তুমি না এলে এই পৃথিবী আমার হারাবে আপন ঠিকানায়...
সালটা ১৯৯১। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে সদ্য পড়াশোনা করা ছাড়া অন্য কী কী করা যায় মনে মনে তার একটা লিস্ট করে ফেলেছি। তখন আমরা খুলনা থাকি, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে আম্মি পড়ান।
তাঁদের লাইব্রেরিতে আমার আনাগোনা ছিল নিত্য। বই পড়ি, শিঙাড়া খাই, আম্মির সঙ্গে কলেজের পিকনিকে যাই, আন্টিদের বাসায় দাওয়াত খাই, কী এক সুখের জীবন। এর মধ্যে আব্বু জানালেন, ঢাকায় চলে যেতে হবে, শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে মেডিকেলের কোচিং করতে হবে। বসে থাকলে চলবে না। মাথায় বাজ পড়ল, বোহেমিয়ান জীবনের ইতি এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?
জীবনে প্রথম আব্বু আম্মি ছাড়া থাকব ঢাকায়। যাক গে, তবু ঢাকায় নানুর বাসা। খুব একটা খারাপ হবে না হয়তো কোচিংয়ে আসা–যাওয়া। ঢাকা পৌঁছে শুনলাম, থাকতে হবে আপুর সঙ্গে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। নানুর বাসায় থাকলে পড়াশোনা হবে না। আপু তখন ডাক্তার। বিরাট ভাব তার। আমি কীভাবে থাকব? আব্বু খুলনা চলে গেলেন। ঢঙ্গির সঙ্গে আমি থাকি, শুভেচ্ছার বকশিবাজার শাখায় কোচিং করি। ওদের বিদেশিদের জন্য রাখা গৃহকর্মীর রান্না খাই। আপু কোচিংয়ে দিয়ে আসে, আপু নিয়ে যায় রুমে। একে পড়াশোনা করতে হচ্ছে, তার ওপর আম্মি কাছে নেই, তবে যেসব দিন টেস্টে ভালো নাম্বার পেতাম, পুরান ঢাকার আনন্দ বেকারিতে আপু নিয়ে যেত। তবু বাসার সবাইকে মিস করি খুব।
এর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারের কিছু আপুর সঙ্গে ভাব হলো খুব (রোজি আপু, লোপা আপুসহ ভীষণ ভালোবাসা যারা দেখিয়েছে আমার জন্য। তোমাদের জীবনে তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ ভালোবাসা ফিরে আসুক), আপু ইন্টার্নশিপ করতে গেলেই আমি ওদের কমনরুমে হাজির হতাম। তখন নবীনবরণ চলছে ওদের। প্রায়ই কনসার্ট হয়। এ রকম কোনো এক সন্ধ্যায় গেলাম মাইলস ব্যান্ডের প্রোগ্রাম দেখতে। সোনারগাঁও হোটেলে উনারা ইংরেজি গান গাইতেন। কোনো এক সময়ে শুনেছি তখন। গিটারিস্ট থেকে ভোকালিস্টও হয়েছেন শাফিন আর হামিন আহমেদ, দুই ভাই। আবার আব্বু আম্মির আফসোসও শুনতাম, আহা, ফিরোজা বেগমের মতো এত চমৎকার নজরুলসংগীতশিল্পীর ঘরে কেমন ব্যান্ডসংগীতশিল্পীদের জন্ম হয়েছে। অথচ মাইলসের গিটার, ড্রাম আর সুরের জাদু আমাকে কোনো স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যেত সব সময়।
সেই মাইলস পারফরম্যান্স দেখব। গ্যালারিতে বসতেই শাফিন আহমেদ এলেন, শুরু করলেন গান।
গুঞ্জন শুনি, সবাই বলে, এ পাড়ায় নাকি এক নতুন মেয়ে এসেছে
পাথুরে নদীর জলে পাহাড়ি মেয়ে নামে
নীলা তুমি কি চাও না, হারাতে ঐ নীলিমায়
হায় জ্বালা জ্বালা জ্বালা এই অন্তরে, এত নিষ্ঠুর কেন হলে
সেই মিষ্টি হাসি ভুলতে পারিনি, কার মনের কথা জানতে পারিনি
নিঃস্ব করেছ আমায় কী নিঠুর ছলনায়
এবং অবশ্যই চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি, নও পাহাড়ি ঝরনা
কত রাতে সে কনসার্ট শেষ হয়েছিল জানি না। কেন শেষ হয়েছিল সে কষ্টে বাকি রাত ঘুম হয়নি। ঢাকা মেডিকেলে তার পরপরই মাইলসের কনসার্ট হবে জেনে যেতে চেয়েছিলাম, মেডিকেলে চান্স না পেলে মাইলস রিকশা চালাতে চালাতে শুনতে হবে–মূলক ঝাড়ি খেলাম। তারপর নিজের মেডিকেলেও মাইলসের কনসার্ট দেখেছি। মুগ্ধতা বেড়েছে শুধু।
মায়াবী আলোয় নীল দু’নয়ন কেন যে হাসে
ফেরারী নেশাতে কেন যে... শুনে কত রাত ভোর হয়েছে।
শাফিন আহমেদ স্কলাস্টিকায় বাচ্চা আনতে যেতেন, আমার বোন তাঁকে কত দেখেছেন শুনে একটু–আধটু ঈর্ষা তো হতোই। কিন্তু এত ক্ষণজন্মা হয়ে জন্মালেন কেন প্রতিভাময়ী শিল্পী?
গত কয়েক দিন হাসপাতালে তীব্র ব্যস্ততা চলছে, হাজার হাজার মাইল দূরে বসে কথাও বসতে পারছি না প্রাণের স্বজনদের সঙ্গে দেশে। এর মাঝে আজকে তিনটা টেক্সট পেলাম একসঙ্গে বন্ধুদের। মন খারাপ করিস না। ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে শাফিন আহমেদ মারা গেছেন।
কী বলে এঁরা? সবচেয়ে প্রাণবন্ত সুন্দরতম শিল্পী আর কখনো গাইবেন না? বেহেশতের বাগান আলোকিত করতে চলে গেছেন?
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,
যদি দূরে যাও, স্বপ্নগুলো আমার ভেঙে যাবে জানো না?
বা
ফিরিয়ে দাও আমারই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও
ফিরিয়ে দাও হারানো দিনগুলো এভাবে চলে যেও না...