আমার নিজস্ব একখণ্ড অপরাহ্ উইনফ্রে
আজ থেকে ১২ বছর আগে। দিনটি বিশেষ কারণেই বিশেষ ছিল। ২৫ মে, ২০১১, আমার মেয়ের চতুর্থ জন্মদিন। কিন্তু আমার মনটা সকাল থেকেই খুব খারাপ। কারণ, ওই দিনই শেষ হয়ে যাবে ‘অপরাহ্ শো’। ১৯৮৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছিল Syndicated Day time talk show ‘Oprah’। উইনফ্রে ২৫ সিজন, ৪৫৬১ এপিসোডের পর অপরাহ্ শোটি সেই দিন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এখন কথা হচ্ছে, শোটি শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমার এত বেশি মন খারাপ হওয়ার কারণ কী!
৩০-৩১ বছর আগে যখন গণমাধ্যমে আমার পথচলা শুরু হয়েছিল, প্রথমে বিচিত্রা ঈদ ফ্যাশনের মডেল হিসেবে এরপর ‘জীবন এখন যেমন’–এর লেখক। এরপর একে একে টিভি উপস্থাপক, বিনোদন সাংবাদিক, নাটক...নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, টক শো উপস্থাপক হয়েছি। সেই প্রথম দিকে যেমন ঠিক তেমন না বরং তার চেয়েও বেশি মনোযোগ এবং সতর্কতার সঙ্গে আমি আমার কাজটা করার চেষ্টা করে থাকি। সব কাজেই তা–ই। কিন্তু আমি নিজে বুঝি সাংবাদিকতাটাই আমার মূল সত্তা নাকি আমার মূলভিত্তি বলব।
২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে স্থায়ীভাবে থাকার সময় থেকে সপ্তাহের পাঁচ দিন বিকেল ৪টা থেকে ‘অপরাহ্’ শোটি দেখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কত রকম বিষয়, কত স্মার্ট আর ইউনিকভাবে তা উপস্থাপন, বিশাল সেট, অপরাহ্র দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাস, সেন্স অব হিউমার, বিষয় নির্বাচন, তাঁর সামাজিক কাজ, বিশেষ আফ্রিকান–আমেরিকানদের উন্নয়নে অপরাহ্র অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড, আমাকে খুবই আকর্ষণ করত।
আমি তার অন্ধভক্ত না বলা যায় সচেতন ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিজেই নিজেকে অপরাহ্র সবচেয়ে বড় ভক্ত ‘ঘোষণা’ করেছিলাম। এ কারণেই ওই দিন মনটা খুব খারাপ কারণ, ১০ বছরের অভ্যাস...বিকেলবেলা, অপরাহ্কে আর দেখা হবে না।
ওই দিন আমার মেয়ে লাবণ্য ঘুমাচ্ছে আর আমি দোতলায় ওর গেমরুমে বসে অপরাহ্র শেষ শোটি দেখছি। হঠাৎ হাতের কাজে রাখা ল্যাপটপে কিছু কথা লিখলাম অপরাহ্ উইনফ্রের প্রতি। মন খারাপের কথা, তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ভালো লাগার কথা। আমার রোল মডেলের হিসেবে তাঁকে কতটা ভালোবাসার জায়গায় বসিয়েছি, সে কথা।
অনুষ্ঠান দেখছি, অপরাহ্ জানালেন, অনুষ্ঠানটি শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি তিনি কীভাবে নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন। অদ্ভুত এক ব্যাখ্যা, সেটা জানাচ্ছি লেখার শেষ অংশে। অনুষ্ঠানের একদম শেষে জানানো হলো। একটি সংক্ষিপ্ত বিরতির পর তিনি নিজের নেটওয়ার্ক ‘জিরো’ (০)-তে যোগ দেবেন। ৫০ মিনিটের অনুষ্ঠান শেষ হলো, সবশেষে অপরাহ্র নতুন ই–মেইল আইডিটা জানানো হলো, যা এখান থেকে তিনি নিজে চালাবেন। আমি আমার লেখা নতুন সেই মেইলে পাঠালাম।
পরদিন ২৬ মে, দুপুর ১২টায় আমি চমকিত হলাম। কারণ, অপরাহ্ উইনফ্রে—আমার অনুকরণীয় ব্যক্তি—আমার মেইলের উত্তর দিয়েছেন। ছোট একটি মেইল, ‘Got your Email, thank you for watching the finale. I could feel your beating hearts, along with mine, through the Tv screen. I’m off to take a little rest, and then I’ll get busy working on own, take care of youself. I’ll write soon ‘Oprah.’
প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, বারবার পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বামীকে ফোন করলাম।
সে–ও খুব খুশি বলে উঠল, ‘আমি জানতাম।’ এ কথা কেন বলেছিল, এখনো জানি না। এরপর আবারও মেইল করলাম, উত্তর এল। অপরাহ্ তখন ছুটিতে। একটি রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে ‘চা’ খেতে খেতে ছোট্ট ইলেকট্রনিক চিঠিতে লিখেছিলেন, "I’ve been sitting in a cold, rainy, Chicago drinking Chai Tea (and yes splurged on a croissant) I hear so many of you saying you’re sad to see the show leave, Instead of sadness. I hope you will channeal the energy of hopefulness you received form the show in whatever form it gave to you. No sadness from me, I look forward to my next chapter on own.’ এভাবে বেশ কয়েক মাস কাটল। আমার ইলেকট্রনিক চিঠির উত্তরে এই বিশাল মানুষটির উত্তর। অদ্ভুত ব্যাপার।
লিখতেন অদ্ভুত সব কথা। এরপরের মেইলটি আসে ২ জুন। তখন তিনি ছুটিতে। লিখেছেন, ‘Now fainally away on vaca...Relaxing, Trying not to eat too much, but had 2 slices of the best pizza ever in life today, white truffle".
"My new ambition is to make a treasure, of the small moments.
All of your eamils are mini treasures.
As was that white truffle pizza-Oprah.
‘Happy 4th of July’—যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে পরের মেইলটি আসে জুলাই ৪। তখন মাত্র তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় তার ‘Girls enducation project’ পরিদর্শন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছেন।
সেখানে পুরো এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রাম অঞ্চলে তাঁর একাধিক গার্লস স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ঘুম থেকে ওটা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত। সেখানে মেয়েদের স্কুল গড়ে তোলা এবং পরিচালনাই না, অপরাহ্ সেখানে মেয়েদের ক্লাসও নেন বিশেষ বিশেষ সময়ে। তাঁর ক্লাসের নাম লাইফ ওয়ান জিরো ওয়ান। কী বিষয়ের ওপর ক্লাস? অপরাহ্ লিখেছেন, ‘All the stuff I wish someone had told me about how the world works’.
স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর অদ্ভুত সুন্দর কথা, ‘Nothing is like going out of country to have an even deeper appreciation for our own USA. The freedom to have options, something we often take for granted, is the most striking for me. I know the 4th of July has turned into picinc and fireworks and barbecue mornents. But its worthy of a pause, to think about what it really means to have freedom.
And while we’re pausing think about those who sacrifice to make it so.’
কত সুন্দর আর সর্বজনীন এক সত্য কথা। স্বাধীনতা দিবসে আনন্দ উদ্পাদনের সময় একটি মুহূর্তে চিন্তা করা আসলে স্বাধীনতা কি? আর এই স্বাধীনতা যাঁদের ত্যাগের কারণে তাঁদের কথাও দুদণ্ড ভাবা।
‘Go with flow’ মেইলটি আসে ১৩ জুলাই। এখানে অপরাহ্ তাঁর নতুন করে জীবনের ছোটখাটো অথবা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মনোযোগ না পাওয়া বিষয়গুলো শেখার ব্যাপারে লিখেছেন। যেমন সাইক্লিং, সুইমিংয়ের সব মাস্টারিং। আরেকটি কথা লেখেন, অপরাহ্ শোর ৪ হাজার ৫০০টি শো থেকে ১০০টি শো বেছে একটি সংকলন তৈরি করেছেন, যেখানে তাঁর ভাষায়, ‘The 100 best lessons I’ve learned about everything that can help you live a better life’.
টাটকা শাকসবজির বাগান করার কথা। দীর্ঘ জীবনের লিভ ইন বয়ফ্রেন্ড স্টেডমেন-এর জন্য রান্না করার কথা এবং শেষ করেন অচিরেই টাসক্যানি কুকিংয়ের ওপর কোর্স করার ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে।
এরপর ‘lifeclass’ “See you on Monday night.”
“you become what you believe” শিরোনামে কয়েকটি মেইল আসে। আমি খুবই ভালো শিক্ষার্থী অথবা ভক্তের মতো প্রতিটি ই–মেইলের উত্তর দিচ্ছিলাম। কী সুন্দর সব কথা, আর দর্শন আর উদাহরণ। শেষ ই–মেইলটি আসে ৩০ ডিসেম্বর। ‘Next Chapter’ নামে অনেক কথা অদ্ভুত সুন্দর সব কথা, দর্শন। এর মধ্যে “Every problem has spiritual lesson, get the lesson, life gets better. Don’t get it, and the lessons get harder.
Stop resisting what is, Either change it or find a way to move with the flow”.
এই মেইলে অপরাহ্ জানিয়েছিলেন, আর মেইলে না এবার থেকে দেখা হবে, Own–এর তার নতুন শোতে Oprah wintrey–এর লেখা সেই ইলেকট্রনিক চিঠিগুলো আমার কাছে যত্নে রাখা আছে। কাছের কয়েকজনকে বলেছি সে কথা।
একদিন প্রথম আলোর অফিসে বসে কথাটি হয়েছিল প্রিয় লেখক বন্ধুসম আনিসুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, এটা নিয়ে একটা লেখা দেন আমাদের পত্রিকার জন্য।
আমি বললাম, ‘নাহ, এটা আমার খুব নিজস্ব কিছু।’ উনি একদম সরল মুখে বললেন, ‘লিখলেও তো আপনারই থাকবে।’
দুই বছর পর এসে মনে হলো তিনি (আনিসুল হক) ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই তো আনন্দ শেয়ার করলে তো বাড়ে, কমে না। তাই আমার নিজস্ব আনন্দটি বাড়ালাম, এই লেখায়। এরপরও আবার রেখে দিলাম তিন বছর। এবার ওই ঘটনার ১২ বছর হচ্ছে। মনে হলো এবার না হয় প্রকাশিত হোক।
অপরাহ্ উইনফ্রের শো দেখা, তাঁর লেখা পড়া বা কোনো বিখ্যাত মানুষের নেওয়া ইন্টারভিউ দেখা একধরনের শিখন অভিজ্ঞতা। কিন্তু তিনি নিজেও তো শেখেন, অনুপ্রেরণা দেন, নতুন দিকনির্দেশনা পান কোথাও না কোথাও থেকে, কারও না কারও কাছ থেকে। সে রকম একটি বিষয়। অপরাহ্র ম্যাগাজিন ‘O’-এর এডিটোরিয়াল ‘What I know for Sure’-এ লিখেছেন। এ ছাড়া হ্যারি পটারের জে কে রাওলিংয়ের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন ২০১০ সালে স্কটল্যান্ডের এক প্রাসাদে বসে।
সেখানে তাঁরা দুজনেই পুরোনো সাফল্য ছেড়ে নতুন যাত্রা শুরু করা নিয়ে সুন্দর কথা আলোচনা করেছিলেন। এর মূল কথা ছিল ‘The time is right for the end of this story of Michial Jackson and Making of Thriller’–এর লেখক লিখেছিলেন, নাম্বার ওয়ান সেলিং অ্যালবাম of All Time, যখন মাইকেল জ্যাকসন তৈরি করেছিলেন, তখন এবং পরে সারা জীবনেও বুঝতে পারেননি যে আরেকটি ‘থ্রিলার’ বানানো সম্ভব না। কিন্তু সারা জীবন ধরে ওই চেষ্টায় ওই সাফল্যের পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। আরেকটি ‘থ্রিলার’ হয়নি। এরপর তিনি আবারও চেষ্টা করেছেন, আবারও...আবারও।
এ লেখাটি পড়ে অপরাহ্ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর শোতে তাঁর জীবনের phenomena...তাঁর জীবনের বিস্ময়কর সৃষ্টি। কিন্তু তার মানেই এই না যে তিনি তাতে সারা জীবন থাকবেন অথবা একই ব্যাপার বারবার তৈরি করতে চাইবেন। একই ভাবনা থেকে জে কে রাউলিং ‘হ্যারি পটার’ সিরিজটিও শেষ করে দেন। তাঁরা দুজনেই বলেছেন, ‘I have to go to the Next chapter of life what ever it is.’
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যখন এ ভাবনাটিতে নিজেকে আশ্বস্ত করতে পারেন, তখনই তাঁরা নতুন সৃষ্টিতে আবারও মেতে উঠতে পারেন। আহ্, কত সুন্দর ভাবনা। অপরাহ্ তাঁর শেষ অনুষ্ঠানে শেষ প্রান্তে এসে আরেকটি সুন্দর কথা বলেছিলেন, ‘Your life is talking to you...listen to it. Your life is speaking to you, what does it say...?’
জীবন কিছু জানায়, বলে, দিকনির্দেশনা দেয়—শুধু আমরাই হয়তো তা বুঝে নিতে ভুল করি।
**দূরপরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected] এ