পুরাকীর্তি ও রহস্যরমণী

ইমরুল অপেক্ষায় অধৈর্য। কী করা উচিত ভেবে বিভ্রান্ত। বিভ্রান্তও অধৈর্য হওয়ারই কথা। কোনো আত্মসম্মান জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এমন এক সম্ভ্রান্ত স্ন্যাকশপে খাবারদাবারের হুকুম না দিয়ে এতটা সময় হাবার মতো বসে থাকা মুশকিল। কফিশপের বাইরের চত্বরে প্রচণ্ড ঠান্ডায় স্ট্যান্ডে বসানো গ্যাস হিটার চারপাশের হিম শুষে নিয়ে মাথার ওপর থেকে উষ্ণ নিশ্বাসের উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে তার পক্ষে চট করে ওঠাও সম্ভব নয়। চিন্তায় ব্যাকুল যখন, তখনই কফিশপের ওয়েট্রেস অন্য কারোর অর্ডার নিতে চত্বরে বেরিয়ে এসে ইমরুলকে অদ্ভুত চোখে দেখল। কাছে এসে বলল—

‘ডাই মারা গেছেন গত পরশু, জানেন!’

মেয়েটির গলায় বিস্ময় মেশানো প্রশ্ন। ইমরুলের উত্তর চলে এল আপনা–আপনি যেটা মিথ্যা নয়। ‘শহরের বাইরে ছিলাম তো জানতে পারিনি।’
মেয়েটি বুঝেই নিয়েছে যে সে ডাইয়ের অপেক্ষায় বসে। তবে মহিলার মৃত্যুর খবরে ইমরুলের মুক্তির আনন্দ হলো। শূন্যে ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছা হলো। স্যুট নামের পরিচ্ছদের গাম্ভীর্যের খাঁচায় বন্দী ইমরুল স্থির হয়েই রইল। মেয়েটি ততক্ষণে অন্য টেবিলে চলে গেছে। এই ফাঁকে সবার চোখ এড়িয়ে প্রায় ছিটকে ও কফিশপের চৌহদ্দি থেকে মূল সড়কে চলে এল।

আহা কী যে আনন্দ! মনে হচ্ছে যেন এক মায়াবিনী বা জাদুকরির নাগপাশ থেকে ওর মুক্তি হলো। মাঝারি উচ্চতার বাদামি চামড়ার চৌকো মুখাবয়বের পুরুষ ইমরুল। কপালে ঝুঁকে আসা সামান্য কোঁকড়ানো চুল মাথা ঝাঁকিয়ে পেছনে ঠেলে চকচকে কালো চোখে আকাশ দেখল। দ্রুত পা চালাল বাসস্টপের দিকে। গত কিছুদিনের মাঝে বেশ কবার সে এই কফিশপে এসেছে। গাড়ি নিয়ে আসে না। ভয় হয় যদি কেউ দেখে ফেলে। প্রশ্ন জাগবে কাজের সময়ে ও এখানে কেন? কী কারণ দেখাবে ইমরুল। তাই ট্রেনে-বাসে অনেকটা পথ পেরিয়ে এখানে আসা। অফিস থেকে নানা বাহানা দেখিয়ে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে তবেই আসতে হচ্ছে। ওই দুষ্টু নারী একদিকে যেমন ছিল তার বিপদতারিণী, অন্যদিকে তেমনি হয়ে উঠল ওর...

আজ ও শান্তিতে চোখ মেলে এলাকাটা দেখতে দেখতে চলছিল। দেখে টু-ডলার শপের মতো ফুটপাতের পাশেই নামীদামি কান্ট্রিরোডের দোকান। অবাক হলো। তক্ষুনি মনে পড়ল যে এটা বড়লোকদের পাড়া। ক্রিকেটার শেন ওয়ার্নের এখানেই বাস। শেন ওয়ার্নের কথা স্মরণ হতেই অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি জাগল ওর। ওই হতভাগা শেন ওয়ার্নের জন্যই সে এমন কাদায় পড়ল। নাকি ওর জন্যই বিপদ থেকে বেঁচে গেল? কোনটা যে ঠিক, নিজেই বুঝতে পারছে না। কী কুক্ষণে যে সে রহস্যময় ব্যাগ, পুলিশ, তারপরে এই নারী এত কিছুর সঙ্গে জড়াল! ভেবে কূল পায় না। অবশ্যই না।

লটারিতে প্লেনের টিকিট জিতেছিল। তাই বেড়াতে বের হওয়া। ওর মতো চুইংগাম বৈশিষ্ট্যের লোকের জন্য ছোটাছুটি, ঘোরাঘুরি মোটেও আনন্দের ব্যাপার নয়। বউই ওকে জোর পাঠাল। সে দেশে গেছে একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে। ইমরুল যেতে পারেনি।
বউ জোর করাতে লটারিতে জেতা রিটার্ন টিকিটে গোল্ডকোস্টে বন্ধুকে দেখার উদ্যোগ নিল। উইকএন্ডের মামলা মাত্র। না হলে নড়তই না। সে চুইংগামের মতো এক জায়গায় সেটে থাকার মানুষ। বউ মাঝেমধ্যে এ নিয়ে অনুযোগ করলেও ওর তেমন গায়ে লাগে না।
এয়ারপোর্টে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসে মোবাইল ফোনে গেম খেলছিল। হঠাৎ মনে হলো ওর খুব কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। খেলা ফেলে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ছন্নছাড়া কিসিমের এক লোক। ভাঙা চোয়ালের দাড়ি–গোঁফওয়ালা টিঙ্গটিঙ্গা বাবুসাহেব কাঁধের ব্যাগটা প্রায় ওর পায়ের প্রায় কাছে রেখে বলল ‘ব্যাগটা একটু সময়ের জন্য দেখবে, চলে আসব এখনি।’ সম্মতির অপেক্ষা না করেই দ্রুত হাঁটা দিল সে। ইমরুলের মনে হলো হয়তো ওই লোকের বাথরুম পেয়েছে তাই সম্মতির অপেক্ষায় সময় নষ্ট সম্ভব হয়নি। তখন চারপাশে তাকিয়ে ভালো করে দেখল সে। এই মুহূর্তে যাত্রী তেমন নেই। ওর প্রায় কাছাকাছি এক মহিলা বসা। যার কাছ থেকে ধার করা জার্নালটি ইমরুলকে এখনো এখানে আটকে রেখেছে। তা না হলে ও আগেই এ জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ত। ইমরুলের মনে হলো বেশ বিরক্তি নিয়ে উনি ইমরুলকে দেখছেন। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা কোনো কারণ ছাড়াই অন্যকে পছন্দ করে। ইনি বোধ হয় সেই জাতের। ইমরুল অবশ্য মহিলার অস্তগামী বয়স, বিশাল অবয়ব, অকারণে অহংকারী চেহারা সত্ত্বেও তার প্রতি আকৃষ্টই হয়েছিল। কারণ ছিল একটা। তা হলো মহিলার হাতে ধরা ক্রিকেট জার্নালটি। মলাটেই শেন ওয়ার্নের ছবি। ও জার্নালটি দেখছিল মন দিয়ে। মহিলা ওর দিকে জার্নালটি এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘শেন ওয়ার্নকে পছন্দ করো তবে নাও ধর, ও আমার প্রতিবেশী।’ ধন্যবাদ দিয়ে জার্নালটি নিয়ে পাতা ওলটাল। ভেতরে পাতায় নাম লেখা ডায়ান উইলস। সময় কিছুটা কাটল। সে জার্নাল পড়া শেষ করে ফেরত দিল। তারপর চাইল ওই লোকের রেখে যাওয়া ব্যাগটা আরও পায়ের কাছ ঘেঁষে এনে রাখতে। যেই সামান্য ঝুঁকে ব্যাগের দিকে হাত বাড়িয়েছে, অমনি চাপা অথচ তীক্ষ্ণ গলায় মহিলা বলে উঠলেন, ‘কেন ধরছ ওটা, ও এসে নিয়ে যাবে; জানত এয়ারপোর্টে কারও জিনিসের দায়িত্ব নেওয়া মোটেও উচিত না।’ ইমরুল ভাবল সে কালো মানুষ, তাই তাকে মহিলালোভী ভেবেছে হয়তো। মনটা খারাপ হলো একটু। আরেক দিক চিন্তা করে ভালোও লাগল যে ওই মহিলার জাত ভাই তো মহিলাকে বিশ্বাস করে ব্যাগের দায়িত্ব দেয়নি। কালো হলেও ওকেই দায়িত্বটা দিয়ে গেছে। তখনো ইমরুলের বুঝতে বাকি কেন লোকটি ব্যাগ তার কাছেই গচ্ছিত রেখে গেছে।

মানুষকে কোনো কারণ ছাড়াই অন্য মানুষ অবজ্ঞা করে, কখনোবা ঘৃণাও করে। কেন করে? তা নিয়ে ইমরুল মাথা ঘামায় না। ওর বউ অবশ্য মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, অবজ্ঞা করাকে দারুণ অপছন্দ করে। সে নিজেও মানুষকে কখনোই অসম্মান করে না। আরে চামড়ার রং সাদা বলে নিজেকে উচ্চ মানব ভাবতে হবে, এ কেমন কথা। এখানে যদিও খোলামেলাভাবে কেউ বিদ্বেষ প্রকাশ করে না। তবে আড়ালে অবজ্ঞা দেখায় অনেকেই। ইমরুল ভাবে আয়েশি ও নিরুপদ্রব জীবনযাপনের স্বার্থে ওই সব অবজ্ঞা, অবহেলা দেখে না দেখার ভান করলেই কষ্ট এড়ানো যায়। যেমন ওর বউ নামীদামি রেস্তোরাঁ ইমরুলের অফিসের ক্রিসমাস পার্টি থেকে ফিরে তেমনি এক ব্যাপারে বিরক্তি ঝাড়ছিল, যা ইমরুল খেয়ালই করেনি বা ইচ্ছা করেই না দেখার বা না বোঝার ভান করেছে। ওয়েট্রেস ছিল মাঝবয়সী এক মহিলা। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে ফ্রিল দেওয়া অ্যাপ্রোন ও সাদা টুপি মাথায় দিয়ে খুরাওয়ালা ঝকঝকে কাচের থালায় ক্রিস্টালের গ্লাসে পানীয় ও ফলের রস সেধে সেধে সবাইকে দিয়ে যাচ্ছে। যে নিচ্ছে, সেই মহিলাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। যেটা ওদের আদবলেহাজ বা ভদ্রতা প্রকাশের ভঙ্গি। মহিলাও খুব মাথা হেলিয়ে হেসে, কখনোবা মনোরম ভঙ্গিতে ‘বো’ করে ‘ইউ ওয়েলকাম’ বলে যাচ্ছে ক্লান্তিহীনভাবে। মহিলার বলার ভঙ্গি ও হাসি দুই–ই মনোহারী। ওর বউ প্যাশনফ্রুট জুস নিয়ে প্রথামতো সুন্দরভাবে ধন্যবাদ বলেছিল। তবে ওয়েট্রেস নারী ‘ইউ ওয়েলকাম’ বলা দূরের কথা, কেমন এক অবজ্ঞামিশ্রিত হাসি দিয়েই ঘুরে গেল। ইমরুল বেশ ভালো চাকরি করে। ওর কোম্পানি ওর ওপর নির্ভরশীল। একমাত্র বাদামি চামড়ার লোক ওই অনুষ্ঠানে ছিল ওরাই। বউয়ের বিবরণ শুনে ইমরুল বলেছিল ‘বাদ দাও তো ওই মহিলার নিশ্চয় ইচ্ছা করছিল না কালো মানুষের খেদমত করতে; কিন্তু উপায় ছিল না বেচারীর। তাই সে সুযোগমতো ঘৃণা ঢেলেছে’, ‘ভালো লাগছিল ওর বলার ভঙ্গিটি, জানো ওই ভঙ্গিটাই যা সার, ওর মন বিদ্বেষের বিষে কালো।’ বউকে শান্ত করেছিল নানা কথা বলে। ওদের দুজনেই অন্যের যে ব্যবহারে কষ্ট পায় বা খারাপ বোধ করে, তেমন আচরণ কারও প্রতি কখনোই জ্ঞানত নিজেরা করে না।

ইমরুল প্লেনে ওঠার ডাক শুনতে পেল তখন। উঠেও দাঁড়াল। তখনই সিকিউরিটির দুজন লোক এসে দাঁড়াল। এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে ওদের শ্বাসপ্রশ্বাস ওর গায়ে লাগছিল। একজন বলল ‘তোমার কাছে অবৈধ মালামাল রয়েছে খবর পেয়েই এসেছি, চল এবার’ বলেই ও হ্যান্ড লাগেজ একজন নিল আরেকজন ওই লোকের রেখে যাওয়া ব্যাগটা তুলল। সে বিস্ময়ে বিমূঢ়। কোনোমতে বলতে পারল, ‘এ ব্যাগ আমার না’–

‘এই রকম বলাই চোরাকারবারিদের অভ্যাস!’ ইমরুলের ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে। ওদের সঙ্গে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা অফিসে পৌঁছে দেখে আরও দুজন হোমড়াচোমড়া বসে। নানা প্রশ্ন তাদের। প্রশ্নের ধাক্কায় বেকুব ইমরুল। বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছাল যখন শুনল যে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে চুরি যাওয়া জাতীয় সম্পদ মূল্যবান পুরাকীর্তি বিষ্ণুমূর্তি আসলে চোরাকারবারিরা সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের বিমানবন্দরে ওই মূর্তি উদ্ধারের জন্য ইন্টারপোল চেষ্টা করছে। হতচকিত ইমরুল দুর্বল গলায় বলল,
‘কিন্তু পত্রিকাতে দেখলাম যে মূর্তি ওরা ভেঙে ফেলেছে!’

‘শুন, রাঘববোয়ালেরা নকলমূর্তি ভেঙে মানুষের মনোযোগ আবর্জনায় ভাঙা মূর্তি খোঁজায় ব্যস্ত রেখে তা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়, আমাদের কাছে খবর আসে যে ওই মূর্তি এ দেশে এখন’ বলেই একজন ব্যাগ খুলে আশ্চর্যজনকভাবে কাপড়ের মোড়কে জড়ানো মূর্তি দুটি বের করে। সামনের টেবিলে অমূল্য পুরাকীর্তি রেখে কঠিন গলায় বস বা বড়কর্তা গোছের লোকটি জিজ্ঞেস করে যে ‘এই ব্যাগ যে তোমার না তার কোনো সাক্ষীসাবুদ আছে তোমার কাছে?’ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ইমরুলের মনে পড়ল বিরক্তি মাখানো মুখটা। আগুপিছু না ভেবেই বলল ‘ডায়ান উইলস, উনিই আমার সাক্ষী।’ বলার পর চিন্তা হলো যে ওই মহিলা আসলে ওর পক্ষে বলবেন কি না। যা–ই হোক ওরা মহিলাকে ঠিকই হাজির করল। বিস্ময়ের ব্যাপার যে মহিলা দৃঢ়ভাবে ওর পক্ষেই সাফাই গাইলেন। এক ধাপ এগিয়ে বললেন ‘ওই বেহদ্দ বোকা ব্যাগটা কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল আমি ওকে ব্যাগ ধরতে মানা করেছি। ওই ব্যাগে এর হাতের ছাপও পাবে না।’ মনে হয় শেন ওয়ার্নের প্রতিবেশী মহিলা দারুণ দাপটের মানুষ না হলে ইমরুল অত সহজে ছাড়া পেত কি না সন্দেহ।

তবে পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেলেও মহিলা ইমরুলের কাঁধ শয়তানের মতো চেপে ধরলেন। সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে নিজের গাড়িতে নিয়ে এসে ইমরুলের পছন্দের জায়গায় ওকে নামিয়েও দিয়ে গেলেন। তবে যাওয়ার সময় পরের সপ্তাহেই কফিশপে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। মনে হলো দাওয়াত নয়, হুকুম। কৃতজ্ঞ ইমরুলের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না কোনো। এর মাঝেই কেন সে গোল্ডকোস্ট যায়নি তার মনগড়া এক জবাবদিহি বউকে দেবে বলে ঠিক করে ফেলল। যদিও অন্যায়-অনৈতিক কোনো দাবি মহিলার ছিল না। তবে উদ্দেশ্যও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। খোশগল্পের সঙ্গী খুঁজেই কি ইমরুলকে পাকড়াও করা কিনা কে জানে। এসব উন্নত দেশের ধনী বুড়িদের নানা খচ্চর অভ্যাসও তৈরি হয়। পুরুষেরা যদি নগ্ন নর্তকীর ক্লাবে যায়, অনেক বুড়িমহিলারাও নগ্ন নর্তকের নাচ দেখতে উন্মাদ হয়ে যায় বলে শুনেছে। এই বিত্তবান মহিলা কোন কিসিমের যে হবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে। কথা প্রসঙ্গে জানল যে মহিলা শিক্ষকতা করতেন। পিএইচডি করেছেন ‘কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড ন্যাশনাল হেরিটেইজ’ নামের কি এক উদ্ভট বিষয়ে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখা নানা জাতির পুরাকীর্তি বিষয়ে অনেক মজার গল্প বললেন। বললেন ‘কলোনিয়াল শক্তি যেখানে গেছে, সেখানকার ঐতিহ্যমাখা মূল্যবান সব পুরাকীর্তি লুটে এনে কি সুন্দর প্রদর্শনী যে সাজিয়েছে ওই পাজি লুটেরারা। তোমার দেশের ওই মূর্তিও ধনী দেশের কোনো ধনীর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় বিক্রির জন্য পাচার হয়েছে বুঝলে।’

‘ঐতিহ্য লুট’ ও ‘সংস্কৃতি ধ্বংস’ ইত্যাদি জটিল শব্দে ইমরুলের মোটেও আগ্রহ নেই। পরবাসী মানুষ সে। কোনটা সংস্কৃতি, কী তার ঐতিহ্য! এতসব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে যাওয়া মানে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়া ছাড়া আরকি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সে–ও গেছে দু–দুবার। গিয়ে মনে হয়েছে একসময় রবীন্দ্রনাথ ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’ লিখলেও আসলে ওর মতে তা হবে, ‘লোভীর হস্ত করে সমস্ত নিরীহের ধন চুরি’। এই কথা ঔপনিবেশিকদের ক্ষেত্রে যথাযোগ্যভাবেই প্রযোজ্য।
ডায়ান উইলস ওকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তোলা ছবিও দেখালেন। মোগল রাজদরবারে থেকে লুটে আনা সোনার হুঁকা। চমৎকার স্বর্ণনির্মিত নর্তকী দিয়ে ঘেরা হুঁকা। ইমরুল নিজেও যখন গিয়েছিল দেখেছিল হুঁকাগুলো। লেখা ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে সভাসদরা এ থেকে ধূমপান করত।

ভাবতে ভাবতে বাস এসে গেল। ওয়ালেট থেকে বাসের টিকিট বের করতে গিয়ে ঘড়ি সারাইয়ের দোকানের রিসিটটা চোখে পড়ল।

আবার ডায়ান উইলস ওকে চিন্তায় ফেলল। গত সপ্তাহে মহিলা ইমরুলকে তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ১২৫ বছরের পুরোনো একটি ওমেগা ঘড়ি শহরের বিশেষ ঘড়ি মেরামতের দোকানে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। দোকানে গিয়েই ও এই ঘড়ির ইতিহাস জানতে পারে। ওমেগা কোম্পানি ঘড়ি বানাচ্ছে ১৬০ বছর ধরে। ডায়ানের ঘড়িটি খুব দুর্লভ লিমিটেড এডিশনের একটি। মাত্র ১০টি ঘড়ি এই রকম বানানো হয়েছিল। যে যে ব্যক্তি বা পরিবার এগুলো কিনেছিল, তার তালিকাও নাকি কোম্পানির কাছে রয়েছে। ডায়ানের ঘড়িও মোটা টাকায় ইনস্যুরেন্স করানো রয়েছে। কথা শেষে দোকানি বলল, ‘ঘড়ি সার্ভিসিং হয়ে গেলে আমরাই মালিককে জানাব, তোমাকে যদি পাঠায় তো এসে নিয়ে যেয়ো তখন।’ দোকানি ভেবেছে সে ডায়ানের কর্মচারী। তাতে ইমরুলের মেজাজ আরও গেল তেতে।

ইমরূল ভাবছিল মহিলা কেন তাকে এতো মূল্যবান ঘড়ির দায়িত্ব দিলেন। কারণ কি ইমরূলের সততা পরীক্ষা? নাকি আর কিছু? অপমানিত ইমরূল ওমেগা মেরামতের রিসিটটি কুচিকুচি করে ছিড়ে অত্যন্ত সাবধানে বাসের জানলাপথে বাইরে ফেলে দিল। ওই ছেঁড়া কাগজের সঙ্গে ওর জীবনের বোকামির এই অধ্যায়ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যেন। এমন বোকামি আর কোনো দিন করবে না। উপকারীকে বাঘে খায়, কথাটা একেবারে খাঁটি। ওই লোকের উপকার করতে না গেলে এই বাঘিনীর পাল্লায় সে–ও কোনো দিন পড়ত না।

কিছুদিন পর খবরের কাগজে ছোট্ট এক খবরে ওর চোখ আটকে গেল। খবরটি পড়ে ডায়ান উইলসের ওপর বিরক্ত হওয়ার জন্য অনুশোচনা হলো। ছবিসহ শোকসংবাদ; সঙ্গে খবর যে লন্ডনের অকশন হাউসে ডায়ান উইলসের ওমেগা অকশনে যাচ্ছে। বিক্রির অর্থ ডায়ানের উইল অনুসারে ইউনেসকোর ফান্ডে দান করা হবে। সে অর্থ অনুন্নত দেশে শিক্ষা–সংস্কৃতি খাতে ব্যয় করা হবে। মনে হলো এই বিদুষী বুদ্ধিমতী নারী হয়তোবা আশা করতেন আপন সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান মানুষেরা নিজেকে সম্মান করতে শিখবে, শ্রদ্ধা করবে নিজ ঐতিহ্যকে। হয়তোবা অর্থের লোভে আপন জাতির গৌরবের বস্তু পুরাকীর্তি পাচারের মতো হীন কাজ আর করবে না।