করেছি রাস্তায় রাস্তায় যখন গান গাইবো, তখন কোনো দুঃখের গান গাইব না। সব আনন্দের গান গাইব। ড্যান্সের গান গাইব। কারণ, মানুষের আনন্দ দরকার। আমি একটা গানও ঠিক করে ফেলেছি। ধিনকা চিকা ধিনকা চিকা হে হে হে ধিনকা চিকা ধিনকা চিকা হে হে ....
বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,
—তুমি আর কত দিন এই ভং ধরে থাকবা।
—বাবা এটা ভং নয়।
—এটা ভং।
—ওকে তুমি যখন বলছ, এটা ভং, তো এটা ভং। কারণ, তুমি আমার বাবা তোমার কথার তো একটা মূল্য আছে, তা–ই না?
—এখন উত্তর দাও এই ভং কত দিন চলবে?
—যত দিন দীপান্বিতাকে আমি পাব না, তত দিন।
এই কথা বলে আমি ঘড়ি দেখলাম। ১০ মিনিট শেষ। আমি আর কিছু না বলে দরজা খুলে বের হয়ে পড়লাম।
আগে তো বাসায় আমার একটা মাত্র শত্রু ছিল। এখন তো দেখছি বাবার সঙ্গে এই আরেকটা শত্রু যুক্ত হয়েছে। আমি শিওর এই দুই শত্রু কখনই আমার সুপ্ত প্রতিভাগুলোর বিকাশ ঘটতে দেবে না।
আজ আমি উত্তরা সেন্টার স্টেশনের সামনে আছি। ও একটা কথা বলা হয়নি, আমার বাসার ক্যালেন্ডারে আমি লিখে রেখেছি, কবে কোথায় থাকব। যাতে বাবা-মা প্রয়োজনে আমাকে সহজেই খুঁজে পান।
বেলা একটা বাজে। এটা আমার লাঞ্চের সময়। আমি ফুটপাতে বসে হাত দিয়ে মোচ সরিয়ে সরিয়ে কলা ব্রেড খাচ্ছি। এ সময় কেউ একজন আমার পাশে এসে বসলেন। আমি তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলাম না। তবে খেয়াল করলাম তাঁর শরীর থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিলাম। আমার পুরো মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। যদিও দাড়ি–মোচের কারণে তা বোঝা গেল না।
মিষ্টি রিনিঝিনি কণ্ঠে আগুন্তুক বলে উঠলেন,
—কিসমত সাহেব, আপনি কেমন আছেন?
আমি মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে বললাম,
—আপনি ভুল করছেন। আমার নাম কিসমত নয়। আমি শব্দ।
—আপনি দুনিয়ার সবার কাছে শব্দ হতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে আপনি কিসমত। আপনি কি আমার দিকে একটু তাকাবেন?
আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম সেই মায়াবী মুখ, সেই মায়াবী চোখ। আমি আনন্দে দোতারায় দুবার টুং টাং আওয়াজ করলাম।
দীপান্বিতা বললেন,
—কিসমত সাহেব আপনার লম্বা চুল-দাড়ি-মোচের কারণে আপনার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তাই বুঝতে পারছি না, আপনি এত দিন পর আমাকে দেখে খুশি হলেন নাকি বিরক্ত হলেন।
দীপান্বিতার কথা শেষ হতেই আমি আমার হাতের কবজিতে লাগানো রাবার ব্যান্ড দিয়ে মাথার চুলগুলো ঝুঁটি করলাম। তারপর বাম হাত দিয়ে মোচগুলোকে ওপরে তুলে ধরে দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলাম। আমার মোচ তুলে দাঁত দেখিয়ে হাসার দৃশ্য দেখে দীপান্বিতা হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল,
—আজ সকালে আপনি এভাবে আপনার বাবাকে মোচ তুলে হেসে দেখিয়েছেন, তা–ই না?
—হু।
—সেই কারণে উনি সকালে আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি আজই ওই গাধার সঙ্গে দেখা করবে। আমি বললাম, আংকেল হঠাৎ কী হলো? কোনো সমস্যা? উনি রেগে গিয়ে বললেন,
‘হারামজাদা আজ আমার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মোচ তুলে দাঁত বের করে হাসল। আমার জীবনে আমি এ রকম ফালতু হাসি আর কাউকে হাসতে দেখিনি। আমার ধারণা ও দ্রুত পাগল হয়ে যাচ্ছে।’
—আমার ওই হাসি দেখে বাবার যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি, তখনই বুঝতে পেরেছি আজ আপনি আমার কাছে আসবেন।
দীপান্বিতা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
—আপনি বুঝতে পেরেছিলেন আপনার বাবা আমার ঠিকানা ফোন নম্বর জানেন?
—শুনুন আমার বাবা পৃথিবীর প্রথম সারির একজন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বললেন, আপনার বাবা-মা-ভাই এর খবর নিলেন। আপনি টিউশনি করে অনেক সংগ্রাম করে সংসারটাকে টেনে নিচ্ছেন তা জানলেন। আপনাকে তার অফিসে উচ্চপদে চাকরি দেবেন, সে সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ আপনার ঠিকানা বা ফোন নম্বর উনি নেবেন না। এটা বিশ্বাস করার মতো বোকা তো আমি নই। আমার বাবার রক্তই তো আমার শরীরে তা–ই না? তবে গত সাত মাস মায়ের জন্য কষ্ট লেগেছে। কারণ, বেচারি ধরেই নিয়েছেন আপনাকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি।
একটু বলে আমি দীপান্বিতার দিকে তাকালাম। দেখলাম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি দীপান্বিতাকে আরও অবাক করে বললাম,
—বাবা না বললেও আমি এও জানি, আপনি এখন আমার চেয়ার দখল করে বাবার ব্যবসা অফিস সামাল দিচ্ছেন।
—সবই যখন জানেন, তখন গত সাত মাস এমন সব কাণ্ড কেন করলেন? আপনি তো অফিসে গেলেই আমার দেখা পেতেন।
—এটা আপনি বুঝবেন না। এটা আমাদের বাবা-ছেলের এক মজার যুদ্ধ। আমি চেয়েছি বাবা নিজে থেকেই আপনাকে আমার সামনে নিয়ে আসুক। এবং উনি তাই করেছেন। আমি জানি বাবাই আজ আপনাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছেন। কি ঠিক বলিনি?
—বইমেলায় আপনার মা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। সেই কথাটি এখন মনে হচ্ছে।
—কোন কথাটি বলুন তো?
—ওই যে উনি বলেছিলেন, ‘তোমারও বাকি জীবন আমার মতো এদের বাবা-ছেলের ঝগড়া মেটাতে মেটাতে চলে যাবে।’
বলেই দীপান্বিতা হাসতে লাগল। আমিও হাত দিয়ে মোচ ওপরে তুলে দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেখে দীপান্বিতা বলল,
—আপনার এই বিশ্রী হাসি আর হাসবেন না। আগে সেভ করবেন, তারপর হাসবেন। আর কাল থেকে অফিস যাবেন।
—আমি আর অফিস গিয়ে কি করব? আমার চেয়ার তো অলরেডি আপনার দখলে। আর তা ছাড়া আমি ইংলিশে বরাবরই কাঁচা। যার কারণে আমি বিদেশি বায়ার সামাল দিতে পারি না। আপনি ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ওই চেয়ারে আপনিই ফিট।
—সমস্যা নাই। আমরা দুজনে মিলেই অফিস চালাব। বাবার কাছে শুনেছি আপনি অফিসে যেয়ে কাজ না করে ঘুমাতেন। সেজন্য ঐ রুমে আমি একটা ছোট্ট বেডের ব্যবস্থা করেছি। আমরা একসঙ্গে অফিস যাব। আপনি ওখানে সারাদিন ঘুমাবেন। আর আমি অফিসের কাজ করব। যখন কোনো সমস্যায় পড়ব, তখন আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে পরামর্শ নেব।
আমরা একটা রিকশা নিলাম। দীপান্বিতা বলেছে সামনের কোন একটা সেলুনে গিয়ে এখনই চুল-দাড়ি-মোচ সব সাইজ করতে হবে। আমরা এখন রিকশা করে সেলুনে যাচ্ছি। রিকশায় বসে বললাম,
—দীপান্বিতা আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?
—উহু। বিয়ের পর।
—ওকে সমস্যা নাই। আমরা কি এখন একে অপরকে তুমি করে বলতে পারি?
—উহু। বিয়ের পর।
—ওকে সমস্যা নাই। একটা প্রশ্ন করতে পারি?
—উহু। বিয়ের পর।
বলেই দীপান্বিতা হি হি হি করে হাসতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল,
—প্রশ্নটা বিয়ের আগেই করতে পারেন। করুন আপনার প্রশ্ন।
—আচ্ছা আমি যে বইটা হারিয়ে ফেলেছি, ওখানে ফোন নম্বর ছাড়া কি আর কিছু লিখেছিলেন? মানে ভালোবাসার কোনো লাইন?
একথা বলা মাত্রই দীপান্বিতা রিক্সাওয়ালা মামাকে রিকশা থামাতে বলল। রিকশা থামতেই ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম,
—এটা কি হলো?
—আমি তো বই হারানোর কথা এখন ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি আবার সেটা মনে করিয়ে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে দিলেন। যে পুরুষ একটা বইকে সামলে রাখতে পারে না। সে তার বউকে প্রোটেক্ট করবে কীভাবে?
—সরি।
—শুনুন, সরি বললেই সব শেষ হয়ে যায় না। বই হারানোর শাস্তি হিসেবে আপনি এখন সেলুন পর্যন্ত রিকশা পাশে পাশে দৌড়াবেন। আপাতত এটাই শাস্তি। বাকিটা বিয়ের পর।
আমি দীপান্বিতার কথা শুনে আবার বাম হাত দিয়ে মোচ তুলে দাঁত বের করে হাসতে গিয়েছিলাম। ওটা দেখেই চিৎকার করো বলল,
—আপনি যদি আরেকবার ওই বিচ্ছিরি পচা মার্কা হাসি হাসছেন, তাহলে কসম আমি আপনারে বিয়ে করব না।
আমি একথা শুনে ভয়ে মোচ ছেড়ে দিলাম। আমার ওই লম্বা মোচে আবারও আমার ঠোঁট ঢেকে গেল। দীপান্বিতা মামাকে রিকশা চালাতে বললেন। রিকশা চলতে শুরু করল। আমি রিকশার পাশে পাশে ধীরে ধীরে দৌড়াতে লাগলাম। আর দোতারায় টুং টাং আওয়াজ করতে করতে গান ধরলাম, ধিনকা চিকা ধিনকা চিকা হে হে হে.....সঙ্গে সঙ্গে দীপান্বিতা ঘাড় ঘুরিয়ে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর চিৎকার করে বলল,
—ওই ফালতু, তুই কি আমারে বিয়ে করতে চাস? তাহলে এখনই গান থামা বলছি।
মাইগড এই মেয়ে তো দেখি রেগে গেলে বাবার মতো, তুই তুকারি করে। আমি ভয়ে গান থামিয়ে দিলাম।
শালা, আগে তো বাসায় আমার একটা মাত্র শত্রু ছিল। এখন তো দেখছি বাবার সঙ্গে এই আরেকটা শত্রু যুক্ত হয়েছে। আমি শিওর এই দুই শত্রু কখনই আমার সুপ্ত প্রতিভাগুলোর বিকাশ ঘটতে দেবে না। শেষ...
*ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]