দূরের তুরস্ক, কাছের তুরস্ক–৪
৬.
আজ শনিবার। ২ জুলাই ২০২৩। সময় ভোর। মালিসসা গার্ডেন রিসোর্টে স্তব্ধতা। ভোর সোয়া চারটায় ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটায়। উঠে দেখি ছেলেও জেগে গেছে। সে সাধারণত দেরিতে ওঠে। ছেলের মা বলল, ছেলে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাবে, টাকা দাও।
বললাম প্যান্টের পকেটে আছে।
কত দিব?
১০ ইউরোই এনাফ।
বউ ছেলেকে ১০ ইউরো দিল। সঙ্গে ইন্সট্রাকশন। কী খাবে, কী খাবে না। এবং বলল, বিল কিন্তু নিয়ে আসবা।
ছেলে নাশতা খেয়ে মোবাইলে ছবি নিয়ে এল। কী কী আইটেম নিয়েছে এবং খালি প্লেটের ছবি। প্রমাণ দিয়েছে, সে সবটুকুই খেয়েছে। অপচয় করেনি।
আমরা দুজন বাঙালি স্টাইলের নাশতা করলাম। আমাদের এপার্টমেন্টেই। রুটি, মাংস, ডিম আর চা–কফি। কফি খেলাম, বউ চা। আজকাল কফির প্রতি আসক্তি বেড়েছে। কেন জানি না। এদিকে প্রতিদিন ক্লিনার মহিলারা আসেন রুম পরিষ্কার করতে। মহিলারা তেমন ইংরেজি জানেন না। আমার বউ তাঁদের উচ্ছিষ্ট খাবার দিতে চায়, তারা নেন না। বউকে বললাম, তাঁরা তো বাংলাদেশের গৃহকর্মী না যে এক বাটি তরকারি দিলে খুশি হবে। তাঁরা কমপক্ষে ৪০–৫০ হাজার টাকা বেতন পান।
৫০ হাজার! কী বলো!
হ্যাঁ তাই।
বউ তার পলিসি বদলায়। এখন আর তরকারি, ব্রেড অফার করে না। তাঁদের জন্য কোনো গিফট দেওয়া যায় কি না ভাবে। এদিকে আমাদের পাশের গার্ডেনে বারবিকিউ করার ব্যবস্থা আছে। রোজ বিকেলে কেউ না কেউ বারবিকিউয়ের আয়োজন করে। ধোঁয়া উড়ে আমাদের চোখের সামনে। ছেলে বলল, বাবা, একদিন বারবাকিউ পার্টি করলে কেমন হয়?
আমি চুপ থাকি। আমরা তিন বেলা ভাত খাওয়া লোক। বারবিকিউ কেন যেন আমাদের সঙ্গে যায় না। অবশ্য এটা হারাম কিছু না। তারপরও ওসবে আমার মন কখনোই সায় দেয় না। আরেকদিন ছেলে বলল, বাবা, এখানে টার্কিশ বাথ খুব বিখ্যাত।
হাম্মামখানার কথা বলছিস?
হ্যাঁ বাবা।
মনে মনে ভাবি, পোলা তো কম না। ১৬ বছর বয়সে হাম্মামখানায় ঢুকতে চায়। যেখানে একধরনের ফোম বা ফেনা দিয়ে গোসল করিয়ে দেওয়া হয়। আমার বন্ধুরা মজা করে বলেছে, তুরস্ক যাচ্ছিস, হাম্মামখানায় যাস, নারীরা তোকে গোসল করিয়ে দেবে। আরাম পাবি। শরীরও গরম হবে।
হাম্মামখানাবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে, ছেলে প্রসঙ্গ পালটে ফেলল। সে নিশ্চয় এটা বুঝেছে, বাবার এ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তার ওখানে যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও, যাওয়ার সাধ্য নেই। টাকা তো বাবার ওয়ালেটে।
আজ একটু পরে আমরা বেরুব। এতদিন আমি আমার ছেলের হটস্পট ব্যবহার করেছি। ছেলে বলছে তার ডেটা শেষ। এদিকে আমার নেটও কাজ করছে না। কাল থেকে মোটামুটি নেট বিচ্ছিন্ন। দুনিয়ার খবর জানি না। সোশ্যাল মিডিয়া নেই। পত্রপত্রিকা নেই। একসময় ভাবলাম, নেট ছাড়া চলি না কয়দিন। বাপ-দাদার আমলের মতো। কিন্তু না। অসুবিধা হচ্ছে। আজই নিজের নেটওয়ার্ক চালু করতে হবে অথবা হোটেলের ওয়াইফাই। শুনেছি হোটেল প্রতিদিনের জন্য চার্জ করে সাড়ে ছয় ইউরো। এদিকে ছেলে লন্ডনের ডেটা ব্যবহার করছে, প্রতি জিবি ৩ পাউন্ড। আল্লাহ-ই জানে বিল কত আসে। বিল তো দিতে হবে আমাকেই।
ছেলে প্যারাসেইলিংয়ে উঠতে চায়। একধরনের বেলুন। বেলুন বাঁধা থাকে স্পিডবুটের সঙ্গে। স্পিডবুট দ্রুতবেগে চলে সাগরে। আর ওপরের বেলুন টেনেটেনে নিয়ে যায়। বেলুন ওপরে উঠতে থাকে। দেখলেই আমার ভয় লাগে। ওপর থেকে পড়লে জীবন শেষ। ছেলে এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনোদনে উঠতে চায়। ছেলেকে বললাম, এটাতে ওঠার বয়স তোমার হয়নি। এটাতে উঠতে কমপক্ষে ১৮ বছর লাগে।
ছেলে বলল, বাবা, তুমি তো লন্ডনের নিয়ম বলছ। তুরস্কে এসব নিয়মের বালাই নাই।
কী বলছিস!
আমি জেনে আসছি। ১৬ বছর হলেই উঠতে পারে।
এখানে মৃত্যু ঝুঁকি আছে। এটাতে না ওঠাই ভালো বাবা।
প্লেন চড়ায়ও মৃত্যু ঝুঁকি আছে, তাহলে প্লেন চড়ি কেন আমরা? ছেলে তর্ক লাগিয়ে দিল। তাকে বাগে না আনতে পেরে রাজি হলাম। ছুটলাম সমুদ্রসৈকতের দিকে। যেখান থেকে বেলুন ওড়ে। ১০ মিনিটের হাঁটার পথ। আজ বেশ রোদ। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে অসহ্য গরম অনুভূত হচ্ছে। চারদিকে বাতাসে গাছের পাতা নড়ে।
বেলুনওয়ালাদের অফিসে পৌঁছলাম। ম্যানেজার বলল, এখন বেলুন উড়বে না।
ছেলের মুখে জমলো কালো মেঘ, কেন! কেন!
এখন বাতাস বেশি। কোস্টগার্ডের নিষেধ আছে।
তাহলে?
সকালে আসো। সকালে খুব সুন্দর আবহাওয়া থাকে। আরাম করে আকাশে বেড়াতে পারবে। পাখির মতো।
লোকটা কবি হয়ে ওঠে। যাক বাবা, আপাতত রক্ষা। এখন?
ছেলে বলল, তাহলে চলো আমরা সমুদ্রে গোসল করি।
চলো।
তিনজনই নেমে গেলাম সমুদের উষ্ণ জলে। বালুকাময় সমুদ্র আমার ভালোই লাগছে। কিন্তু সাঁতার কাটতে গিয়ে টের পেলাম, পানির নিচে কোথাও কোথাও বড়বড় পাথর। অসতর্কভাবে সাঁতার কাটলে ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাদা এক নারী দেখি ছয় মাসের বাচ্চাকে নিয়ে সমুদ্রে নেমেছে। শিশুটি বিস্ময় চোখে সমুদ্র দেখছে। আমি তার কাছে গিয়ে একটা মজার অঙ্গভঙ্গি করলাম। সে হেসে দিল। আমার মনে হল সমস্ত সমুদ্রে ছড়িয়ে পরেছে তার হাসি। কিছুক্ষণ পর বউ-ছেলে বলল, তাদের ছবি তুলতে। আমি সৈকতে উঠে গেলাম। ছবি তুললাম। শরীরের ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেল ৩০ মিনিটেই। কী তাপ। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমুদ্র দেখছি। সমুদ্রপ্রেমী মানুষ। কত বর্ণের। কত ভাষার। একটা বৃদ্ধ লোক আমাকে অতিক্রম করল দুবার। একা একা হাঁটছে লোকটি। হাতে একটা মোবাইল। আহারে লোকটার বুঝি কেউ নাই! আমি বুড়ো হয়ে গেলে, আমারও কি এরকম হবে! কত ভাবনা আসে। সমুদ্র কি মানুষকে ভাবায়!
অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে বউ-ছেলে উঠে এলো ডাঙায়। বালুর সৈকত পেরিয়েই রাস্তা। তার পাশে পা ধোয়ার ব্যবস্থা। পাশেই অনেকগুলো কলাগাছ। পা ধুতেধুতে চেয়ে দেখি মাথার ওপর কলার ছড়া ঝুলছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এ যেন বাংলাদেশ।
রুমে যাওয়ার পথে একটা দোকানে ঢুকলাম। কিছু কেনাকাটা। চিকেনরোলের মতো একটা বেকারির আইটেম কিনলাম। দোকানিকে বললাম, এটা কি সুইট? সে সুইটের অর্থ বোঝে না। তাও কিনলাম। ছেলে খেয়ে বলল, ভালই, মিষ্টি না, ভেতরে চিজ দেয়া। রুমে ঢুকতে গেলাম, পরলাম সমস্যায়। ভেতরে চাবি রেখে আমরা দরজা বন্ধ করেছিলাম, ভুলবশত। এখন?
দ্রুত ফিরে গেলাম হোটেলের অফিসকক্ষে। অফিস খোলা কিন্তু সেখানে কেউ নেই। রুমে ফিরলাম। বউ বলল, সকালে যে নারী আমাদের রুম ক্লিন করেছিল, তাকে দেখেছি সামনের বাসায়, তার কাছে আমাদের রুমের চাবি থাকতে পারে। সামনের বাসায় গেলাম। পেয়ে গেলাম নারীকে। তিনি ইংরেজি জানেন না। ইশারায় বোঝালাম, আমরা রুমে ঢুকতে পারছি না। তিনি দ্রুত অন্য রুমে গেলেন। নিয়ে এলেন বড় একটি চাবির গোছা। খুলে দিলেন আমাদের রুম। রুমে ঢুকে প্রশান্তি। বাংলাদেশি স্টাইলে খেতে বসলাম লুঙ্গি পরে। ডাল আর মাংস দিয়ে। খেতে অমৃত লাগছে। বুঝলাম না তুরস্কে সবকিছু এত মজা লাগে কেন! অনেক হাঁটাহাঁটি করি, সে জন্য ? নাকি গরমের দেশ বলে? নাকি বউয়ের রান্নার হাত বদলে গেল! এখানে সবই ভাল। শুধু ভাতটায় একটু সমস্যা। অনেক দোকান ঘুরে চিকন চাল পেলাম না। বাসমতী চালও। মোটা চালের ভাত খেতে হচ্ছে।
সন্ধ্যায় কফি খেয়ে আবার বেরিয়ে গেলাম আমরা। শপিং করতে। এক বয়স্ক নারী দেখি ভিক্ষে করছেন। ছবি তুলতেই তিনি কী যেন বললেন। সম্ভবত গাল দিয়েছেন তাঁর ভাষায়।
বড় একটা সুপারস্টোরে ঢুকলাম। আড়ংয়ের মতো। ছেলে একটা হাফপ্যান্ট পছন্দ করল, দাম ৩৪ ইউরো। মানে ৪০০০ টাকা। এক হাফপ্যান্ট চার হাজার! ছেলেকে বললাম, এটা তো লন্ডনে এক হাজার টাকায় পাওয়া যায়, চার হাজারে কিনতে চাচ্ছ কেন?
বাবা, এটা ব্র্যান্ড, তুমি বুঝবা না।
এত দামে কেনা যাবে না, অন্যটা দেখো।
ছেলে রাগ করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। ছেলের মা তাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে নিজেই ম্যানেজ হয়ে এল, এ দিয়ে দাও না।
তুমিই তো ওকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছ। ব্র্যান্ড ছাড়া পরতেই চায় না।
এখন ছেলের মায়ের কণ্ঠেও কাকুতি। তারা দুজন এক পক্ষ। আমি এক ভোট নিয়ে আবারও সংখ্যালঘু। কিনে দিলাম। কী আর করা। অতঃপর খাওয়ার কিছু আইটেম কিনে রুমে ফিরলাম। তখন রাত ১০টা। খাওয়াদাওয়া, নামাজ পড়ে তারপর দেব ঘুম। সকালে ছেলের প্রোগ্রাম। ছেলে বেলুনে চড়বে। ছেলের মা উৎকণ্ঠায় তার বোনকে ফোন দিয়েছে বাংলাদেশে। বলছে, ফকিরফাকারকে কয়টা পয়সা দিস। যাতে তারা দোয়া করে, নিরাপদে নামতে পারে বেলুন থেকে। এসব শুনে আমার একটু হাসিও পেল। গরিবের কপাল খুলছে। বেলুন চড়াবে তুরস্কে, পয়সা গুনবে বাংলাদেশ। চলবে...
**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]