ধ্বংসস্তূপের নিচে জাগরণ: মুসলিম বিশ্বের পতন ও আমেরিকার উত্থানের নেপথ্য ইতিহাস

দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা গাজায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। ছবিটি খান ইউনিসেরফাইল ছবি: রয়টার্স

ইতিহাস শুধুই স্মৃতি নয়; এটি ভবিষ্যতের দিশারি। একদা যে মুসলিম উম্মাহ বিশ্বের মানচিত্রে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিল, আজ তার অনেকাংশই পরাধীনতা, দারিদ্র্য ও দুর্বলতার নিগড়ে আবদ্ধ। এই পতনের পেছনে যেমন ছিল বাহ্যিক আগ্রাসন, তেমনি ছিল অভ্যন্তরীণ গাফিলতি ও আত্মপরিচয়ের সংকট। বিশেষত, আমেরিকার চতুর কূটনৈতিক খেলা ও দখলদার মনোভাব আজ মুসলিম বিশ্বকে যে জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, তা কেবল ইতিহাসের বেদনার অংশ নয়, বরং ভবিষ্যতের হুঁশিয়ারিও।

ইতিহাস ঘাঁটলেই স্পষ্ট হয়, কীভাবে একের পর এক মুসলিম শক্তির পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশ্চিমা বিশ্বের সুপরিকল্পিত নীলনকশা। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন। সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স কৃত্রিমভাবে আরব ভূখণ্ডকে ভাগ করে নেয়, যার ফলে জন্ম নেয় মেরুদণ্ডহীন ছোট ছোট রাষ্ট্র, যাদের শাসকদের বৈধতা ছিল পশ্চিমাদের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি ছিল এ ভূখণ্ডে আমেরিকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অন্যতম চাল। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উইল নট বি ডেস্ট্রয়েড বাই দোজ হু ডু এভিল, বাট বাই দোজ হু ম্যাচ দেম উইদাউট ডুয়িং এনিথিং ।’—আজ মুসলিম বিশ্বের নিস্পৃহতাই যেন প্রমাণ করছে এই উক্তির বাস্তবতা।

১৯৫৩ সালে ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে সিআইএর মাধ্যমে সরিয়ে মার্কিনপন্থী স্বৈরাচারী শাহকে ক্ষমতায় বসানো হয়—এটি ছিল তেলনির্ভর ভূরাজনীতির নির্মম দৃষ্টান্ত। এরপর একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া—সবখানেই ‘সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের’ নামে ছড়িয়ে পড়ে বোমা, ড্রোন ও মৃত্যু।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

তবে আমেরিকা কখনো সরাসরি বন্দুক দিয়েই শাসন করেনি; তারা চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিম সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির সুনিপুণ অনুপ্রবেশ ঘটেছে শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। হলিউডের ন্যারেটিভ, সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্টতা, সোশ্যাল মিডিয়ার ফিল্টার বুদ্‌বুদের ভেতরে আটকে পড়া প্রজন্ম—সবই যেন নিখুঁতভাবে সাজানো এক মানসিক উপনিবেশ।

এই অবস্থার পেছনে মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ দূরদর্শিতার অভাবকেও দায়ী না করে উপায় নেই। সামরিকভাবে শক্তিশালী কিন্তু রাজনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রনায়ক, ধর্মীয় বিভাজনে বিভ্রান্ত জাতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থে পরিচালিত রাষ্ট্রনীতি আমাদের চিরকালই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ করেছে।

বিশ্লেষক এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ওরিয়েন্টালিজম-এ লিখেছেন, ‘দ্য ওয়েস্ট কনস্ট্রাকটেড অ্যান ইমেজ অব দ্য ইস্ট এজ ইরেশনাল, উইক, অ্যান্ড ফেমিনিন টু জাস্টিফাই ইটস ডোমিনেন্স ওভার ইট।’ এই নির্মাণ আজও বহাল আছে এবং তা সমুন্নত রাখতে পশ্চিমা শক্তিগুলো সদা সক্রিয়।

তবে সব ধ্বংসস্তূপই অনন্তকাল জিইয়ে থাকে না। ইতিহাস সাক্ষী, আন্দালুসের পতনের পরও মুসলিম বিশ্ব নবজাগরণের চেষ্টা করেছে। পতনের গভীর থেকে জেগে ওঠার শক্তি যদি কোথাও থাকে, তা আছে একতা, জ্ঞান ও নৈতিক নেতৃত্বে।

আজ প্রয়োজন সেই আত্মসচেতনতার, যা বুঝে নেয় যে পতন শুধু বাহ্যিক শক্তিতে ঘটে না, ঘটে ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়া বিশ্বাস ও চেতনায়। সেই চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে নতুন প্রজন্মের হাতে কলম ও অন্তরে দীপ্ত সাহস দিয়ে।

মুসলিম উম্মাহর জন্য সময় এসেছে—অতীতের গৌরবকে স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের নির্মাণে এক নতুন ইন্তিফাদার।

*লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিসর