অচিন পাখি সেংকুলের খোঁজে-১ম পর্ব

কয়েকবার ভাইব্রেশনের শব্দে ঘুম ভাঙল। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোয় বেলা ১১টার আগে সাধারণত ঘুম ভাঙে না। আজ সকাল ৮টায় ঘুম ভাঙল জেনির ফোনে। জেনির পুরো নাম জেনিফার। তবে ওর চায়নিজ নামটি ভুলে গিয়েছি। তাইওয়ানের আদিবাসী গোত্রের মেয়ে। পড়াশোনা করছে কাউশং মেডিকেল কলেজে। একই সঙ্গে তাইওয়ানের কালচারাল বায়োডাইভার্সিটি ওয়ার্কশপ প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর। ঘুম ঘুম চোখে কোনোভাবে ফোন রিসিভ করে ছোট করেই বললাম,
-হেই জেনি। গুড মর্নিং।

ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে লাস্যময়ী কণ্ঠে বলে উঠল,
-হেই, খোকান, গুড মর্নিং।

আমার নাম ‘খোকন’ নামকে ওদের উচ্চারণে এমনই শোনা যায়।
জেনির কথায় আমার ঘুম তখনো পুরো ভাঙেনি। এটা বুঝতে পেরেই হয়তো আবার বলল,
-আমি মনে হয় টু আরলি কল করে ফেলেছি। সরি ফর দ্যাট। আসলে আমি খুব এক্সসাইটেড। তাই তোমাকে শুভ খবরটি না দিয়ে পারিনি। তুমি আমাদের সঙ্গে নামাসিয়া যাচ্ছ।

নামাসিয়ার কথা শুনে আমার ঘুমভাব মুহূর্তে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল।
কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। তাইওয়ানের কাউশং মেডিকেল কলেজ তিন দিনব্যাপী একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করবে। ভেন্যু হিসেবে ঠিক করা হয়েছে তাইওয়ানের গভীর পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা নামাসিয়া। এটি তাইওয়ানের মূল জনবসতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। এ প্রোগ্রামের মূল থিম হলো তাইওয়ানের আদিবাসী সংস্কৃতি, প্রাণিবৈচিত্র্য বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা। কারও যদি অন্য দেশের কৃষ্টি-কালচার নিয়ে জানার আগ্রহ থাকে, তার জন্য খুবই লোভনীয় একটি ব্যাপার। সমস্যা হলো, এতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে তাইওয়ানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মাত্র ১২ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। আবার একটি দেশের সর্বোচ্চ একজন চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবে। আমি যখন আবেদন করলাম, তখন ধরেই নিয়েছিলাম সুযোগটা পাচ্ছি না। কিন্তু সপ্তাহখানেক পর যখন জানলাম নির্বাচিত হয়েছি, তখন আসলেই খুশিতে আত্মহারা হওয়ার মতো অবস্থা। যা-ই হোক, জেনির ফোন রাখার পর এবার নতুন করে সব প্ল্যান করতে শুরু করলাম।

প্রথমেই বলে নিই অচিন পাখি সেংকুলের কথা। বেশ কয়েক মাস আগে রাতের বেলায় ল্যাবে তাইওয়ানিজ সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছি। বেশির ভাগই চাইনিজ কনফুসিয়াস কালচার নিয়ে। বিভিন্ন কথার একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ড্রাগনের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব আসলেই ছিল কি না? সে আমাকে জানাল, তার বিশ্বাস হয় না। হতে পারে এটা ধর্মীয় আর কিছুটা কালচারাল মিথের মিশ্রণ। তবে আরও একটি বাড়তি তথ্য যোগ করে বলল, নামাসিয়ায় কিছু আদিবাসী আছে, যারা সেংকুল নামের একটি পাখিকে দেখেছে। অনেকটা ড্রাগনের কাছাকাছি। আদিবাসীদের কাছে তা অতি পবিত্র পাখি হিসেবে বিবেচিত। কেউ কেউ আবার একে আগুনপাখি বলেও ডাকে। অনেকটা রূপকথার গল্পে যেমন শোনা যায়। তবে সাধারণ মানুষের চোখে এটি ধরা দেয় না।

বিশেষ ধরনের শক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু তাদের দেখা পায়। যারা একবার দেখতে পায়, তাদের আদিবাসী গোত্রে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমি আরও জিজ্ঞাসা করায় বলল, এর চেয়ে বেশি কিছু জানে না। সে এসব কথা ছোটবেলায় তার দাদির কাছে শুনেছিল। ল্যাবমেটের কাছে সেংকুলের ব্যাপারে শোনার পর আমি ইন্টারনেটে অনেক ঘেঁটেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি। সময়ের ব্যবধানে ভুলেই গিয়েছিলাম সেংকুলের আবাসভূমি নামাসিয়ার কথা। কয়েক সপ্তাহ আগে কালচারাল ওয়ার্কশপে যোগদানে আবেদনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল অফিস থেকে মেইল আসে। কিছুদিন ধরেই ল্যাবে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল। তাই শুরুতে আবেদন করব কি না, এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু যখন দেখি এই ওয়ার্কশপের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে নামাসিয়া, তখন সঙ্গে সঙ্গেই আবেদন করে ফেলি। সত্যি বলতে কি, সেংকুল নামের অচিন পাখিটি সম্পর্কে আরও জানার লোভ সামলাতে পারিনি। এ ছাড়া বোনাস হিসেবে দুটি আদিবাসী গোত্রের জীবনযাত্রা একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ তো রয়েছেই।

নামাসিয়া এলাকায় মূলত দুটি আদিবাসী গোত্র বাস করে। তাদের সমাজব্যবস্থায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথা চালু রয়েছে। রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর ছেলেকে চলে যেতে হয় মেয়ের বাড়িতে। এ দুই আদিবাসী দলের একটি হলো কানাকানা বো আর অন্য দলটি নাম বুনন। কানাকানা বো গোত্রের লোকেরা মাছশিকারি। তারা পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নামাসিয়া নদীর ধারে বসবাস করে। পাশের উর্বর ভূমিতে হরেক রকমের ফসল ফলায়। মোটকথা, শত শত বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে এরা একেবারেই দূরে রয়েছে। অনেকটা নিরীহ প্রজাতির। অন্য দলটি বসবাস করে পর্বতের উপরিভাগে। কৃষিকাজের ধারেকাছেও যায় না। তারা শিকারি জাতি। একই সঙ্গে যুদ্ধ-মারামারি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যোদ্ধা জাতি হিসেবে স্বভাবতই পাহাড়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তবে এ দুই আদিবাসী দলের ভেতর একটি চমৎকার সহাবস্থান রয়েছে। বুনন গোত্রের লোকেরা শিকার করা পশু নিয়ে পাহাড়ের নিচে চলে আসে আর ফিরে যায় কানাকানা বো-দের ফলানো ফসল নিয়ে। মুদ্রাব্যবস্থা চালুর আগে যেমন বিনিময়প্রথা চালু ছিল, অনেকটা সে রকম।

দেখতে দেখতে নামাসিয়ায় ওয়ার্কশপের দিন চলে এল। ল্যাবরেটরি থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম। ল্যাবের এত ব্যস্ততার ভেতর ছুটি পাব কি না, এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম। আমার পিএইচডি অধ্যাপক তাইওয়ানের নামকরা বিজ্ঞানী। একই সঙ্গে অমায়িক একজন মানুষ। পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। পিএইচডি-পরবর্তী গবেষণাজীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন ইউরোপ ও আমেরিকায়। এ জন্যই বোধ হয় তিনি অন্য সব কনফুসিয়াস কালচারের অভ্যস্ত অধ্যাপকের মতো নন। যা-ই হোক, নামাসিয়া যাচ্ছি শুনে তিনিও খুব এক্সসাইটেড। বলে দিলেন, ফিরে আসার পর আমার কাছ থেকে সেংকুলের গল্প শুনবেন। অধ্যাপকের অনুমতি পেয়ে জেনির দেওয়া তালিকা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগাড় করতে শুরু করলাম। সমস্যা বাধল অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে। আমাদের রাত্রিযাপনের জন্য ঠিক করা হয়েছে গভীর পার্বত্য এলাকার ছোট একটি গেস্টহাউস। চারদিক বিশাল সব পর্বত দিয়ে ঘেরা। স্বাভাবিকভাবেই বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ আছে। তাই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। এমনকি আমাদের কাপড়ের রং কী হবে, তা-ও বলে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে আরও কিছু নির্দেশিকা। যেমন রাতের বেলায় কীভাবে চলাচল করতে হবে। এমনকি বন্য প্রাণীর মুখোমুখি হলে কীভাবে তার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। এগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

নির্ধারিত দিনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কাঁধব্যাগে ঝুলিয়ে চললাম তাইওয়ানের দক্ষিণের শহর কাউশংয়ের দিকে। যাত্রাপথটা এ রকম। প্রথমে বাসে করে জুনান রেলস্টেশন।

সেখান থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে কাউশং। কাউশং থেকে ছোট গাড়িতে যেতে হবে নামাসিয়া। বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। জুনান রেলস্টেশন থেকে যখন ট্রেনে চেপে বসলাম, তখন সকাল আটটা বেজে গিয়েছে। এখান থেকে কাউশং ২০৫ কিলোমিটার দূরের পথ। এক্সপ্রেস ট্রেনে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ফরমোজা প্রণালির পাশ দিয়ে ট্রেন যখন চলতে শুরু করেছিল, তখন আকাশ কিছুটা মেঘলা। ট্রেনে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি।

বেলা ১১টায় যখন কাউশং স্টেশনে নামলাম, ততক্ষণে চারপাশে ঝলমলে রোদ। কাউশং রেলস্টেশনটি খুব সুন্দর। অত্যাধুনিক স্থাপনাটিতে রয়েছে চোখজুড়ানো ইন্টেরিয়র ডিজাইন। যে কেউ আধুনিক কোনো বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভেবে ভুল করে বসবে।

সকালের তাড়াহুড়ায় নাশতা করা হয়নি। ইতিমধ্যে ক্ষুধায় পেট চোঁ–চোঁ করছে। স্টেশনের ভেতরের কনভেনিয়েন্ট স্টোর থেকে একটি ব্রেড আর এক মগ কফি নিয়ে ছুটলাম ট্যাক্সির খোঁজে। এখান থেকে আমার পরবর্তী গন্তব্য কাউশং মেডিকেল কলেজ। ওখানে তাইওয়ানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে জড়ো হওয়া শুরু করেছে। মোটামুটি দুপুর ১২টার আগেই সবাই চলে এল। ইউএসএ, মেক্সিকো, ইউক্রেন, ইংল্যান্ড, নাইজেরিয়া, জিবুতি, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও বাংলাদেশ—এ নিয়ে মোট ১২ সদস্যের গ্রুপ। সঙ্গে রয়েছেন কাউশং মেডিকেল কলেজের তিনজন ছাত্রী, তিনজন অফিস সহকারী এবং দুজন অধ্যাপক। তারপর ছোটখাটো পরিচিতি পর্ব শেষে আমাদের এ ২০ জনকে নিয়ে ৫টি গাড়ির ছোট বহর ছুটে চলল নামাসিয়ার পানে।

যাত্রা শুরুর আগে আমাদের জানানো হলো এখান থেকে নামাসিয়ার দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগবে তিন থেকে চার ঘণ্টা। কাউশং শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে চলে যাওয়া পুরো রাস্তাই আঁকাবাঁকা। আমাদের গাড়ি কখনো চলেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আবার কখনোবা উঁচু কোনো পাহাড়ের ঠিক মাথা বরাবার হয়ে।

খুব দক্ষ চালক না হলে এ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর একটি ছোট পাহাড়ি শহর নজরে এল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বানানো উঁচু-নিচু বাড়ি। আবার নানান রকমের থোকা থোকা ফুল ঝুলছে প্রতিটি বাড়ির সামনে। কোথাও বয়স্ক কিছু মানুষ অলস সময় কাটাচ্ছে। এতক্ষণ উঁচু-নিচু রাস্তায় চলার কারণে সবাই চাচ্ছিল একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে। তা ছাড়া ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে তিনটে ছাড়িয়েছে।

আমরা এখানে চমৎকার কিছু খাবার দোকানের দেখা পেলাম। ছিমছাম, একই সঙ্গে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত। সবাই মিলে এখানকার একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের মধ্যাহ্নভোজের পর আবার চললাম নামাসিয়ার দিকে। এ মুহূর্তে আকাশ একদম পরিষ্কার। তবে বিকেলের আলোয় পাহাড়ের চূড়া হলদে মায়াময় আভা তৈরি করছে। দুই পাশের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চললাম নামাসিয়ার দিকে। চলবে...

*লেখক: বদরুজ্জামান খোকন, পিএইচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান