কানাডায় আমাদের রমজান 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

কানাডার হ্যালিফ্যাক্স শহরে কমিউনিটি ইফতারে প্রবাসীরাছবি: লেখক

দুপুরের খাবারের সময় আমি সাধারণত খেতে খেতে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করি। এরপর আবহাওয়া ভালো থাকলে বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আসি। রোজার মাসে সময় কাটানো সমস্যা। তার ওপর গত কয়েক দিনের আবহাওয়া খুব বাজে। অন্তত বাইরে হাঁটাহাঁটি করার মতো নয়। রমজান মাস এলে দেশে থাকা মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কথা বেশি বেশি মনে পড়ে। মনটা ভার হয়ে থাকে।

১৯ মার্চ ইফতারের সময় হতেই অজু করে অফিসের প্রেয়ারবুথে নামাজ পড়ে নিলাম। সেখানে জায়নামাজ পাতা থাকলেও লেখা আছে যে যার জায়নামাজ যেন নিয়ে যায়। কোভিডের সময় লাগানো নোটিশটা সম্ভবত আর নামানো হয়নি।

আগে থেকেই মসজিদের কমিউনিটি ইফতারে পুরো পরিবারের নাম নিবন্ধন করে রেখেছিলাম। সেখানে চিকেন অ্যান্ড রাইসের সঙ্গে সালাদের কম্বিনেশনটা ছিল দারুণ। ছেলেমেয়েদের আলাদা বসার সুন্দর ব্যবস্থা। ফ্রি ইফতার হওয়ায় অতিথি বেড়ে গেলেও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রচেষ্টায় আয়োজন ছিল নিখুঁত। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ইফতার করছিলাম। কানাডায় নয়, বাংলাদেশের ইফতার মাহফিলে ফিরে গেছিলাম যেন।

আমি ঢাকার ছেলে। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। এইচএসসি পাস করেই বাড়াবাড়ি রকমের একটা আবদার করে বসলাম, আমাকে বিদেশে পড়তে পাঠাতে হবে। বাবা তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্যে কষ্ট করে হলেও ছেলের আবদার রেখেছিলেন। আমাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরে যাই। দীর্ঘ ১২ বছর দেশে কাটিয়ে গত বছর আবারও পাড়ি জমিয়েছি কানাডার হ্যালিফেক্স শহরে। এটা নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের রাজধানী। এর মধ্যেই কৈশোরের রঙিন চশমা খুলে চোখে তুলে নিয়েছি মধ্যবয়সী চশমা। দুই সন্তানের বাবা হয়েছি। তাই প্রবাসে রমজান আমার জন্য পুরোনো হলেও এবার নতুন দৃষ্টিতে দেখছি, অনুভব করছি।

আমেরিকাকে বহুসংস্কৃতির মেল্টিং পট বলা হলেও কানাডাকে বলা হয় মোজেইক। কানাডায় সব সংস্কৃতি সহাবস্থান করে, কিন্তু একটা আরেকটার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় না। তাই এখানে প্রায় সব দেশের জনপ্রিয় খাবারের রেস্তোরাঁ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। তবে হালাল খাবার খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হয়। আবার মসজিদগুলোতে বিভিন্ন দেশের মানুষ একেক দিন ইফতার করায়। তাই একেক দিন একেক দেশের মুখরোচক ইফতারিতে রোজা ভাঙা যায়।

প্রায় সব ধরনের বাংলাদেশি ইফতারির আইটেম—যেমন চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি, হালিম, দইবড়া, কাবাব, পেস্তাবাদামের শরবত ইত্যাদি আপু-ভাবিরা বাসায় বানিয়ে বিক্রি করেন। আমরা অবশ্য বাসায় বানানো ইফতারিই বেশি পছন্দ করি। সেই তালিকায় দেশি ইফতারিই বেশি প্রাধান্য। ভাজাপোড়ার পাশে থাকে বিভিন্ন ঘ্রাণের দই, ফল আর জুস।

২০ মার্চ ছুটি নিয়েছিলাম। আমাদের রান্না করতে কষ্ট হবে ভেবে কয়েকজন কাছের বন্ধুবান্ধব বাসায় খাবার দিতে চাইছিল। পরে এক প্রতিবেশী (এখানে আমরা ভারতীয়দের এই নামেই ডাকি) অনেকটা জোর করেই আমাদের খাবার দিয়ে গেল। আমার স্ত্রী মিলি ঠিক করে রেখেছিল পরদিন ওদের বাংলাদেশি ইফতারি খাওয়াবে। কেনাকাটা করতে গিয়ে সব জায়গায় ‘রমজান মোবারক’–এর সাইন দেখে মনে হচ্ছিল সেগুলো আমাদের জন্যই লাগানো হয়েছে। বাসায় ফিরেই মিলি কাজে নেমে পড়ল। প্রথম দিন বিল্ডিংয়ের এমন চারটি মুসলিম পরিবারকে ইফতারি দেওয়ার ইচ্ছা আল্লাহ পূরণ করেছেন, যারা চারটি ভিন্ন দেশের। মিলির খুশি দেখে কে?

এর মধ্যেই ইউটিউবে মসজিদে দেওয়া লাইভ আজান দেখে রোজা ভাঙলাম।

এশার সময় মসজিদে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। প্রচণ্ড ঠান্ডা। তার ওপর আবার থেকে থেকে তুষারপাত হচ্ছে। তারপরও অনেক দূরে গাড়ি পার্ক করতে হয়েছে। মসজিদ পুরো ভরে গেছে। যে ধর্ম পালন করতে চায়, আল্লাহ তাকে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন—সেটা পৃথিবীর যেখানেই হোক।

বলে রাখি, আমরা ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম ক্রিসমাস উপলক্ষে কেনাকাটার উৎসব শুরু হওয়ার সময় থেকেই। বাচ্চাদের মনে ঈদের প্রভাব যাতে কমে না যায়, সে কারণে আমাদের মতো আরও অনেক প্রবাসী মা–বাবাই ঈদে বাচ্চাদের অনেক উপহার কিনে দেন। বাসা সাজানো হয় রমজান আর ঈদের জন্য তৈরি বিভিন্ন সাজসজ্জা দিয়ে। আমরাও বাচ্চাদের জন্য পাঞ্জাবি ও খেলনা কিনে রেখেছি ঈদের দিন দেব বলে।