নতুন বাংলাদেশে প্রবাসীদের আন্দোলনের আদ্যোপান্ত
ছুটি শেষ করে দুই সপ্তাহ হলো জার্মানিতে ফিরেছি। দেশ থেকে আসার সময় কোটা আন্দোলনের কিছুটা খবর জানতাম, তবে ব্যস্ততার কারণে পুরোপুরি আপডেটেড ছিলাম না। গত ১৬ জুলাই হঠাৎ করেই একটি গ্রুপে যুক্ত হলাম—‘কোটা আন্দোলন-হামবুর্গ’। গ্রুপে আলোচনা চলছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা হচ্ছে, আমাদেরও প্রতিবাদে শামিল হতে হবে। আলোচনা গড়াল এবং টিভি ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ল রংপুরে আবু সাঈদকে গুলি করার দৃশ্য। জার্মানির হামবুর্গ ছাড়াও অন্য শহর এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ল, শুরু হলো প্রবাসীদের প্রতিবাদ।
১৭ জুলাই জার্মান পুলিশের অনুমতি নিয়ে ১৮ জুলাই আমরা প্রতিবাদ সমাবেশে দাঁড়ালাম। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই মরল কেন, জবাব চাই দিতে হবে’—এমন স্লোগানে হামবুর্গের রাস্তায় প্রতিবাদী হয়ে উঠল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। হামবুর্গ থেকে শুরু করে বার্লিন, মিউনিখ, কোলন—সব শহরেই চলছে প্রতিবাদ। প্রবাসীদের এ ক্ষোভ শুধু জার্মানি নয়, ছড়িয়ে পড়ল প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ততক্ষণে দেশে আরও অনেক প্রাণ ঝরেছে। মুগ্ধ পানির বোতল দিতে গিয়ে জীবন দিল, আরও কতশত ছাত্র রক্ত দিল, জানা নেই।
ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেওয়ার পর কারফিউ দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। দেশে বর্বর হামলার নানা ভিডিও আসতে শুরু করল। এসব ভিডিও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অশ্রুসিক্ত করল। স্বদেশের সাধারণ জনগণের জন্য কিংবা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়রদের জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপ মানুষের চোখে–মুখে। তখন একদিকে রাগ, আরেক দিকে অসহায়ত্ব।
১৮ ও ১৯ জুলাই আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে জার্মানির সব শহরের প্রায় ১০০+ প্রবাসী বৈঠক করল। সেই সঙ্গে আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ‘গ্লোবাল কল’ নামে কয়েকটি গ্রুপ খোলা হলো এবং বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের সমন্বয়ে কয়েক দফা মিটিং হলো। মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি টিম খবর ও ভিডিওগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে পাঠাতে লাগল, আরেকটি গ্রুপ মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে ই–মেইল করতে শুরু করল। আরও একটি টিম গঠন করা হলো, ‘রেমিট্যান্স না পাঠালে কী হবে’ বিশ্লেষণ করতে। কোথাও কোথাও বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রতিবাদ করা হচ্ছে। প্রথম দফার কাজ অনেকটা সফল হলো, পৃথিবীর সব বড় বড় নিউজ চ্যানেল ও পত্রিকা বাংলাদেশ ইস্যুকে লিড নিউজ করা শুরু করল এবং জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে বিবৃতি আসতে শুরু করল, যা তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করল।
এর মধ্যে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স না পাঠানোর ক্যাম্পেইন শুরু করল। এ ক্যাম্পেইন খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেল। এর মধ্যে ছয় দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা আরও ক্ষুব্ধ হলো। অনেক প্রবাসী আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও ধীরে ধীরে এ প্রতিবাদে যোগ দিল। একসময় যখন দেশে ৯ দফা আন্দোলন চলছে, তখন প্রবাসীদের মধ্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা শুরু হয়ে গেল।
ঘটনাপ্রবাহে আমার মনে হয়, আমার মতো হাজারো বাংলাদেশি পড়াশোনা, চাকরি, সামাজিক অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে শুধু খবর ও ফেসবুকের কার্যক্রম ফলো করছিল। ২-৪ আগস্ট ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ সবাই নেমে পড়ল। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারও নিজ দলের বাহিনীকে আবার মাঠে নামাল। তখন প্রবাসীরা অনেক দুশ্চিন্তায় ছিল, যদি আরও লাশ পড়ে? তবে আওয়ামী লীগের বাহিনীকে ছাত্ররা যেভাবে পরাজিত করল, তাতে শেখ হাসিনার পতন ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। ৪ তারিখ রাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেক আতঙ্কে ছিল, ৫ আগস্ট আরও ছাত্রদের প্রাণহানি হতে পারে। সেদিন রাতের একটি মিটিংয়ে প্রবাসীদের প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল, কীভাবে আহত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো যাবে, ফান্ড গঠনসহ রেড ক্রিসেন্ট কিংবা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্য নেওয়া হবে।
৫ আগস্ট সকালে মহা আতঙ্কের মেঘ কাটতে শুরু করল, আর খবর আসতে লাগল লাখো ছাত্র-জনতা গণভবনের দিকে রওনা দিয়েছে। এরই মধ্য খবর এল, সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে বক্তব্যের ঘোষণা দিলেন আর দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তীব্র ক্ষমতাধর এক রাষ্ট্রপ্রধান। উদিত হলো বাংলাদেশের নতুন সূর্য। দেশে দেশে বাঙালিরা মিলিত হলো বিজয় মিছিলে। এ এক অনাবিল আনন্দ, নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার আনন্দ।
দেশের প্রয়োজনে প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্সযোদ্ধা’ বলা হলেও, প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর বহু বছর ধরেই ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের খুব উপকারে আসে বা এসেছে, এমন কিছু চোখে পড়েছে কম। দেখা যায় না অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বা অংশীদারত্ব তৈরির পর্যাপ্ত কার্যক্রমও।
পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে কোনো কাজে পর্যাপ্ত সহযোগিতা নেই। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের প্রবাসী ভাইদের জন্য নেই বিশেষ ব্যবস্থা। দেশীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমানে প্রবাসীরা ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক হলেও টিকিটের মূল্য থাকে সব সময় বেশি, তবু দুর্নীতির কারণে এই বিমান লোকসানে। দেশে গেলে বিমানবন্দরে দেখা যায় চরম অব্যবস্থাপনা। দেশের একটি গুণগত পরিবর্তন দেশের মানুষের পাশাপাশি প্রবাসীদেরও দাবি। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি দলীয় শিক্ষকরাজনীতিও নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে অনেকে।
এ আন্দোলনে প্রবাসীদের কিছু ত্যাগ আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ জন দণ্ডিত হয়েছে। এমনকি প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী কর্মীরা প্রতিনিয়ত হুমকিও দিয়েছে। তবে নতুন বাংলাদেশের জন্য বুক পেতে দিয়ে সাঈদ-মুগ্ধদের আত্মত্যাগ কিংবা ছয় বছরের রিয়ার আত্মত্যাগের কাছে প্রবাসীদের আত্মত্যাগ যৎসামান্যই।
৫ আগস্টের পর থেকে এখনো দেশে দেশে চলছে বিজয় উদ্যাপন। এ বিজয়ের অনুভূতি দেহে মাখিয়ে আমি বহুদিন বেঁচে থাকতে পারব, বেঁচে থাকবে দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি। নতুন বাংলাদেশের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
লেখক: রবিউল এইচ চৌধুরী, হামবুর্গ, জার্মানি
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]