পাঠশালার আসরে ‘বাংলাদেশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গ্রাফিতি’
টরন্টোভিত্তিক শিল্পসাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৭তম ভার্চ্যুয়াল আসরটি ১৬ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। এ আসর একই সঙ্গে ছিল পাঠশালার সপ্তম বর্ষপূর্তি আসরও। এবারের আলোচক ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমে গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পোস্টারশিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী ও লেখক সুহান রিজওয়ান।
ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব ও রক্তক্ষয়ী গণ–অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে ৫ আগস্ট ২০২৪। ভিন্নমত দমন, অদৃশ্য ভয় আর স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল দেয়াল, সমতল থেকে পাহাড়, সর্বত্র। আন্দোলনে প্রবলভাবে শামিল হয়েছিল পুরো দেশের দেয়ালজুড়ে আঁকা গ্রাফিতি। বহুদিনের অনুচ্চারিত ক্ষোভ যেমন ভাষা পেয়েছে, তেমনি গ্রাফিতিসহ পোস্টার, র্যাপ ইত্যাদি আন্দোলনের একরকম নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে।
এবারের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা ২০২২ সালে প্রকাশিত সুহান রিজওয়ানের লেখা ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ নামের ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসটিতে দেখা যায় ভবিষ্যতের কল্পিত বাংলাদেশের কথা, যেখানকার বিদ্যমান স্বৈরশাসনে ভিন্নমতের জায়গা নেই, আছে দমনমূলক আইন ও পীড়ন। সেই দমবন্ধ করা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেও অজ্ঞাতপরিচয় এক শিল্পী দেয়ালে দেয়ালে এঁকে চলেন নিষিদ্ধ গ্রাফিতি। একসময় দীর্ঘদিন জেঁকে বসা প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের পতন ঘটে ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে।
পাঠশালার এবারের আসরে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম অনুসঙ্গ গ্রাফিতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মাত্রাসহ আরও নানা অনুসঙ্গের সংলগ্নতার কথা ও সমকালের গণচৈতন্য ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ উপন্যাসে রূপ পাওয়ার কথা তুলে ধরেন আলোচক সুহান রিজওয়ান ও দেবাশিস চক্রবর্তী।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গ্রাফিতি প্রসঙ্গে দেবাশিস বলেন, ‘আমরা এই নভেম্বরে এসে গ্রাফিতিগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখব, পুরো আন্দোলনের সময় জ্ঞানে ও অজ্ঞানে বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠী যা কল্পনা করছিল, যে আকাঙ্ক্ষা তার ভেতর জমা হচ্ছিল, সেগুলো লিপিবদ্ধ অবস্থায় আছে দেয়ালে। গ্রাফিতি একটা পশ্চিমা পরিভাষা। গ্রাফিতি কেমন হয়, সেই ধারণাও পশ্চিমা। কিন্তু পশ্চিমে এর চর্চা শুরু হলেও সংগত কারণেই সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষ গ্রাফিতিকে তাদের মতো করে আত্মীকৃত করে নিয়েছে, ব্যবহার করেছে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়াসহ অনেক জায়গায়ই গ্রাফিতির ব্যবহার হয় এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কেন্দ্রস্থলগুলোতেও মানুষ তাদের প্রয়োজনে গ্রাফিতি ব্যবহার করে। আর শব্দগতভাবে গ্রাফিতি এসেছে ইতালীয় শব্দ থেকে, যার গ্রিক উৎস থাকলেও থাকতে পারে। গ্রাফিতি কোনো নান্দনিকতার প্রশ্ন নয়, এটা রাজনৈতিক এবং “এ কোশ্চেন অব সারভাইভ্যাল” বা প্রতিরোধের প্রশ্ন, যা মানুষ এঁকেও করতে পারে বা লিখেও করতে পারে। সেটার অবস্থান হতে হবে পাবলিক পরিসরে, ঘরের ভেতরের দেয়ালে নয়, যেখানে সংঘবদ্ধ অবস্থায় সামষ্টিকভাবে মানুষ দেখতে পাবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ নজিরবিহীন নিপীড়নের ভেতর ছিল গত অন্তত ১২ বছর। একটা ভয়ের সংস্কৃতি চেপে বসে মানুষকে অসাড় করে রেখেছিল। জনগোষ্ঠীর ভেতরের সক্রিয় সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিপীড়িত অবস্থায় চুপচাপ ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জুলাইয়ের ১৬ তারিখ নাগাদ আসা কিছু উচ্চারণ এবং আগে থেকে পরিকল্পিত নয়, এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ চুরি করে লুটপাট, খুন আর গুমের রাজত্ব কায়েম করা স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ধস নামতে শুরু করে। সেই মুহূর্ত থেকে খেয়াল করলে দেখব আমাদের দেয়ালগুলোতে যেই কথাগুলো আসছে, সেগুলো আবেগের, একই সঙ্গে চিন্তারও। সামষ্টিকভাবে আমরা কী চিন্তা করছি, কী আকাঙ্ক্ষা, আমরা এই নিপীড়কের বাইরে কী চাই, কী কল্পনা করি, কেমন রাষ্ট্র চাই, সব দেয়ালে লিপিবদ্ধ আছে। এটা আসলে সিভিল ইমাজিনেশন। বুঝে না-বুঝে। আমরা কীভাবে শাসিত হব এবং যারা আমাদের শাসন করবে, তাদের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, সব দেয়ালে লিখেছে মানুষ। এসব একেবারেই আগে থেকে বুদ্ধি করে লেখা নয়। প্রতি মুহূর্তে তারা আবিষ্কার করেছে। এর চেয়ে অর্গানিকভাবে আর হওয়া সম্ভব নয়। আর আমরা সবাই জানি যে আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন তো ছিলই, কিন্তু তার বাইরে সাধারণ মানুষেরা এই ছবি আঁকতে আঁকতে, লিখতে লিখতে তাদের সামনের পরাক্রমশালী দানবের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করেছে। বলে রাখা দরকার, শক্তি সঞ্চয়ের একটা মূল জায়গা কিন্তু মিছিলে।’
দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘গ্রাফিতিগুলোর কথা খেয়াল করলে দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেই কথাগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, কাজী নজরুল ইসলাম যেই কথা ব্যবহার করেছেন, জহির রায়হান যেই কথা ব্যবহার করেছেন, সেগুলো আমরা আবার ব্যবহার করেছি। ২৪ একা নয়, ৫২-৬২-৬৯-৭১সহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আমাদের যেই লড়াকু ঐতিহ্য এবং যে অভিজ্ঞতা জ্ঞানে ও অজ্ঞানে জমা হয়েছিল, আমাদের প্রজন্মগুলোর ভেতর, তার বাঁধ খুলে গেছে। এর লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রাফিতিগুলোতে।’
‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ উপন্যাসে গ্রাফিতির অনুপ্রেরণা নিয়ে সুহান রিজওয়ান বলেন, ‘এদুয়ার্দো গালিয়ানোর ভাষ্য “দেয়াল হচ্ছে শোষিত মানুষের প্রকাশক।” ওদিকে ২০১৬-১৭ সালের দিক থেকে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে অজ্ঞাতনামা শিল্পীর আঁকা সুবোধের গ্রাফিতিকে ঘিরে অন্য অনেকের মতো তাঁর মনেও আলোড়ন ওঠে। এই দুই মিলে গ্রাফিতির অর্থ ধরা দেয় এমনভাবে, এটি এমন ধরনের দেয়ালচিত্র, যা আমাদের মনে অস্বস্তির জন্ম দেয়, যা কোনো অপ্রাপ্তি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং সর্বোপরি গ্রাফিতি শব্দটা সেন্সরশিপের যে বোধ তৈরি করে, “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” সেই ভাবনাটার সঙ্গে বোঝাপড়া।’
‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুহান বলেন, ‘২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর আত্মপ্রকাশ এবং একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজীব্য করে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘পদতলে চমকায় মাটি’ প্রকাশের সময় মানুষের মতপ্রকাশে ভয়ের ব্যাপারটা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা, আর সেই সঙ্গে সেন্সরশিপকে তিনি লেখার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। সুহান বলেন, “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে”র দুটি ভরকেন্দ্র। প্রথমটা হচ্ছে সেন্সরশিপের অধীন লেখক-শিল্পীর শৈল্পিক দ্বিধা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে কর্তৃপক্ষের আরোপিত সেন্সরশিপ কীভাবে একটা সমাজের শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করে। উপন্যাসে দেখা যায়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের ক্ষমতাকাঠামো সেখানে বিদ্যমান। উপন্যাসের একটা পর্যায়ে এই ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ করে, রাজপথে নামে, মিছিলে পুলিশের গুলি চলে, পুলিশ রাস্তায় নামে। এরপর যা ঘটে, তার অনেকটুকুই আমরা দেখেছি ২০২৪ সালে।
‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ উপন্যাস নিয়ে দেবাশিস বলেন, ‘সুহান রিজওয়ান ২০২২ সালে “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাস লিখেছেন, একটা স্বৈরাচারী সরকার গেঁড়ে বসে থাকা অবস্থাতেও। তখন কারও কল্পনায় ছিল না আমরা কীভাবে মুক্তি পাব বা আদৌ কি আমাদের সামনে মুক্তির সম্ভাবনা আছে কি না। ঠিক এই রকম সময়ে একজন শিল্পী-লেখকের ভেতর সমাজের ঘটনাগুলো জমা হয়, অজ্ঞানে জমা হয় এবং সেটা তাঁকে কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ করতে হয়।’ ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’তে একজন লেখক একটা পরাক্রমশালী ক্ষমতাকাঠামো ও স্বৈরাচারের পতন কল্পনা করেছেন বাংলাদেশে বসে ২০২২ সালে। সমাজে এই বাস্তবতা না থাকলে তিনি লিখতেন না। এই গণ–অভ্যুত্থানের উপযোগিতা নিয়ে এখন যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, শৈল্পিক দিক থেকে এটার একটা মোক্ষম জবাব সুহান রিজওয়ানের এই উপন্যাস। এই লেখককে বিতর্কিত করার কিংবা খারিজ করারও সুযোগ নেই। আমাদের সমাজে আগে থেকেই গণ–অভ্যুত্থানের কল্পনা হাজির ছিল। সাপ্রেসড অবস্থায়, অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়, কিন্তু ছিল। ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ একটা শৈল্পিক উদাহরণ, এ ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক নানা আয়োজনেও অভ্যুত্থান–সম্পর্কিত শব্দগুলো জারি ছিল। কিন্তু কেন? গণ–অভ্যুত্থান তো কোনো ছেলেখেলা নয়। এখানে জীবন দানের ব্যাপার ছিল। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিচ্ছেন এবং যাঁরা ওই মুহূর্তে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে জানতেন, তাঁরা বৈষয়িকভাবে ও প্রাণের সংশয়ে আছেন। এই বিষয় আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। এবারের গণ–অভ্যুত্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ? রাজনৈতিকতা ও গণতান্ত্রিকতা এবং ক্ষমতা হস্তান্তরবিষয়ক প্রাথমিক ধারণা থাকলেই বোঝা যায় যে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল নিজেরাই। এই রকম একটা মুহূর্তে জনগোষ্ঠীর নিজের দায়িত্বে ক্ষমতার পালাবদল করা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না।
দেবাশিস বলেন, ‘“গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাসে আমরা ঋজুশির নামে এক শিল্পী চরিত্র পাই, যে প্রচণ্ড ভয়ের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন–পীড়নে যেখানে মানুষের মাথা পর্যন্ত চলে যায়, এমন প্রযুক্তির উপস্থিতিতে যখন কেউ কিছু বলতে পারছে না, এমন সময় গ্রাফিতির মাধ্যমে কিছু ভিজ্যুয়াল কল্পনা হাজির করেন। সেই কল্পনাগুলো কোনো অর্থেই অতিবিপ্লবী নয়। খুব সাধারণ কথা বলে, মুক্তির কথা বলে সেসব কল্পনা। সে ভয়ের রাজত্বের ভেতরে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়। ওখানে তখন একটা ঘটনা ঘটে। গ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা নিম্নবিত্তের এক ছাত্র খুন হন। এর প্রতিবাদে শাহবাগে ছেলের বাবা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। সে আগুন রূপকার্থে আর আগুন থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে তা বাস্তবের জমিনে। মানুষ পথে নেমে আসেন এবং তাঁরা লড়াই-সংগ্রাম করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কের বাসা পর্যন্ত গিয়ে আক্রমণ করে তাঁর পতন ঘটান। এটাই ক্ল্যাসিক গণ–অভ্যুত্থান এবং এটাই আমরা হতে দেখেছি ২০২৪-এ।’
মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিতি ও সাহিত্য সম্পর্কে সুহান বলেন, প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের নিজস্ব একটা গতি থাকে। গ্রাফিতির ব্যবহারটা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। আর এই জিনিস শিল্পের পক্ষে উৎপাদন করা সম্ভব কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে গ্রাফিতি যেই অভিঘাত তৈরি করে, সাহিত্য যদি লেখালেখিতে সৎ হয়, সময় সময় কোনো সাহিত্যও, যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’–এর একটা দৃশ্যের বর্ণনা একই রকম অভিঘাত তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ মাধ্যম হিসেবে একদম ভিন্ন হলেও গ্রাফিতি ও কোনো সাহিত্যের অভিঘাত সমতূল্য হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা’ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা, অন্যতম স্পিরিট, যার প্রতিফলন আমরা দেখেছি গ্রাফিতিতে, কিন্তু এর কতটা দেখছি গণ–অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে এ প্রসঙ্গে দেবাশিস বলেন, বোঝাই যাচ্ছে যে অভ্যুত্থান–পরবর্তী কিছু নাশকতা এবং বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার কারণে উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে মানুষের ভেতর। এটা খুব স্বাভাবিক। একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে যে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় বিরল একটা ঘটনা ঘটে। পুলিশি আউটপোস্ট থানা এসব খালি হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এবং ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কোনো কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ঘটনা তখন ঘটেছে, আমরা চাই আর না চাই। যে ঘটনাগুলোর তদন্ত করে বিচার করা উচিত। তবে পরিস্থিতি আরও অনেক খারাপ হতে পারত। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেল? সেনাবাহিনী ছিল কিছু জায়গায়। এর মধ্যে শুরুর দিকে ছিল ডাকাতি, তারপর আরও অনেক ঘটনা। বিভিন্ন পাড়া–মহল্লায় বাংলাদেশের মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে এগুলো প্রতিরোধ করতে হয়েছে। অন্তর্ভুক্তি নাহলে এ ধরনের প্রতিরোধ মানুষ একসঙ্গে করতে পারত না। এটাই গণ–অভ্যুত্থানের নগদ প্রাপ্তি। কিন্তু বাংলাদেশ সমাজে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আগে থেকেই বৈষম্য আছে। এটা এই আন্দোলনের ফলে নতুন করে তৈরি হওয়ার বিষয় নয়।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গ্রাফিতিসহ অন্য অনুসঙ্গ যেমন পোস্টার, রাজনৈতিক কার্টুন, র্যাপ ইত্যাদির সংলগ্নতা নিয়ে দেবাশিস বলেন, ‘আমরা পুরো ঘটনাকে গণ–অভ্যুত্থান বলতে পারছি কারণ, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশা, বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ধর্মের, জাতির যতভাবে পারা যায়, বিভিন্ন পার্থক্যসমেত মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, প্রাণ দেওয়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা খেয়াল করে দেখব, এত খুন, এত নিপীড়ন, চোখের সামনে দেখতে পেয়ে অনেকের সামনে বাস্তবতা অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যায়, দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করে। সে সময় অনেক শিল্পী নিজস্ব মাধ্যমে কাজ করেছেন। গণ–অভ্যুত্থান চলমান থাকায় অনেক শিল্পীর পক্ষে শিল্পমাধ্যম এবং ফর্মের সীমাবদ্ধতা থেকেই কাজ করতে হয়েছে। যেমন চাইলেই একটা উপন্যাস লিখে সেই সময় প্রকাশ করে দেওয়া যায় না কিংবা একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায় না। যে ফর্মগুলো ওই রকম সময়ে তাৎক্ষণিক উপায়ে বিলিবণ্টন করা গেছে, সেসব মাধ্যমের শিল্পীরা তাই করেছেন। আমরা অনেক শিল্পীকে দেখেছি কাজ করতে। তাঁরা তরুণ বয়সী। সবাইকে দরকারও নেই সব সময়। সময় তার নিজস্ব চরিত্র তৈরি করে নেয়, এবারও নিয়েছে। নতুন ভাষা হয়েছে, কি হয়নি; সেটা নান্দনিক প্রশ্নের জায়গা। আমরা যখন ফুরসত পাব, তখন হয়তো সেসবের আঙ্গিক, কনশাস-আনকনশাস দিক খুঁজে দেখতে পারব, চিহ্নায়ন করতে পারব। গণ–অভ্যুত্থানের শিল্প নিয়ে আলোচনা করা, শিল্পে ধরে রাখা সেই সময়ের অনুভূতির পুনর্মঞ্চায়ন করা জরুরি। কারণ, গণ–অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি এখন আর নেই, কিন্তু আকাঙ্ক্ষাগুলো রয়ে গেছে। অনেক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি, হয়তো ভবিষ্যতে হবে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো জারি রাখতে হবে।
আলোচক দেবাশিস-সুহানের সাবলীল আলোচনা ও এর ফাঁকে ফাঁকে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি-পোস্টার-রাজনৈতিক কার্টুনের স্থিরচিত্র প্রদর্শন দর্শক-শ্রোতা উপভোগ করেন ও মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণ করে ও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা জাগরূক রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করে সমাপ্তি টানা হয় পাঠশালার ৪৭তম আসরের। আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।