যেন পৃথিবীর মাঝেই এক স্বর্গ
সুইজারল্যান্ডে জীবনে বহুবার এসেছি; তবে এবারের আসা বেশ ভিন্ন। প্রায় তিন যুগ পর এই প্রথম আমি, আমার স্ত্রী মারিয়া ও তাঁর বোনের মেয়ে হেলেনা একসঙ্গে ঘুরব। মারিয়া-হেলেনা সমবয়সী। ১৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আমরা জুরিক বিমানবন্দরে নামি। হেলেনা এসেছিল আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। হেলেনার স্বামী মার্কিন; তাঁদের এক ছেলে এবং সবাই প্রতিষ্ঠিত।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখে হেলেনার বাড়ির ছাদের নিচে কাচের জানালার ওপর কখনো মুষলধারে কখনো রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। তখনো সিদ্ধান্ত নিইনি কখন এবং কোথায় বেড়াতে যাব। হঠাৎ চা নিয়ে হেলেনা এসে হাজির। জানতে চাইল আজ কী করব, কোথায় যাব ইত্যাদি। উত্তরে মারিয়া বলল, ‘আজ সারা দিন আমরা জুরিখ শহরে সময় কাটাব এবং সন্ধ্যায় শহরে ডিনার সেরে তবেই বাসায় ফিরব।’ কিছুক্ষণ পর সবাই শহরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। কত দিন পর দেখা, যেতে যেতে পথে কত কথা! শহরে ঢুকে অলিগলি ঘোরা হলো, ভিডিও করলাম বাকিদের জন্য, যারা হয়তো কোনো দিন আসতে পারবে না।
অনেকবার ভাবনায় ঢুকেছে বিশ্বের কত মানুষের রিজিক মেরে একদল দুর্নীতিবাজ এখানকার ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রেখেছে। জিনিসের যে দাম তাতে বুঝতে অসুবিধা হলো না। কারণ দুর্নীতির টাকা খরচ করতে সমস্যা কোথায়? আমরা কেনাকাটা করতে শহরে আসিনি, এসেছি শহর ঘুরে দেখতে, শহরের কথা জানতে। শহর বয়ে চলেছে সিন নদী, কী চমৎকার পরিষ্কার পানি!
আমরা শহর ঘুরছি, কিছুক্ষণ পর ফিফার প্রধান কার্যালয়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল মেয়েদের ফুটবলে অংশগ্রহণ না করতে পারার কারণের কথা। কী করব দুশ্চিন্তা করতে চাই না, তারপরও যখন সিন নদী, ফিফা অফিস নজর কাড়ল, তখনই স্মৃতির জানালা খুলে গেল। আর মনে পড়ে গেল বুড়িগঙ্গা আর দেশের ফুটবলের করুণ পরিণতির কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল, শেষে শহর ছেড়ে জুরিখ লেকের দিকে চলে গেলাম আমরা। এখানে দেখি একঝাঁক রাজহাঁস, কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে লঞ্চে করে চলে গেলাম হ্রদ ভ্রমণে।
দেখতে দেখতে হঠাৎ লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়ল। সন্ধ্যাকালীন কার্যক্রম শুরু হলো আমাদের। ডিনারে এসে যোগ দিল হেলেনার স্বামী এবং ছেলে উদি। উদি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী। এ কথা সে কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করলাম তার প্রেমের কথা। শুরু হলো নতুন প্রজন্মের বিরহ-বিচ্ছেদ, ভাঙাগড়ার গল্প। অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি ভাবি যে যুগে আমরা বসবাস করছি সে যুগে সবকিছু ডিজিটাল, সে ক্ষেত্রে সম্পর্কও। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মতো যাচাই-বাছাই করে সম্পর্ক করছে। তবু ঘর বাঁধতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। উদির প্রেমিকার সঙ্গে তিন বছরের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কথায় মনে হলো তারা একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। কারণ তারা জানে না আসলে তারা কী চায়! বাড়ির মুরব্বিরাই যখন কনফিউজড, তখন তরুণদের কী দোষ! এদিকে রাত প্রায় ১২টা বাজে। তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরলাম সকালে যেতে হবে রাইনফল (Rheinfall) দেখতে।
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্নাদের সেই গান, ‘ঝরনা কেমনে হয় নদী, সাগর না ডাকে কভু যদি, তাই যেতে যেতে থামল সে বয়ে চলল না’—এ কথার মিল পাওয়া গেল সুইজারল্যান্ডের উঁচু পাহাড় থেকে ঝরনা যখন জমে জমে ছোট–বড় হ্রদে পরিণত হয়ে আছে সে দৃশ্য দেখে। লিন্ডট লেক (Lindt lake) তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তা ছাড়া অনেক ছোট–বড় হ্রদে ভরা সুইজারল্যান্ড, যা দেখলে সত্যি মন ভরে যায়। এই লিন্ডট লেকের নামে নামকরণ করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত সুইস চকলেটের। লিন্ডট চকলেট ছাড়াও কিন্তু তাদের আরেকটি চকলেট রয়েছে, যা মূলত ডমেস্টিক এবং বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে কেনা সম্ভব। স্প্রুংলি চকলেট সুইজারল্যান্ডের প্রিমিয়াম চকলেট নামে পরিচিত।
সুইজারল্যান্ডের পাহাড় উঁচু হওয়ায় এর মাথায় মেঘ আটকে যায়। পরে সেই মেঘ গলে ঝরনা হয়ে নেমে আসে নিচে এবং কখনো সে ঝরনা গিয়ে মেশে নদীতে এবং শেষে সাগরে। মজার ঘটনা হলো ইউরোপের সবচেয়ে বড় নদী যার নাম রাইন রিভার (Rhein river)। এই নদীটি বয়ে চলেছে ইউরোপের নানা দেশের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে সুইজারল্যান্ড অন্যতম। রাইন রিভার যেতে যেতে পথে জুরিখের অদূরে এসে হঠাৎ ঢলে পড়েছে। মূলত সেই সৌন্দর্য দেখতেই আমি, মারিয়া এবং হেলেনা এসেছিলাম রাইনফল দেখতে। পুরো দিনটাই কেটেছিল মনোমুগ্ধকর পরিবেশে।
সুইজারল্যান্ড দেশটি কিন্তু আয়তনে বাংলাদেশের অর্ধেক। তার মধ্যে ৪০ শতাংশই বড় বড় পাহাড়। পাহাড়ের মাঝখানে ছোট–বড় হ্রদ, হ্রদ ভরা পানি, পানি তো নয় যেন অমৃত। দেশটির চারপাশ দিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং সেসব দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যজুড়ে পুরো দেশটি। তারপরও কী সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিজেদের মতো করে বসবাসের উপযোগী করেছে, যা দেখলে মন সত্যিই ভরে যায়। কোনো বর্ডার গার্ড নেই, কেউ দেশের সম্পদ পাচার করে দেশটাকে দেউলিয়া করছে না। বরং দেখে মনে হলো যেন বিশ্বমেলা বসেছে, কোন অংশ কত সুন্দর এবং কে কত উন্নত, সেটাই দেখাতে তারা ব্যস্ত।
পুরো সুইজারল্যান্ড সত্যি একটি অপূর্ব সুন্দর দেশ। তবে জিনিসপত্রের দাম খুব চড়া। এদের কাছে তেমন চড়া বলে মনে হলো না। কারণ সবারই ভালো বেতন। কিন্তু আমরা যারা ট্যুরিস্ট, আমাদের পক্ষে এখানে বেশি দিন থাকা সম্ভব না। তারপর ছুটিও শেষ। অতএব আগামীকাল দুপুরে সুইডেনের উদ্দেশে আমাদের রওনা দিতে হবে।
আজ আমাদের সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের চতুর্থ দিন। আজ হেলেনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের মুসহা (Moosach, Switzerland) নিয়ে যাবে। দেড় ঘণ্টার গাড়ি ভ্রমণ বটে, তবে চোখ বন্ধ করার কোনো উপায় ছিল না। পর্বতের পর পর্বত তারপর পাহাড় থেকে ঝরনা বয়ে যে পরিষ্কার পানি গড়িয়ে নিচে জমা হয়েছে, তা দেখলেই কিন্তু মন ভরে যায়। তারপর কী চমৎকার পাহাড়ের দৃশ্য, যা শুধু মন ভরানো সৌন্দর্য নয়, যেন পৃথিবীর মাঝেই এক স্বর্গ।
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।