অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বৈশাখী মেলা
আমাদের দেশ থেকে পড়তে আসা বেশি দিন হয়নি, দুই বছরের একটু বেশি হবে। তবে আমাদের আশপাশে কোথাও জাতীয় সংগীত, লাল-সবুজের পতাকা, বাংলা ভাষায় কথা শুনলে বুকের মধ্যে কেমন একটা ‘নিজের নিজের’ অনুভূতি হয়। নিশ্চয়ই এটি বেশির ভাগ প্রবাসীরই হয় বলে আমার ধারণা। প্রতিদিন দেশে থাকা পরিবারে-বন্ধু বা সমাজের কারও সঙ্গে কথা না বলতে পারলে ‘ঘরকুনো’ আমাদের দিনটা ঠিক ‘দিন’ হয়ে ওঠে না।
তেমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে যখন ভিনদেশে বৈশাখী মেলার কথা শুনি, যেখানে হাজারখানেক বাংলাদেশি লোকজন পুরোটা দিন পরিবার নিয়ে কাটাবে, নিজের প্রাণের ভাষায় নাচ-গান, গল্প, কবিতা, আড্ডা, খাইদাই হবে, ভাবতেই মাসখানেক আগে মোবাইলের ক্যালেন্ডারে বুকিং করে রেখেছিলাম। শুধু নিজের নয়, ছোট্ট কমিউনিটিতে যাঁদের সঙ্গে বেশি দেখা-আড্ডা হয়, তাঁরাও যেন মিস না করেন, সেদিকেও খেয়াল রাখছিলাম। কেননা হাজার মানুষ থাকলেও পরিচিতদের একসঙ্গে রাখা গেলে সেটির আনন্দটা কয়েক গুণ বেড়ে যায় বটে।
বৈশাখটা এ বছর রোজার মধ্যে পড়ায় বিভিন্ন সংগঠন ছোট পরিসরে ব্রিসবেনে পালন করলেও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন ব্রিসবেন (ব্যাব) সম্ভবত একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছিল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক ছিল কারণ, স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের বছরের একটি ‘সিগনেচার’ প্রোগ্রামের সফলতার জন্য অনেক প্রস্তুতি আর প্রচারের বিকল্প ছিল না। গত শনিবার (২৬ মে) স্প্রিংফিল্ড সেন্ট্রালের রবেলে ডোমেইন পার্কে দিনব্যাপী মেলাটা জমে উঠেছিল। বেলা ১১টায় শুরুর কথা থাকলেও দিনের শুরুতে হালকা বৃষ্টি ঘণ্টা দেড়েক পেছাতে বাধ্য করে। মেলার যে শুধু বাঙালি বা বাংলাদেশিদেরই উপস্থিতি ছিল, তা নয়, স্থানীয় স্পিকার, এমপি, সিটি কাউন্সিলের প্রতিনিধি, পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাঁদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিকে বহুজাতিক-বহুমাত্রিক করে তুলেছিল।
মেলায় নারী-পুরুষের-শিশুদের রঙিন পোশাকগুলো আর বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসা সারি সারি স্টলগুলোর বেচাকেনা সত্যিই দেশের পয়লা বৈশাখের আমেজ এনেছিল। দূর পরবাসের এ আয়োজনে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতসহ শিশুদের পরিবেশনা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আতশবাজি, স্টলগুলোর ঐতিহ্যবাহী খাবার, লাইভ কনসার্ট, লেজার শো সবই ছিল এককথায় অসাধারণ। বাংলাদেশি জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি আমাদের শিশুরা দরাজ কণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতও গাইল। সে সময় দেশি-বিদেশি সবাই দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিলেন সবাই। এমনকি সে সময় স্টলগুলোয় বিক্রিও বন্ধ ছিল।
আমার পরিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের আরেক বড় ভাই হাসান ভাইয়ের পরিবার, কিউইউটিএর বিশ্বজিৎদার পরিবার একসঙ্গে মেলায় গেলাম। ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের কাছের আরেক সিনিয়র বড় ভাই শেষ সময়ে জানালেন পড়াশোনার চাপে যোগ দিতে পারলেন না। আমার সহকর্মী ও বড় ভাই উৎপলানন্দ চৌধুরী পরিবার নিয়ে আগেই পৌঁছেছিলেন। কারণ, বউদির একটি নাচের পারফর্ম ছিল। মেলার গিয়ে পরিচিত ৩০-৪০টি পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়ে মনটা ভরে গেল। অনুষ্ঠানের তালে তালে ফ্লাস্কে করে নেওয়া চা শেষ করে আবার মেলা থেকে কেনা আরেক ফ্লাস্ক চা শেষ করলাম। শুধুই কি চা! চায়ের সঙ্গে কলিজার শিঙারা, ফুচকা-চটপটি, পেঁয়াজু, পুলি-পিঠা কোনোটাই বাদ যায়নি।
আর বাড়ি ফেরার পথে মেজবানি খাবার নিয়ে বাসায় এলাম। আর আমার স্ত্রী-ছেলে, বউদিরা সবাই মিলে হাওয়া মিঠাইয়ের স্বাদ নিতে ভোলেনি। দেশের অনেকের মনে হতে পারে, খাবারের গল্প এত দেওয়ার কিইবা আছে? একটিবার ভাবুন, আপনি যেখানে আছেন, আশপাশে অনেক কিছুই আছে কিন্তু প্রতিবারই ভাবতে হচ্ছে সেগুলো আমার সংস্কৃতির বা স্বাদের সঙ্গে যাচ্ছে কি না? চাইলেও টং দোকান পাচ্ছেন না, রাস্তার ধারে গরম-গরম চা-বিস্কুট-পেঁয়াজুর তালে গল্প জমে ফেলবেন, এমন জায়গাও পাচ্ছেন না, তাহলে কেমন লাগবে! বাড়িতে নিজে রান্না করাটাই যেখানে ভরসা, সেখানে এত দেশি স্বাদের খাবার একসঙ্গে টেস্ট করার সুযোগ প্রবাসে খুব কমই আসে।
এবারের মেলাটা মিস না করতে চাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আমার গবেষণার বিষয়। আমি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ডিজিটাল মিডিয়া রিসার্চ সেন্টারে যে বিষয়ে পিএইচডি করছি, সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি শিশুরা নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে কীভাবে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করছে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আছে। অনুষ্ঠানে অনেক অনেক শিশুর প্রাণবন্ত উপস্থিতি, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অংশে অংশগ্রহণ বিশেষ করে বাংলা ভাষায় নাচ-গান-আবৃত্তি, উপস্থাপনার পারফর্ম দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। বিশেষ করে দূর পরবাসে শিশুরা নিজের সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলবে কি না, এমন দুশ্চিন্তায় থাকা অভিভাবকদের আশার আলোয় রূপ নিতেই পারে। মেলা কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ। কারণ, তারা এবার শিশুদের প্রবেশ ফি মওকুফ করেছে। আবার বড়দের প্রবেশ ফি-ও গতবারের তুলনায় অর্ধেক করেছে, যেটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খুব একটা দেখা যায় না! দেশে তো কোনো জিনিসের দাম বাড়লে আর কমে বলে শোনা যায় না।
সবশেষে রাতে ব্যান্ড স্টিল বাফারিং, রাফ সান আর দেশি ব্যান্ড তারকা তানজীর তুহিনের গানগুলো উপভোগ্য ছিল। গানের তালে তালে অনেকেই নেচেগেয়ে বাজিমাত করেছেন। পরে অবশ্য ব্যাবের নিজেদের শিল্পীদের ‘তুমি বন্ধু কালাপাখি’, ‘বাদলা হাওয়ার তোড়ে’, ‘তুমি চেয়ে আছ তাই’সহ পরিচিত জনপ্রিয় গানগুলোর তাল অনেককেই নাচিয়ে ছেড়েছিল!
পড়াশোনা বা পেশার তাগিদে দেশান্তরি হয়ে বিদেশে বসবাস করলেও প্রবাসীরা সব সময় দেশকে মিস করে। এভাবেই দেশ থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আবর্তে দেশ ও কমিউনিটির অস্তিত্বকে ধারণ করে একসঙ্গে বাঁচুক সবাই—এমনটাই প্রত্যাশা রইল। আর ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ানোর মতো অসম্ভব ‘পাগলামি’ (ভালোবাসা অর্থে) দেখিয়ে ব্রিসবেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিকে নির্মল আনন্দ আয়োজনের জন্য সংগঠন ব্যাবকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
লেখক: মামুন আ. কাইউম, পিএইচডি গবেষক, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]