ঢাকার চোখে মেলবোর্নের গ্রাফিতি

মধ্য নব্বই থেকে বেড়ে ওঠা ইংরেজি চলচ্চিত্রের দর্শকদের জন্য পরিচিত একটা দৃশ্য হলো চলচ্চিত্রে অনুন্নত বা অধঃপতিত এলাকার দৃশ্যায়ন মানেই বিভিন্ন দেয়ালে কালি দিয়ে আঁকিবুঁকি। সে থেকেই মনের মধ্যে ধারণার জন্ম নেয়, দেয়ালে এমন আঁকাআঁকি হলো একটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আর এটা দেখা যায় মূলত অপরাধপ্রবণ এলাকায়।
বস্তুত এই আঁকাআঁকির পোশাকি নাম ‘গ্রাফিতি’। গ্রাফিতি হলো একধরনের ভিজ্যুয়াল আর্ট বা শিল্পকলার মাধ্যম, যেখানে জনসমক্ষে দেয়াল বা অন্যান্য পৃষ্ঠতলে পেইন্ট, মার্কার বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে ছবি আঁকা বা লেখা হয়। এটি বহুপ্রাচীন একটি শিল্পরূপ, যা রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।

গ্রাফিতি সাধারণত পথেঘাটে, বিল্ডিংয়ের দেয়ালে, ট্রেন ও অন্যান্য পাবলিক স্থানে দেখা যায়। এটি অনেক সময় বিক্ষোভ, সমালোচনা, সামাজিক বার্তা, অথবা শুধু সৃজনশীল প্রকাশের জন্য তৈরি হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি অবৈধ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষত যদি এটি অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত বা পাবলিক সম্পত্তিতে করা হয়।

বাংলাদেশ গ্রাফিতির সাথে খুব বেশি সময় ধরে পরিচিত নয়। তাই সে চোখে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রাফিতির শহর মেলবোর্নে উপস্থিত হলাম যখন, তা ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করল।

গ্রাফিতি কত বড় আকার মেনে তৈরি করা হবে, তার সাথে রাস্তায় যানবাহনের গতির একটা সম্পর্ক আছে। যে রাস্তায় সব সময়ই দ্রুতগতিতে যানবাহন চলে, সেখানে ছোট বা ডিটেইল-ওয়ার্ক করা গ্রাফিতি দৃশ্যমান হওয়ার আগেই হারিয়ে যাবে। তাই মেলবোর্নের চলার পথের গ্রাফিতি এবং মহাসড়কের গ্রাফিতির আঁকার ক্ষেত্রে রঙের ব্যবহার, আকার-আকৃতি এবং ধরনের ভিন্নতা চোখে পড়ে। দ্রুতগতির মহাসড়কের দুপাশের গ্রাফিতিগুলো আকারে বড়, উজ্জ্বল রঙিন এবং ছবি অথবা এক শব্দকেন্দ্রিক। অপর দিকে একটু ধীরগতির পথগুলোতে গ্রাফিতি অনেকটা বক্তব্যধর্মী।

বাংলাদেশে সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পুরো ঢাকায় নতুন করে আমাদের যা দিয়েছে তা হলো, প্রথাগত স্লোগানভিত্তিক দেয়াললিখন থেকে বের হয়ে গ্রাফিতি। সেই অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখলে গ্রাফিতির রঙের ব্যবহার আবশ্যিকভাবেই মেলবোর্নের পথে পথে ভিন্নতার ছোঁয়ায় ভরপুর। কিছু ভিন্ন ধরনের রঙের কাজ রাতের আলোতেও আপনার নজর কাড়বে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ভিক্টোরিয়ায় প্রায়ই বৃষ্টি হয়। কিন্তু গ্রাফিতিগুলোকে মলিন হতে দেখি না। আবার এগুলোয় রঙের ওপর রং চড়ানো হয় নিয়ম করে, এমনটাও দেখি না। গ্রাফিতির শহর মেলবোর্ন এখনো আমাকে কোনো শিল্পীর মুখোমুখি করেনি যাঁকে দেখেছি আঁকতে।

দেখা হলে বাংলাদেশের গ্রাফিতি অবশ্যই দেখাব তাকে।

মেলবোর্নজুড়ে গ্রাফিতি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি এক মাসজুড়ে। প্রতিবারই আমার দেশি মন মিল খুঁজতে চেয়েছে ‘আঁকার কারণ’ ও ‘আঁকার বিষয়’ নিয়ে। এখানে উঠে এসেছে বক্তব্য, মন্তব্য, স্থানের বৈশিষ্ট্য (যেমন সাইকেল চালনার জনপ্রিয় স্থান), কখনো অ্যাবোরিজিন (অস্ট্রেলিয়ার ভৌগোলিক এলাকার আদিবাসী জনগণ) সংস্কৃতি ও শিল্প।
চিত্রশিল্পের একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যেমন সুরের। শুধু তাকিয়ে দেখতে হবে এবং উপভোগ করতে হবে। পাহাড় ও সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানুষের তৈরি গ্রাফিতিও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আপনার জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে।

  • লেখক: সামিউল মাশুক এন্টনি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]