ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ: যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকার পর দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনমত জরিপের সব পূর্বাভাস পাল্টে দিয়ে বড় ব্যবধানে বিজয় অর্জন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নানা কারণে সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনের দিকে ছিল পুরো বিশ্বের নজর। ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও মার্কিন শাসনের সর্বোচ্চ আসনে বসবেন।
নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতিতে অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোর পাশাপাশি বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিশেষত অভিবাসন, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ এবং বৈদেশিক নীতিতে তাঁর অবস্থান নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করেছে। ট্রাম্পের এই বিজয়কে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে নতুন এক প্রত্যাশার সঞ্চার করেছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন নীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে, যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
ট্রাম্পের অন্যতম আলোচিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত বহিষ্কার এবং সীমান্ত নিরাপত্তায় কড়াকড়ি আরোপ। ওভাল অফিসে বসার পর ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা মার্কিন বহুজাতিক সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ এবং বৈষম্যের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অভিবাসন নীতিতে এ ধরনের কঠোরতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত বহুজাতিক পরিচিতি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ ছাড়া সীমান্তে সামরিক তহবিল ব্যবহার করে অভিবাসন আটক কেন্দ্রে আরও নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করতে পারে, যা অভিবাসনপ্রত্যাশী সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বিচার বিভাগকে আরও রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করে প্রশাসনিক কাঠামোকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করার পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। তিনি বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরে তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্রদের নিয়োগ দিতে পারেন, যা মার্কিন শাসনব্যবস্থার স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য যে নীতিগুলো বরাবর অনুসরণ করা হয়েছে, সেগুলোর ওপর এবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আসতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন। ট্রাম্প যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে, তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা কমে যেতে পারে এবং প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের ধারণা হুমকির মুখে পড়বে।
ট্রাম্প প্রশাসন দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে। দেশীয় শিল্পকে রক্ষার জন্য তিনি আমদানি পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদকদের জন্য লাভজনক হতে পারে। তবে এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে এবং চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কে অস্থিরতা বাড়াতে পারে। এ ছাড়া তাঁর কর-কাটের পরিকল্পনাও বিশেষ মনোযোগের বিষয়। কর হ্রাস এবং সামাজিক নিরাপত্তা–সুবিধায় কম কর আরোপের প্রতিশ্রুতি বাজেটে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমজীবী জনগণের জন্য নেতিবাচক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপগুলো দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন জনগণের জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিতে অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দ্রুত সমাধান। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে দ্রুত সমঝোতার মাধ্যমে মার্কিন সমর্থন সরিয়ে নিতে পারেন, যা ইউক্রেন এবং ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই উদ্যোগটি মার্কিন-ইউরোপীয় সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষত ইসরায়েল ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কেও ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। পূর্বের মেয়াদে ইসরায়েলকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়েছিলেন ট্রাম্প, যা ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছিল। এবারের মেয়াদে তিনি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি আরব মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতি মুসলিম এবং আরব-মুসলিম ভোটারদের সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজয় ভাষণে তিনি মুসলিম এবং আরব-মুসলিম ভোটারদের প্রশংসা করেছেন, যা তাঁর বিদেশ নীতিতে নতুন দিকনির্দেশ করতে পারে। এতে অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্পের হাত ধরে হয়তো ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ সমাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বিশেষত তাঁর আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহের ফলে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মুসলিম বিশ্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সংবিধান এবং নাগরিক অধিকার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা রক্ষায় ট্রাম্পের নীতিগুলো আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি তাঁর প্রশাসন উগ্র ও একপেশে হয়ে ওঠে, তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন জনগণ, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন জরুরি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। মার্কিন প্রশাসনের সম্ভাব্য অন্যায্য নীতি এবং পদক্ষেপগুলোর ওপর নজরদারি রাখতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে।
বিশ্বরাজনীতির এই ক্রান্তিকালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও সতর্ক দৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মুক্ত সমাজের রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। মোটকথা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ যুক্তরাষ্ট্র এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা হতে চলেছে। বিশেষ করে যখন ব্যক্তি ট্রাম্প, তখন তাঁকে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করা ঠিক হবে না।
*লেখক: সৈয়দ আতিকুর রব