মক্কা: যে নগরী সদা জাগ্রত
ফিউমিসিনো বিমানবন্দর। ইতালি। আজ নতুন করে উইজ এয়ারলাইনস তাদের যাত্রা শুরু করল জেদ্দায়। নতুন ফ্লাইট। যাত্রী হিসেবে আমরা নতুন এই রুটে। চেক–ইন কাউন্টারের সামনে খাবারের বেশ আয়োজন। দু–একটা স্যান্ডউইচ খেলাম। একটা হাতে নিয়ে চেক–ইন শেষ করলাম। যাত্রা শুরু করার কথা ২টা ৩০ মিনিটে। নতুন রুট মানুষজন কানায় কানায় পূর্ণ। যে যাত্রা শুরু করার কথা আড়াইটায়, তা গিয়ে ঠেকল ৩টা ১০-এ। আমার সিট মাঝখানে। একপাশে একজন জাপানিজ। সদ্য পড়াশোনা শেষ করছে। সাহিত্যে পড়েছে। আরব সভ্যতা দেখতে আরবে যাচ্ছে। আমি তা মন দিয়ে শুনলাম।
এ মুহূর্তে তার নাম মনে পড়ছে না। চ্যাপটা নাক। মাছের চোখের মতো চোখ। সে চোখে চশমা। পৃথিবী ২০টির মতো দেশে ঘুরে এসেছে সে। সৌদি আরবে যাচ্ছে। জেদ্দায় যাবে প্রথমে, তারপর রিয়াদে। আমি জিজ্ঞেস করলাম মদিনা যাবে কি না? সে বলল, মদিনা তো সে অ্যালাউড না। তখন আমি বললাম, আমি যতটুকু জানি, মক্কায় শুধু মুসলিম যেতে পারবে। কিন্তু মদিনায় এ নিষেধাজ্ঞা থাকার কথা না।
বিমান টেক অফ করবে। আমাকে বিনয়ে সঙ্গে জানাল। টেক অফ আর ল্যান্ডিংয়ে তার কানে প্রেশার লাগে। সে জন্য কাগজের কাপ দিয়ে প্রেশার কন্ট্রোল করবে। আমি যেন কিছু মনে না করি। আমি বললাম আমি জানি এ প্রেশার সম্পর্কে। আমার মেয়েরও খুব প্রেশারের সমস্যা আছে। ক্যাপ্টেন অ্যানাউন্স শুরু করল। বিমান রানওয়েতে হাঁটা শুরু করল। তার পাঁচ মিনিট পর টেক অফ করল।
মানুষ অভ্যাসের দাস। আমার একসময় প্রচণ্ড ভয় লাগত। টেক অফের সময় মনে হতো নাড়িভুঁড়ি মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছে। তারপর বিমানের জানালায় বসা তো দূরের কথা। তার পাশের সিটেও বসতে আমার অনীহা ছিল। তার কারণ আমার হাইট ফোবিয়া। মনে হচ্ছে এই ফোবিয়া কেটে উঠছি।
টেক অফের পর আমার বাঁ পাশে বসা জাপানি ছেলেটার থেকে সে আরব সম্পর্কে কী কী জানে, তা জানতে চাইলাম। সে বলছে। আমি মনোযোগী ছাত্রের মতো দিয়ে শুনছি। আমার ডান পাশে যে বসেছে। সে ছেলেটার বয়স হবে সবে ১৪ বছর। কানে হেডফোন দিয়ে গেম খেলছে। জন্ম ইতালি। দেখে মনে হচ্ছে অ্যারাবিয়ান বংশোদ্ভূত। তার পাশের সিটে তার পরিবারের অন্য সদস্যরা বসে আছে। স্টেইন স্টেট বিমানবন্দর থেকে আসার সময় প্রিন্স হ্যারির নতুন বই স্পেয়ার কিনে এসেছি। যাতে এত বড় রাস্তায় সময় কাটানো যায়। এখন দেখছি জাপানি ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময়ই পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে চোখ বোলাচ্ছি।
বইটি পড়তে পড়তে আমি যেন সদ্য মা–হারা একটা কিশোরের যন্ত্রণার অনুভূতি নিজের মধ্যে সঞ্চালন করছি। কী ধরনের মানসিক অবস্থা হয়, তা যেন আমি নিজ চোখে দেখছিলাম। অনুভব করছিলাম। একটু পড়েই চোখ বন্ধ করে তা কল্পনা করছি। আবার পড়ি আবার চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছি। আমার এই এক সমস্যা। কোনো কিছু পড়লে তা কেন কল্পনা করতে হবে?
যাক।
একটা সময় বিমান ল্যান্ড করল কিং আবদুল আজিজ এয়ারপোর্টে। বিমান থেকে নেমে বাসযোগে টার্মিনাল আসলাম। ব্যাগ নেওয়ার ঝামেলা নেই। কারণ, ব্যাল্টে কোনো ব্যাগ নেই। সবই আমার হ্যান্ডব্যাগ। আমি ভিসা নিয়ে আসিনি। তাই অন অ্যারাইভাল ভিসা কাউন্টারে গেলাম। দুজন নারী ভিসা অফিসার ভিসা দিচ্ছে। সৌদি আরবে হাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। আগে নারীদের একদমই দেখা যেত না। আর এখন প্রায় জায়গায় নারীর অগ্রাধিকার। হাতে লেখা একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। তাতে আমার সিরিয়াল লেখা ৬। একটু পরে দেখলাম আমার পেছনে লম্বা লাইন। মাত্র দুজন অফিসার। ৬ নম্বর সিরিয়ালে আমাকে ভিসা দেওয়া হলো।
জেদ্দা থেকে বন্ধু আলম এল আরও দুজন ভাইকে নিয়ে। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হলাম। এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে আপন করে নিলাম। আমাদের গাড়ি ছুটছে। রাতের খাবার শেষ করে রওনা হলাম মক্কার পথে। জেদ্দা থেকে ৪৫ মিনিট মক্কার দূরত্ব।
মক্কা এমন এক শহর। যে শহর কখনো ঘুমায় না। যে শহরের পথে প্রান্তর হয়ে উঠেছে স্মৃতির আঁতুড়ঘর হিসেবে আর ১৪০০ বছর আগের রেখে যাওয়া পদচিহ্নের সুশীতল ছায়া অবলম্বনে যে পথ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা যেন বিরতিহীনভাবে ছুটে চলছে এবং চলবে কাল থেকে কাল, এক যুগ থেকে অন্য যুগে। কেবল পরিবর্তন হয় মানুষ আর সময়ের।
লোকে লোকারণ্য মক্কার পথঘাট। নানান বর্ণের নানা ভাষার। নানা ধরনের। কিন্তু উদ্দেশ্য এক। এক আল্লাহর একাত্মবাদ ঘোষণা এবং সান্নিধ্য অর্জন। মক্কা নিরাপদ এক নগরী। সে জন্য এখানে রাত আর দিনের হিসাব নেই। প্রভুর নৈকট্যলাভের আশায় মানুষ রাত আর দিনকে এক করে ফেলেছে। এখনে নিরাপদ নগরীর শপথ বলতে আল্লাহ তাআলা মক্কা নগরীকে বুঝিয়েছেন।
আব্বু বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এক দিন আগে। আমি হোটেলে চেক–ইন করলাম। তারপর ছুটলাম কাবার সুশীতল প্রান্তে দিকে। কাবার দিকে ছুটে চলেছে আমার মতো বহু মানুষ। রাতের গভীরতাকে এখানে হার মানায় মানুষ। কারণ, এখানে দিনরাত্রির হিসাব নেই। কেবল নামাজের সময় ছাড়া। ওমরাহ পালন করতে আসা লাখো লাখো মানুষের পদধূলিতে মুখর মক্কার পথ ও প্রান্তর।
এই আবেগ আর অনুভূতি ভাষাহীন। হাহাকার করা হৃদয় ও পূর্ণতা পায় এখানে। কেবল আল্লাহর ডাকে হাজির হওয়ার জন্য। আল্লাহর ঘরের মেহমান হয়ে এসে আল্লাহকে স্মরণ করা। আল্লাহর একাত্মবাদের ঘোষণা দেওয়া। সুবহান আল্লাহ।
হজরত বিবি হাজেরার কষ্ট আর এখনকার ব্লু লাইটে দৌড়ানোর কষ্ট কি এক? অসম্ভব। তা কী করে। এখন আমরা সাফা–মারওয়া পার করি টাইলসের ওপরে। তিনি দৌড়েছেন পাহারের উঁচু–নিচু জায়গায়। আমাদের মাথার ওপরে এসি। তিনি দৌড়াচ্ছে তপ্ত মরুর বুকে। তবে মানুষের চেষ্টা আর ভালোবাসা আছে শতভাগ। এটাই বোঝানোর মহত্ত্ব অনেক বেশি।
সাফা থেকে শুরু করে মারওয়া যাব পথে দেখা সোলাইমান ভূঁইয়া আঙ্কেলের সঙ্গে। সালাম দিলাম। আঙ্কেল বুকে জড়িয়ে নিলেন। কথা হলো ৩০ সেকেন্ডের মতো। পরে কথা হবে বলে পা বাড়ালাম। কারণ, ক্লান্ত শরীর আর একটু পরে ফজরের আজান হবে।
ফজরের আজান হলো। তখন সময় হিসাবে আমি ২২ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে। নামাজ শেষ করে হোটেলের লবিতে আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। আব্বু আস্তে আস্তে হাঁটেন। বয়স বাড়লে মানুষ সবকিছুই গতি কমে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শরীর হেলে পড়ছে। আমি উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় বের হয়ে দেখি আসতেছেন কি না। বহু লোকের সমাগম এখন। একটু পরপর গিয়ে দেখি। বেশি কিছুক্ষণ পরে দেখলাম। দূরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছেন। আমি দৌড়ে গেলাম। সালাম বিনিময়ের সময় আব্বু আমাকে দেখে বলছেন। আব্বা। আমার মানিক। জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। সন্তান আর তার বৃদ্ধ বাবা। আলিঙ্গনে সন্তান ফেরে তার শৈশবে–কৈশোরে। আর বাবা যেন জড়িয়ে ধরেন সেই ছোট্ট শিশুটির মতো।
পিতা–মাতার প্রতি আমাদের অনেক যত্নবান হওয়া উচিত। যদিও অনেক দূরে থেকে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কেবলই নিজেরই আক্ষেপ। আব্বুর সঙ্গে তার বন্ধুদের দেখা পেলাম। সাহাবউদ্দিন আঙ্কেলসহ অনেকের সঙ্গে রাস্তায় কুশল বিনিময় হলো। তারপর সবাই মিলে হোটেলে ফিরলাম।
আমাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, আব্বা তুমি ঘুমাও। আহা রে আব্বু। এখন আর আগের মতো আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। অল্পতেই চোখে পানি চলে আসে।
আমার চক্ষু শীতল হলো। ক্লান্তি যে নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। আমি আরেকটু বসতে চাইলাম। আব্বু বললেন, শরীর খারাপ করবে। যা ঘুমাতে যাও। আমি উঠে রুমে এলাম।
অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ঘুম আসতে দেরি হলো। উঠলাম জোহরের আগে। কী এক শান্তি!