দূর পরবাসে
দেশ থেকে আসার পর প্রথম দেশে ফিরে গিয়েছিলাম প্রায় সাত বছর পর। বিভিন্ন কারণে এর মধ্যে দেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ব্যাপারটা এমন না যে আমি এর মধ্যে দেশকে, দেশের মানুষকে অনুভব করিনি। প্রবাসজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমি দেশকে অনুভব করেছি। প্রবাসের সবকিছুর মধ্যেই আমি দেশের ছায়া খুঁজে পেতাম; এখনো পাই। প্রবাসের সামাজিকতা, আচার–আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা সবকিছু আমি করতে শুরু করলাম দেশের মতো করে। এমনকি আমি আমার সন্তানদের লালন–পালন শুরু করলাম একেবারে দেশি কায়দায়। নিজের দুরন্ত শৈশবের পুনর্নির্মাণ শুরু করলাম ওদের শৈশবের মধ্যে। নিজের শৈশবের অকৃত্রিমতার কিছুটা হলেও ছাপ রাখতে চেষ্টা করলাম ওদের শৈশবের মধ্যে। আমার কাজকর্ম দেখে দেশের বন্ধুরা বলে, তুই যেখানে যাস, সেখানেই তুই তোর গ্রামকে তৈরি করে নিস। এখনো এভাবেই চলছে।
মায়ের কোল কুষ্টিয়া ছেড়ে প্রথম বাড়ির বাইরে এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। রাজধানী ঢাকায় এসে কুষ্টিয়ার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় মেলামেশা করতাম। বুয়েটের দম বন্ধ করা পরিবেশে আমি সামান্যতেই হাঁপিয়ে উঠতাম। আমার মনে হতো, কেউ যেন আমাকে কলেজ পাস করার পর বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। যেমন পড়ার চাপ তেমন স্যারদের চোখরাঙানি।
অবশ্য পরবর্তী জীবনে এটাই আমাদের শাপেবর হয়েছে। বুয়েট থেকে পাস করার পর আমরা দেশের এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছি। কোনো প্রতিকূলতা আমাদের কখনো আটকে রাখতে পারে না। কারণ, বুয়েটের সেই দমবন্ধ পরিবেশে আমরা টিকে গিয়েছিলাম। আমরা এখন তাই আর আমাদের স্যারদের ওপর রাগ করি না, বরং তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিই।
বুয়েটের দমবন্ধ পরিবেশে আমার দম নেওয়ার জায়গাটা ছিল আবাসিক হলের পরিবেশ। ক্লাস হওয়ার সময়টুকু ছাড়া আমি সারাক্ষণই হলে থাকতাম। ড. এম এ রশীদ হলে দুটো উইং আছে। একটা শ ব্লক অন্যটা হাজার ব্লক। আর প্রতিটি তলায় সিঁড়ির দুই পাশে ৬টা করে মোট ১২টা কক্ষ। আর দুই প্রান্তে ছিল দুটো গোসলখানা কাম প্রসাধনের কক্ষ। আমরা এই বাথরুম কেন্দ্র করে সিঁড়ির দুই পাশে নিজেদের মধ্যে একটা একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কক্ষ নম্বর ছিল ২০২। সে হিসেবে আমাদের বাথরুমের নম্বর হয় ২০০। আমরা সবাই নিজেদের পরিচয় দিতাম ২০০ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা হিসেবে। বয়সে ছোট–বড়নির্বিশেষে আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। আমরা সবাই সবার সুবিধা–অসুবিধার খোঁজখবর রাখতাম। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম। হলে থাকতে এসে আমরা সবাই একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হলের ছোট–বড় সবাই আমাদের আপনার চেয়ে আপনজন হয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনের এখন পর্যন্ত যৎসামান্য যে অর্জন, তার পুরোটার কৃতিত্ব হলের ছাত্রদের।
দূর পরবাসে আসার প্রেরণাও পেয়েছিলাম হলের বড় ভাই এবং বন্ধুদের কাছ থেকে। এরপর সিপিডি (কম্পিটেন্সি ডেমোনেস্ট্রেশন রিপোর্ট) বানানো থেকে শুরু করে সবকিছুতে ছিল হলের ছাত্রদের সরব উপস্থিতি। জীবনে কোনো পরীক্ষার জন্যই কোচিং না করা আমি আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লালমাটিয়ার সেন্ট জনস কোচিংয়ে ভর্তি হলাম হলের পাশের কক্ষের বড় ভাই মামুন ভাইয়ের সঙ্গে। দূর পরবাসের প্রথম কাজটাও জোগাড় করে দিয়েছিলেন মামুন ভাই। এ পরীক্ষার চারটা ভাগের মধ্যে রিডিং ও রাইটিংয়ে আমার সব সময়ই ভালো স্কোর আসত। লিসেনিংয়ে টেনেটুনে স্কোর এলেও কোনোভাবেই স্পিকিংয়ে কাঙ্ক্ষিত স্কোর তুলতে পারতাম না। তাই বেশি বেশি করে স্পিকিং টেস্ট দিতাম। আমি যেহেতু গ্রামের ছেলে ছিলাম, তাই ইংরেজি বলার দক্ষতা ছিল শূন্যের কোঠায়।
এরপর বন্ধু জামিলের নিকুঞ্জের বাসায় রাতের পর রাত জেগে সিপিডি বানিয়েছিলাম। এরপর ইঞ্জিনিয়ার্স অস্ট্রেলিয়ার অনুমোদন পাওয়ার পর ভিসার আবেদন করলাম পাশের কক্ষের মেজবার ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। ভিসা হয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছালে মেজবার ভাই আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এসেছিলেন। প্রথম এক সপ্তাহ উনাদের বাসায় ছিলাম। প্রথম বাসাটাও উনি খুঁজে দিয়েছিলেন। আমার যেহেতু সরকারি নীল রঙের পাসপোর্ট ছিল, তাই দেশ থেকে বের হতে গেলে সচিবালয় থেকে জিও (সরকারি আদেশ) ইস্যু করানোর দরকার ছিল। তখন বন্ধু শামীম অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার জোগাড় করে দিয়েছিল। তারপর সেটা দেখিয়ে জিও পেয়েছিলাম। দূর পরবাসে প্রথম নিজের বিষয়ের চাকরি খুঁজে পেয়েছিলাম হলের বড় ভাই মোস্তফা ভাইয়ের বুদ্ধি আর বন্ধু আশিকের সহায়তায়।
যা হোক, এ তো গেল দূর পরবাসে আসার গল্প। দূর পরবাসে আসার পর প্রত্যেক মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, তারা আসলে দেশে কতটা ভালো ছিল। তার পর থেকেই প্রতি মুহূর্তে দেশের জন্য বুকের মধ্যে অগাধ ভালোবাসা কাজ করতে শুরু করে। দেশকে আরও বেশি করে অনুভব করতে শুরু করে। আমি এমনিতেই ঘরকুনো স্বভাবের মানুষ। আর জীবন নিয়ে আমার আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা কখনোই মনের মধ্যে কাজ করে না। আমি চেষ্টা করি জীবনের ছোট ছোট সুখের মুহূর্ত উপভোগ করতে। জীবনের যেকোনো অর্জনেই আমি মুগ্ধ হই আর অবাক হয়ে ভাবি, আমি আসলেই এর যোগ্য কি না? জীবনের কোনো কিছু নিয়েই আমার কোনো অভিযোগ নেই। যা পাই মনে হয় সবই যেন উপরি। তাই দ্রুতই কোনো কিছুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারি। আমি জীবনের বিরুদ্ধে কখনোই বিদ্রোহ না করে বরং জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা মানুষ।
নিজের শৈশব–কৈশোরকে যেহেতু প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি, তাই নিজের সন্তানদের মধ্যে সেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। দূর পরবাসেও আমার সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। নিজে যেহেতু পড়াশোনা নিয়ে মা–বাবার কাছ থেকে কখনোই কোনো বাড়তি চাপ অনুভব করিনি, তাই সন্তানদেরও আমি চাপ দিই না। আমার মতো হচ্ছে ওরা। হাতে–পায়ে, মননে, মগজে শক্তপোক্ত হয়ে বড় হোক। তাহলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ভার নিজেই বইতে পারবে। আমাকে যেয়ে আর আলাদাভাবে পেলা (ঠেকনা) দিতে হবে না। আমার শৈশবের খেলার উপকরণের প্রায় সবই ওদের জোগাড় করে দিয়েছি।
সুপারির খোলের জায়গায় দিয়েছি পাইনগাছের খোল। সাইকেলের পুরোনো টায়ার, মার্বেল, তাস, চোর–ডাকাত, লুডু, পলানটুক (লুকোচুরি) সবকিছুই ওরা খেলার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়াও অবসরে সাইকেল চালানো, নদীর তীরে হাঁটা, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো—সবই ওদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
ছোটবেলায় যা করেছিলাম, এখন পর্যন্ত সেগুলোই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয়। তখন হয়তোবা ভেবেচিন্তে কোনো কিছু করিনি, কিন্তু এখন খারাপ সময়ে সেসব স্মৃতির কাছেই আশ্রয় খুঁজি। আমি তাই ওদের শৈশব–কৈশোর দুরন্ত করে তোলার নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, বড় হয়ে ওরাও আমার মতো এই স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই বাকি জীবন চালিয়ে নিতে পারবে।
শৈশবের অস্পষ্ট স্মৃতি থেকে শুরু করে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব মানুষকেই আমি চেষ্টা করেছি নিজের জীবনে ধরে রাখতে। একেবারে ছোটবেলার খেলার সাথি ফুফাতো ভাই আনোয়ার; বাসার কাজের সাহায্যকারী ছেলে আজাদ; প্রাথমিকের, মাধ্যমিকের, উচ্চমাধ্যমিকের ও বুয়েটের সহপাঠীরা; বিভিন্ন অফিসে চাকরির সুবাদে পরিচয় হওয়া সহকর্মীরা—তাঁদের কাউকেই আমি আমার জীবন থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দিইনি। এমন না যে তাঁদের সবার সঙ্গে আমার মতের মিল হয় সব সময়। কিন্তু আমি জানি, আমি যদি কখনো কোনো বিপদে পড়ি, তাহলে তাঁরা সবাই তাঁদের সাধ্যের পুরোটা নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াবেন। এই একই তত্ত্ব আমি আমার সন্তান দুটিকেও শিখিয়ে যাচ্ছি। জানি না ওরা কতটা ধরে রাখতে পারবে। কারণ, এখনকার দুনিয়ায় সবকিছুই আপনাকে সফল কিন্তু স্বার্থপর করে গড়ে তোলার তালে লেগে আছে।
আমি একসময় জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম এ রকম—গোটা পঞ্চাশেক দেশ দেখব, শ পাঁচেক ছবি (চলচ্চিত্র) দেখব আর হাজারখানেক বই পড়ব। আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল সতীনাথ বসাকের আদর্শলিপি দিয়ে। এরপর মায়ের নতুন শাড়ির ভাঁজের পুরোনো সংবাদপত্র আমার সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছিল। সদাই করে নিয়ে আসা কাগজের ঠোঙার প্রায় সব লেখা পড়তাম। এরপর মজুরিতে কাগজের ঠোঙা বানাতে যেয়ে খোঁজ পেয়েছিলাম পুরোনো সাময়িক পত্রিকার। এভাবেই পাঠাভ্যাস তৈরি হয়েছিল, যেটা এখনো ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্তর্জালের সর্বগ্রাসী নেশা মাঝেমধ্যে বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন জোর করে সেটাকে দূরে সরিয়ে রেখে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজি। এখনো নতুন বইয়ের গন্ধে মন উতলা হয়ে ওঠে।
জীবনে কখনোই ভাবিনি লেখালেখি করব বা আমার লেখার বই বের হবে। কিন্তু দূর পরবাসের প্রবাসজীবন আমাকে দিনে দিনে লেখক করে তুলেছে। প্রবাসজীবনের সঙ্গে দেশের জীবনের তুলনা, প্রবাসজীবনের দীনতা ও বিলাসিতা, নিজের শৈশব ও পরবর্তী প্রজন্মের শৈশব এবং মূল্যবোধের বৈপরীত্য সবই আমার লেখার বিষয়। সবকিছু ছাপিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অবিরাম ভালোবাসা আমার লেখার চালিকা শক্তি। যতক্ষণ লিখি, মনে হয় সেই সময়টুকু আমি যেন দেশেই শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শে থাকি। লেখালেখি আমার কাছে সেই জানালা, যেখান দিয়ে আমার কাছে বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরের স্নিগ্ধ বাতাস আসে। প্রথম আলো এবং দূর পরবাসকে তাই ধন্যবাদ আমার মধ্যকার সুপ্ত লেখক প্রতিভা জাগরূক করার জন্য।
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]