কাঁচা রোদে সকাল হাসে
রুমি দুই মুষ্টি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করছে। তার হাত কাঁপছে। সকালের কাঁচা রোদ উঠেছে। দাঁড়াতে চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারছে না। শরীর বেশ নড়বড়ে। চোখে এখনো ঝাপসা দেখছে সে। চোখ বাঁধা অবস্থায় দুই দিন পার করার পর আজ চোখ খুলে দেওয়া হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে বললে ভুল হবে, সে খুলেছে। রুমির মনে হলো, সে যেন পুনর্জন্ম নিল। শিশু যখন মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে কান্না করে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখে; রুমির হলো উল্টোটা। সে হাসছে। আলো দেখে হাসছে, যে আলো তার দেখার কথা ছিল না। এতক্ষণে তার থাকার কথা লাশ হয়ে নদীতে। নয়তো কোনো ডোবায় কচুরিপানার নিচে পায়ে ইট ঝোলানো অবস্থায়। যেমনটি হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে র্যাবের হাতে খুন হওয়া সাত ব্যক্তির। না, তেমন কিছুই হয়নি। সে দিব্যি নিশ্বাস নিচ্ছে। ফুরফুর করে বাতাস নাক দিয়ে ঢুকছে আবার বেরিয়ে আসছে। একটু পরপর নিশ্বাস নিচ্ছে আর তাতে তলপেট ওঠানামা করছে।
গতকাল রুমির তৃষ্ণা পেয়েছিল, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এখন তা–ও পাচ্ছে না। গতকাল তৃষ্ণা পাওয়ার ব্যাপার ছিল। মানুষ নাকি মৃত্যুর আগমুহূর্তে তৃষ্ণার্ত থাকে, রুমিরও তা–ই হয়েছিল; যদিও মৃত্যু তাকে এবারে মতো মাফ করে দিয়েছে। এখন তৃষ্ণা না পাওয়া কারণ খুঁজছে সে। কোনো কারণ পাচ্ছে না সে। এক কারণ থাকতে পারে, তা হলো আপাতত তার মৃত্যুশঙ্কা কেটে গেছে। তবে মাথা ধরে আছে। বেশ ভারী হয়ে আছে। শরীরে বেশ কিছু অংশ অসাড় বললেই চলে।
শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। পরনের প্যান্ট ছেঁড়া। পায়ের দিকটা ছেঁড়া বেশি। শার্টের বোতাম ওপর থাকে তিনটা নেই। শার্টের কলার মোচড়ানো। খুব সম্ভবত কলার ধরে কেউ টানাহেঁচড়া করেছিল।
রুমি চারপাশে একবার চোখ মেলে দেখছে। সে এখানে কেন? তার কিছুই মনে পড়ছে না। একেবারে জনমানবশূন্য এক জঙ্গল। একধরনের শান্ত পরিবেশ। শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া জগতের আর কিছুই যেন নেই এখানে। তাকে এখানে আনলই–বা কে? নাকি সে নিজেই এসেছে। এসব চিন্তা হঠাৎ বাধাগ্রস্ত করল কুকুরে ডাক। কুকুর বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে।
যেখানে রুমি শুয়ে আছে, তার ঠিক ওপরে গাছের ডালে বসে আছে দুটি শালিক। রুমি চোখ খোলার পর এই প্রথম প্রাণীর অস্তিত্ব উপলব্ধির সঙ্গে দেখেও নিল। একটু পরপর শালিকেরা ঠোঁটে ঠোঁট বসাচ্ছে। তারপর একটি শালিক পেখম মেলে ধরল অন্য শালিকের ওপর। এ যেন ভালোবাসা ও মায়ার এক জগতের সঙ্গে তার সদ্য পরিচয়। তার কী হয়েছে, তার অতীত বলতে কিছুই নেই মনে হচ্ছে। অতীত থাকলে তো এতক্ষণ মনে পড়ার কথা।
সূর্য আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করেছে। স্তন্যপায়ী–জাতীয় কিছু প্রাণীর এদিক–ওদিক দৌড়াদৌড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। চারপাশে আলো এসে পড়ছে।
কুকুরে ডাকে রুমির চিন্তার জগৎ বাধাগ্রস্ত করছিল। তার আওয়াজ যেন আরও পরিষ্কার হচ্ছে। মনে হয়, সে রুমির কাছাকাছি কোথাও।
একটু পর রুমির সঙ্গে দেখা হলো লাল–কালো একটি কুকুরের। তীক্ষ্ণ চোখ। কিন্তু ওই চোখে যেন বাসা বেঁধে আছে ভীষণ এক ছাপা অভিমান। একটু পরেই তার অভিমানের কারণ বোঝা গেল। পেছনের এক পা থেঁতলে গেছে। ডান দিকে ঝুঁকে ডান পাশের পেছনের পা টেনে রুমির থেকে হাত পাঁচেক দূরে বসে পড়ল। মনে হচ্ছে আর পারছে না।
বসে আড়চোখে সে রুমিকে দেখছে। রুমিও তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল। রুমি অচেতন অবস্থা থেকে চেতনা ফেরার পর এই প্রথম তার মন খারাপ হলো। ভীষণ রকম মন খারাপ। কুকুরের চোখ সরিয়ে নেওয়া যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে।
রুমি সিদ্ধান্ত নিল, সে যাবে কুকুরে কাছে তার অভিমানের কথা শুনতে। হেলান দেওয়া গাছের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে সে পড়ে গেল। এই প্রথম চোখ পড়ল, তার ডান পায়ের গোড়ালির নিচের অংশ বেশ খানিকটা কেটে গেছে। পায়ের বুড়ো আঙুলে নখ নেই। কী অবাক করা ব্যাপার। এতক্ষণ তার বিন্দুমাত্র ব্যথা ছিল না। হঠাৎ যেন জমে থাকা সব ব্যথা তাকে ঘিরে ধরল।
অশক্ত শরীরে এই প্রথম সে ক্ষুধার অনুভূতি পেল। মনে হচ্ছে, এক পৃথিবী এনে দিলে সে নিমেষেই শেষ করে ফেলতে পারবে। তার ভাতের কথা মনে পড়ছে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। কই মাছের গরম ঝোলের কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে তার প্লেটে কই মাছ বেড়ে দেওয়ার কথা। আহ্, কত মজার তরকারি রান্না করে আনত কৃষ্ণকলি। কী অবাক কথা, কৃষ্ণকলিকে মনে পড়ছে তার। কেমন আছে কৃষ্ণকলি?
কৃষ্ণকলি সঙ্গে রুমির প্রথম দেখা হয় শ্যামলের বাড়িতে দুর্গাপূজার সময়। হ্যাংলাপাতলা গায়ের গঠন। লম্বা। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। সরু লম্বা নাক। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বাঁশের বাঁশি। টানাটানা বড় চোখ। চোখের মণি সবুজ। সবুজ মণিকে ঘিরে শুভ্র আবরণ ছাড়িয়ে যে কারও চোখ আটকে যাবে চোখের কাজলে। চোখের কাজলের রং যে পড়েছে চুলে। কাজলকালো ঘন চুল। সে চুলে খোঁপা করে বেলি ফুলের মালা গুঁজে দিয়েছে। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। ভাঁজ করা শাড়ির আঁচল। কপালে লাল টিপ। পেরেছে সে। প্রথম দর্শনে কৃষ্ণকলিকে রুমির কাছে দেবীর মতো লেগেছিল।তারপর ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ উধাও। রুমির চোখ যেন খুঁজে চলেছে দেবীরূপী মানবীকে।
শ্যামল রুমির বাল্যবেলার সহপাঠী–বন্ধু। তারা একে অপরের সঙ্গে সেই নার্সারি থেকে। শ্যামল ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে। রুমি দুচোখ তখনো খুঁজে চলছিল কৃষ্ণকলিকে।
কৃষ্ণকলির সেই প্রতিচ্ছবি যেন এখন এই গাছতলায় বসা থাকা রুমিকে তাড়া করছে। কিছুক্ষণ আগেও যে কৃষ্ণকলিকে মনে করতে পারছিল না, এখন কিনা তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সেই দৃশ্য তাকে তাড়া করে ফিরছে।
কুকুরটি ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত–পা ছড়িয়ে সটান হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত কুকুরের গায়ে এসে বসল একটি দোয়েল পাখি। দোয়েল বসেই লেজ উঁচু করছে। বহু বছর তার দোয়েল সরাসরি দেখা হয়নি। তবে বহুবার দুই টাকার নোটের গায়ে তার ছবি দেখেছে। দোয়েল পাখিটি ডানে–বাঁয়ে পায়চারি করছে কুকুরে ঘুমন্ত পেটের ওপর। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কুকুরটি কোনো কিছুই যেন টের পাচ্ছে না। সে দিব্যিই ঘুমিয়ে আছে। দোয়েল পাখিও তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে কুকুরের কান ঠুকরে দেখতে গিয়েই যেন সে তার সর্বনাশ ডেকে আনল। কুকুরের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় সে লেজ নেড়ে উঠল। তাতেই দোয়েল উড়াল দিল দূরের গাছে। গাছে বসে সে দেখে নিল কুকুরের অবস্থান। কুকুর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রুমির মনে হচ্ছে, কুকুরটি মাত্রারিক্ত ক্লান্ত। না হলে তার এভাবে ঘুমানোর কথা নয়।
এ কথা চিন্তা করতে না করতেই রুমির বাঁ পা চুলকাচ্ছে। রুমি বাঁ হাত দিয়ে চুলকাতে গিয়ে অনুভব করল নরম তুলতুলে আঠাসমেত কিছু একটা লেগে আছে তার পায়ে। হাত দিয়ে টেনে আনতেই চোখে পড়ল জোঁক। জোঁকের পেট ফুলে আছে। খুব সম্ভবত বেশ কিছু দিন অভুক্ত ছিল। রুমির বাঁ পায়ের রক্ত জমে আছে জোঁকের পেটে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! সে একটুও টের পেল না। তার ভালো লাগছে এ–ই ভেবে যে তার শরীরের রক্ত একটি অভুক্ত জোঁকের কিছু দিনের বাঁচার সম্বল হলো বলে।
জোঁকটির দিকে তাকিয়ে রুমি বলতে লাগল, এই পৃথিবীতে কত রকমের মানুষই তো আছে, যারা নীরবে রক্ত চুষে খায়। সবকিছুই কি টের পাওয়া যায়? টের পাওয়া যায় না।
*লেখক: মহি ইরশাদ, প্রভাষক, লন্ডন
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]