শৃঙ্খল ভাঙার সাহস: আফ্রিকার ত্রাস ও ত্রাণ এবং ইব্রাহিম ত্রাউরের অভ্যুত্থান

নতুন এক রাজনৈতিক জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছেন বুরকিনা ফাসোর তরুণ সেনানায়ক ইব্রাহিম ত্রাউরেছবি: রয়টার্স

আফ্রিকা কোনো দরিদ্র মহাদেশ নয়—এটি লুটপাটকৃত একটি মহাদেশ। সোনার নিচে রক্ত, কোল্টানের নিচে কান্না, হীরার নিচে নিপীড়নের ইতিহাস যাকে ঘিরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে আজকের প্রযুক্তিবিপ্লব—সবকিছুর নিচে যদি আপনি খনন করেন, দেখবেন এক স্তরে না এক স্তরে আছে আফ্রিকার খনিজ, বনজ, জৈব ও মানব সম্পদের দাম দিয়ে নির্মিত এক বিপুল অন্যায়ের দেয়াল। আফ্রিকা দারিদ্র্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে কারণ তাকে দারিদ্র্যের কারখানায় রূপান্তরিত করা হয়েছে—যেখানে পণ্য বেচে না, মানুষ বেচা হয়। এ নিপীড়নের ইতিহাস আজও শেষ হয়নি। শুধু রূপ পাল্টেছে। শাসক পাল্টেছে পোশাক, ভাষা আর হাতিয়ার।

সেই ধারাবাহিকতায় একটি নতুন নাম উঠে এসেছে—ইব্রাহিম ত্রাওরে। পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট দেশ, বুরকিনা ফাসো, যেখানে ফরাসি ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গভীর ক্ষত এখনও দগদগে, সেইখানেই এক তরুণ সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে। তাঁর ভাষণগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমে “পপুলিস্ট”, “র‍্যাডিক্যাল”, এমনকি “ধর্মান্ধতা-প্রবণ” বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলে বোঝা যায়—এটি কোনো সামরিক কর্তৃত্বের ভাষা নয়, এটি এক পরাজিত মহাদেশের ইতিহাসকে নতুন করে লিখে ফেলার ঘোষণা।

ত্রাউরে সেই ভাষায় কথা বলেন যা আফ্রিকার নিরন্ন কৃষক, খনির শ্রমিক, এবং শিক্ষিত অথচ বেকার যুবকের প্রাণের কথা। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন—“আমাদের সম্পদ যদি আমাদের না খাওয়ায়, তাহলে সেই সম্পদ অভিশাপ।” তাঁর নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসো স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছে। ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তথাকথিত সাহায্যের নামে প্রবেশ করা বহু এনজিও ও সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতি ও সুশীল ব্যবস্থার কূটকৌশলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে, জনগণের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নয় বরং জনগণের হাতে রাষ্ট্রকে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।

কিন্তু ত্রাউরের মতো নেতাদের উত্থান শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘটনার ফল নয়। এটি এক বৃহত্তর ঐতিহাসিক আবর্তনের অংশ, যেখানে আফ্রিকার নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারছে যে তাদের মুক্তি কেউ দেবে না; নিতে হবে। তাদের দুর্দশার পেছনে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রনীতি’ নয়, বরং একটি সচেতন বৈশ্বিক ব্যবস্থা রয়েছে—যেখানে বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ মুখে উন্নয়নের কথা বলে, পেছনে সুদের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে জাতিগুলোকে। যেখানে পশ্চিমা মিডিয়া মানবিকতার কথা বলে, কিন্তু আফ্রিকার একেকটি অভ্যুত্থানকে ততক্ষণ পর্যন্তই ‘অবৈধ’ আখ্যা দেয় যতক্ষণ না সেটি তাদের স্বার্থরক্ষাকারী হয়ে ওঠে।

ত্রাউরের প্রতি যে ভালোবাসা আজ বুরকিনা ফাসোতে গড়ে উঠেছে, সেটি কোনো প্রচারণার ফল নয়। এটি আফ্রিকান মাটির দীর্ঘ তৃষ্ণার প্রকাশ, স্বাধীনতার এমন এক ব্যাখ্যা যা জাতিসংঘের সনদে নেই কিন্তু মানুষের রক্তে লেখা হয়েছে।

আজকের বিশ্বে এই বিষয়গুলোকে ছোট্ট ইউটিউব ক্লিপেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়—আর সেখানেই এক বিপ্লবী চিন্তার সম্ভাবনা জন্ম নেয়। ঐ ভিডিওতে যেমন বলা হয়—“আমরা সেই মহাদেশ যেখানে ইউরোপ সোনা খুঁজেছে, আর আমাদের দিয়েছে লোহার শৃঙ্খল।” ত্রাউরের আবির্ভাব সেই শৃঙ্খল ছিন্ন করার সাহসের প্রতীক।

আমরা যারা বাংলাদেশের মতো ইতিহাসসিক্ত এক দেশে বাস করি, আমাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা শুধুই আফ্রিকার কোনো দূরের গল্প নয়। আমাদের নিজেদের মধ্যেও প্রশ্ন করা দরকার—আমরা কতটুকু স্বাধীন? আমরা কী উন্নয়ন, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এই শব্দগুলোকে নিজেদের বাস্তবতায় রূপান্তর করেছি, না কি আমরা শুধু কাগজের উপর তাদের মালিক?

ত্রাউরের নেতৃত্ব হয়তো ক্ষণস্থায়ী হবে, হয়তো তাঁর পথ বন্ধুর, কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে সেই যুবকের মতো, যে বলেছিল—“যতদিন জনগণের ক্ষুধা আছে, ততদিন বিপ্লব স্থগিত নয়।”

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন,
[email protected]