শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ৬ষ্ঠ বর্ষপূর্তিতে ফিরে দেখা...

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে বাংলা শিল্প-সাহিত্যচর্চার অন্যতম প্রধান স্থান কানাডার টরন্টো নগরী। আক্ষরিক অর্থেই বহুজাতিক এ মহানগরীতে বহু ভাষাভাষী মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রাত্যহিকতার পাশাপাশি যুক্ত থাকেন বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, যার ফলে টরন্টো ‘এ সিটি অব ফেস্টিভ্যালস’ তকমাটি অর্জন করেছে। বাঙালিদের পক্ষ থেকে এ নগরীকে যেসব সংগঠন আলোকিত করছে, তাদের মধ্যে ‘পাঠশালা’র নাম চলে আসে প্রথম সারিতে। ছয় বছরের যাত্রায় শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’ বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

‘পাঠশালা’ প্রতি মাসে সাধারণত একটি আসরের আয়োজন করে। সেই আসরে শিল্প-সাহিত্যের কোনো সুনির্বাচিত বিষয়ে একজন জ্ঞানঋদ্ধ আলোচক অংশগ্রহণ করেন। এ মাসিক অধিবেশনের প্রতিটি পর্বে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক বা একাধিক বইয়ের আলোচনা থাকে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘পাঠশালা’ প্রথম আসরের আয়োজন করে। তারপর এই ছয় বছরে সংগঠনটি প্রায় পঞ্চাশটি আসরের আয়োজন করেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। মানুষকে গ্রন্থাগারমুখী করার অভিপ্রায়ে টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘পাঠশালা’র মাসিক আসর আয়োজিত হয়ে এসেছে।

‘পাঠশালা’র আসরের বিষয় নির্বাচনে আছে মননশীলতা ও প্রাসঙ্গিকতা। সংগঠনটির ছয় বছরের যাত্রাপথে উঠে এসেছে সাহিত্য, সংগীত, ভাষা, শিল্প, আন্দোলন, রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয়গুলো। শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার প্ল্যাটফর্মটি আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমানবতার আঙিনায়, ইতিহাস-উপেক্ষিত নানা বিষয়ে ক্রমাগত আলোকপাত করে চলেছে।

২০২০ সাল ছিল ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ। এ উপলক্ষে ‘পাঠশালা’ দুটো আসরের আয়োজন করে। এঙ্গেলসের জন্য নিবেদিত আসরে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘দ্য অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন সমাজসচেতন গল্পকার মোহাম্মদ ইরফান। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্মরণ-আসরে তাঁর অনূদিত অমর গ্রন্থ ‘শকুন্তলা’ নিয়ে আদ্যেপান্ত আলোচনা করেন বর্তমান বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।  

পঞ্চকবির অন্যতম অতুলপ্রসাদ সেনের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে লেখা কয়েকটি বই নিয়ে আলোচনা করেন ভাষাবিদ ও সংগীত সংগ্রাহক রাজীব চক্রবর্তী। একই আসরে অতুলপ্রসাদী গান পরিবেশন করেন গুণী সংগীতশিল্পী ইলোরা আহমেদ শুক্লা।

ছবি: সংগৃহীত

জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে ‘পাঠশালা’ মোট ১৩টি আসরের আয়োজন করে। এ আসরগুলোয় বাংলা ও বিশ্বের ক্ষণজন্মা চিত্রশিল্পী-সংগীতশিল্পী-চলচ্চিত্র নির্মাতা-রাষ্ট্রনায়ক, ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যুগান্তকারী রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থাপিত হয়। বাংলাদেশের চিত্রশিল্প যে প্রধান দুই চিত্রশিল্পীর হাত ধরে এগিয়ে এসেছিল, তাঁদের একজন পটুয়া কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষে ‘পাঠশালা’র এক ব্যতিক্রমী আয়োজন ছিল। এ আসরে তাঁর ওপর লেখা বই ‘লড়াকু পটুয়া’ নিয়ে সচিত্র আলোচনা করেন বইটির লেখক, ঔপন্যাসিক ও শিল্প সমালোচক হাসনাত আবদুল হাই। জন্মশতবর্ষের আরেক আসরে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুবিনয় রায়ের লেখা বই ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ সম্পর্কে বলেন রাজীব চক্রবর্তী। এর সঙ্গে প্রণম্য শিল্পীর কণ্ঠে গীত কয়েকটি স্বল্পশ্রুত গান পরিবেশন করেন নন্দিত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বুলবুল ইসলাম।

বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর লেখা বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’র ওপর ভিত্তি করে তথ্যবহুল আলোচনা করেন চলচ্চিত্র-গবেষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। ‘পাঠশালা’র আরেক আসরে বাংলা সংগীতের জগতের মহিরুহ অখিলবন্ধু ঘোষের সংগীত-সম্পদ ও জীবনালেখ্য তুলে ধরেন সংগীতবোদ্ধা রাজীব চক্রবর্তী। সেই সঙ্গে অখিলবন্ধুর গাওয়া প্রাণস্পর্শী কয়েকটি গান গেয়ে শোনান শিল্পী ও সংগীতের শিক্ষক সুমন চৌধুরী।

বাংলাদেশের প্রধানতম, প্রাচীনতম ও ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে এ জি স্টক রচিত এক অসাধারণ স্মৃতি-গ্রন্থ ‘মেমোয়ারস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ নিয়ে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

সেতার কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্করের জন্মশতবর্ষে তাঁর আত্মজীবনী ‘রাগ অনুরাগ’ বিষয়ে বলেন বাংলাদেশের পথিকৃৎ আবৃত্তিশিল্পী ও অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে এই আসরে রবিশঙ্করের পছন্দের কয়েকটি রাগের অংশবিশেষ সেতারে বাজান শিল্পী এবাদুল হক সৈকত। জন্মশতবর্ষের আরেক আসরে বাংলা আধুনিক সংগীতের বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’ নিয়ে আলোচনা করেন আবৃত্তিশিল্পী, লেখক ও সংগীতবোদ্ধা খসরু চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে ‘পাঠশালা’র আসরে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর ওপর আলোকপাত করেন টরন্টোর সুপরিচিত সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর। আরেকটি ভিন্ন স্বাদের আসরে আমেরিকার বিশ্বখ্যাত প্রতিবাদী, লোকসংগীতশিল্পী, গণনায়ক পিট সিগারের ওপর অ্যালান এম উইঙ্কলার-লিখিত ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ এ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ নিয়ে আলোচনা করেন মুস্তাফা মাহমুদ। আলোচনাটিতে শিল্পীর সুদীর্ঘ সংগীতজীবনের অংশবিশেষ ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। সিগারের বিখ্যাত ‘গুয়ানতানামেরা’ গানটি গেয়ে শোনান আলোচক।

বাংলা সংগীতের অন্য এক মহিরুহ মান্না দের জন্মশতবর্ষে তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন ‘জীবনের জলসাঘরে’-ভিত্তিক এক মনোমুগ্ধকর আলোচনায় শিল্পীর জীবন ও সংগীত উঠে আসে সংগীত ব্যক্তিত্ব ইখতিয়ার ওমরের কথায়।

ছবি: সংগৃহীত

যুগান্তকারী রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকীতে পাঠশালার আসরে দুটি বই জন রিডের ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ ও নিকোলাই চেরনিশেভস্কির ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ নিয়ে আলোচনা করা হয়। বই দুটির আলোচনায় ছিলেন সাবেক বামপন্থী ছাত্রনেতা নাসির উদ দুজা এবং আশানুর রহমান খোকন। ‘পাঠশালা’র শিল্পবিষয়ক আরেকটি আসর ছিল কানাডিয়ান আর্ট মুভমেন্টের পথিকৃৎ ‘গ্রুপ অব সেভেন’-এর শতবর্ষ উদ্‌যাপন। এ অনুষ্ঠানে ‘মিট দ্য গ্রুপ অব সেভেন’ বইটি নিয়ে সচিত্র আলোচনা করেন শিল্প সমালোচক নিলাদ্রী চাকী।

ছবি: সংগৃহীত

‘প্রমিত বাংলা—সংকট, সম্ভাবনা ও চর্চা’ এবং ‘বাংলা বর্ষপঞ্জি’র খুঁটিনাটি নিয়ে ‘পাঠশালা’ দুটি আসরের আয়োজন করে। আসর দুটি অলংকৃত করেন বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব ও বাংলা অভিধানের প্রণেতা জামিল চৌধুরী।

বিজয় দিবস উপলক্ষে পাঠশালার আয়োজনে তাজুল মোহাম্মদের লেখা ‘সিলেটে গণহত্যা’সহ বেশ কয়েকটি বইয়ের ওপর আলোকপাত করেন লেখক নিজে। এর আগের বছরের বিজয় দিবসের আসরে আর্চার কে ব্লাড-এর ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ বইটি নিয়ে বলেন কাজী জহির উদ্দিন এবং ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বিষয়ে আলোচনা করেন চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘পাঠশালা’র আয়োজনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচক ছিলেন তামান্না মাকসুদ পর্ণা এবং অতিথি-আলোচক ছিলেন জাহানারা ইমাম-তনয় সাইফ ইমাম জামী।  

‘পাঠশালা’র চারটি আসরে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। কবি পারভেজ চৌধুরী বলেন তাঁর অনূদিত গ্রন্থ ‘কানাডার সমকালীন কবিতা’ সম্পর্কে। কানাডার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক অ্যালিস মানরোর সেরা ছোটগল্প নিয়ে বলেন, অনুবাদক উম্মে কুলসুম রত্না। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আত্মজীবনী ‘কমন গ্রাউন্ড’-এর ওপর বক্তব্য দেন বইটির অনুবাদক মনিস রফিক। বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি ম্যারাডোনার আত্মজীবনী ‘ম্যরাডোনা: দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব সকার’স গ্রেটেস্ট অ্যান্ড মোস্ট কন্ট্রোভার্শিয়াল স্টার’ বিষয়ে আলোচনা করেন বইটির অনুবাদক শেখ রানা।

‘পাঠশালা’র দুটি আসরে স্বরচিত গ্রন্থ নিয়ে লেখক নিজেই আলোচনা করেন। এর মধ্যে একটি আরিফ আনোয়ারের ‘দ্য স্টর্ম’। অন্যটি মুনতাসির মামুনের ‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরন্টো: পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’। এ আলোচনায় মামুনের সঙ্গে ছিলেন অভিযাত্রী দলের অন্য দুই সদস্য কনক আদিত্য ও সারাহ-জেইন সল্টমার্শ। স্বরচিত কবিতা পাঠ এবং কবিতা নিয়ে আলোচনায় ‘পাঠশালা’র আসরে অংশ নেন বাংলাদেশ ও কানাডার দুই প্রথিতযশা কবি আসাদ চৌধুরী ও রিচার্ড গ্রিন। নিজের কণ্ঠে কবিতা পাঠ এবং কবিতা নিয়ে তাঁদের আলোচনা ঋদ্ধ করে উপস্থিত সবাইকে।    

স্টিফেন হকিংয়ের প্রয়াণের অব্যবহিত পরে পাঠশালার একটি আসরে তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ নিয়ে আলোচনা করেন বিজ্ঞানলেখক স্বপন বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এস এ করিম রচিত ‘শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি’র ওপর আলোকপাত করেন কাজী জহির উদ্দিন। অন্য একটি আসরে অরুন্ধতী রায়ের সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইটি সম্পর্কে বলেন সেরীন ফেরদৌস।  

‘বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধানে: ৫৮’র চারুকলা’ শিরোনামে আয়োজিত এক আসরে ‘পাঠশালা’ শিল্পী গোপেশ মালাকারকে আমন্ত্রণ জানায়। এমন এক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সরাসরি পঞ্চাশের দশকজুড়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চারুকলা ইনস্টিটিউটের অবদানের অনেক অজানা ইতিহাস শোনা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের সদ্য প্রয়াত ব্যতিক্রমী ভাস্কর ও অধ্যাপক শামীম সিকদার স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ও চারুকলার শিক্ষক নাসিমুল খবির ডিউক।

ছবি: সংগৃহীত

করোনা অতিমারির সময় থেকে ‘পাঠশালা’ তার প্রবহমানতা থামিয়ে না দিয়ে আন্তর্জালে নানা আসরের আয়োজন করে চলেছে। এই ভার্চ্যুয়াল পরিসরে ‘পাঠশালা’র বিস্তৃতি ঘটে সারা বিশ্বে এবং দেশ–বিদেশের ঋদ্ধ আলোচকদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয়। অতিমারির সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি আসরে সংকটকালীন অবরুদ্ধ মানবজীবন–সম্পর্কিত পাঁচটি ক্ল্যাসিকধর্মী সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়। ‘অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক: দ্য ডায়েরি অব এ ইয়াং গার্ল’, নোবেল বিজয়ী লেখক আলব্যের কাম্যুর ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’, নোবেল বিজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’ এবং এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’—এ পাঁচ কালজয়ী গ্রন্থ নিয়ে পাঁচটি আসরে আলোচনা করেন যথাক্রমে মাহরীন ফেরদৌস, সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ, সেরীন ফেরদৌস, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ও দীপেন ভট্টাচার্য।  

রবীন্দ্রনাথ–সম্পর্কিত পাঁচটি আসরের তিনটি ছিল তাঁর জন্মজয়ন্তী এবং দুটি প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে। ১৬০তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্রাবলী’ নিয়ে আলোচনা করেন রবীন্দ্র-গবেষক পীতম সেনগুপ্ত এবং সেই সময়কালে রচিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন গুণী শিল্পী শাহজাহান কামাল ও সেমন্তী মঞ্জরী। পরের বছরের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা’–সম্পর্কিত রচনার ওপর আলোকপাত করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার। ১৬২তম রবীন্দ্রজয়ন্তীর আসরে ‘রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার’ নিয়ে বলেন বইটির লেখক পীতম সেনগুপ্ত। এ আসরে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনান শিল্পী-সংগীতের শিক্ষক তানিয়া মান্নান ও মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত দুটি আসরের প্রথমটিতে ‘গোরা’র আলোচনায় ছিলেন লেখক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। পরেরটিতে ‘মুসলমানীর গল্প’ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক রচনা বিশ্লেষণ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি আসাদ চৌধুরী।  

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘বাংলা খেয়াল’ নিয়ে অসাধারণ এক আয়োজন করে ‘পাঠশালা’। এই মাইলফলক পর্বে বক্তা ছিলেন এ আলোচনার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি, জীবন্ত কিংবদন্তি কবীর সুমন। আলোচনার পাশাপাশি তাঁর রচিত বাংলা খেয়াল পরিবেশন ও প্রাসঙ্গিক আলাপচারিতা একাধারে মুগ্ধ ও ঋদ্ধ করে শ্রোতা-দর্শকদের।

বর্ষব্যাপী এসব নিয়মিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ পাঠশালার মুকুটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পালক যুক্ত হয়। উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে টরন্টোর জাপানিজ কানাডিয়ান কালচারাল সেন্টারের দুই দিনব্যাপী পঞ্চম বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশের স্থানীয় আয়োজকের দায়িত্ব পায় ‘পাঠশালা’। পাঠশালার পরিচালক ফারহানা আজিম শিউলী সমাবেশের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনাবাসী বাংলাভাষী লেখক, সাহিত্যিক ও সাহিত্যামোদীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সৃষ্টিশীল চর্চার সুযোগ তৈরি করা এ উদ্যোগের লক্ষ্য। প্রতিবারের মতো পঞ্চম সমাবেশেও স্বরচিত সাহিত্যপাঠ ও আলোচনা, সাহিত্যবিষয়ক প্যানেল, বই পরিচিতি ও প্রদর্শনী, সাহিত্য আড্ডা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল। অনাবাসী লেখকদের রচনা নিয়ে হৃদবাংলা নামের একটি সাহিত্য সংকলন এ সমাবেশে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও পাঠশালার পরিচিতিমূলক লেখা এবং বিজ্ঞাপন–সংবলিত স্যুভেনির। এ সাহিত্য সমাবেশের খবর বাংলাদেশের প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়।

ছবি: সংগৃহীত

‘পাঠশালা’ আয়োজিত আসরগুলোর আলোচনা সব সময় রেকর্ড করা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে একটি সংকলন বের করলে, সেটা হবে বাংলা শিল্প-সাহিত্যচর্চার এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল। নিয়মিত আসরের পাশাপাশি ‘ই-বুক’–এর ওপরও কাজ করছে ‘পাঠশালা’। ইতিমধ্যে সাতটি বিষয় নিয়ে ‘ই-বুক’ করা হয়েছে।
‘পাঠশালা’র প্রতিটি আসরে সূত্রধর ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন সংগঠনটির কর্ণধার ফারহানা আজিম শিউলী।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর ওপর মনিস রফিকের আলোচনা দিয়ে ‘পাঠশালা’র যে পথচলার শুরু, তা আজও অব্যাহত। প্রসঙ্গত, ইংরেজ কবি র‍্যালফ হগসনের ‘টাইম, ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। বিশ্ব-সময়ের পরিক্রমায় ‘টাইম’ নামের এই ‘ওল্ড জিপসি ম্যান’ তাঁর ক্যারাভানে ভ্রমণ করছেন স্মরণের অতীতকাল থেকে। তিনি যে জনপদে তাঁর ক্যারাভান থামিয়ে একটু বিশ্রাম নেন, সেই জনপদই জ্ঞান আর সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। ব্যাবিলনে তিনি যখন তাঁর ক্যারাভান থামিয়েছিলেন, ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল সেই জনপদ। ব্যাবিলনের পরে ক্যারাভানটি একসময় থেমেছিল এথেন্সে ও রোমে। রোমের প্রায় দুই হাজার বছর পরে সেই ‘ওল্ড জিপসি ম্যান’ তাঁর ক্যারাভান নিয়ে লন্ডন, নিউইয়র্ক ঘুরে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এসে থামবেন টরন্টোতে। আর তা কেবলই সম্ভব হবে ‘পাঠশালা’র মতো শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্রবহমান কোনো প্ল্যাটফর্মের হাত ধরে।