ঘাড় ত্যাড়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জাকির সাহেব পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি করছেন। উনার চাকরির বয়স প্রায় তিন বছর। চাকরির এ তিন বছর উনি শুধু বদলির ওপরেই আছেন। কারণ উনি বদলি হয়ে যেখানেই যান, কিছুদিন পর সেখানকার অন্য পুলিশ সদস্যরা একত্র হয়ে তাঁর বদলির জন্য আবেদন করা শুরু করেন। যার কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে তাঁকে আবার নতুন জায়গায় বদলি করে দেয়।

জাকির সাহেব এমনিতেই মানুষ হিসেবে খুবই সহজ-সরল। কোনো অন্যায় বা দুর্নীতি তিনি করেন না। নিয়মকানুন মেনেই তিনি চাকরি করেন। তবে সমস্যা হচ্ছে উনি একটু পাগলাটে ধরনের একরোখা মানুষ। যেটা বোঝেন তো বোঝেন, সেটা আর কেউ উনাকে বোঝাতে পারেন না। জাকির সাহেব বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত। মাত্র ছয় দিন আগে উনি ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছেন।

আজ দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে একটি সংগঠনের মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল। জাকির সাহেব সেখানে ডিউটি করতে গিয়েছিলেন। পুলিশের যথেষ্ট ফোর্স সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল। আগেই বলা হয়েছিল, যদি সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা বা ভাঙচুর বা মারামারি হয়, তাহলে পুলিশ সরাসরি অ্যাকশনে চলে যাবে।

কর্মসূচিটি ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই কেন জানি সেখানে গাড়ি ভাঙচুর, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে পুলিশও অ্যাকশনে নেমে গেল। ওখানে উপস্থিত পুলিশের বড় কর্তা আক্রমণ বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পুলিশের মতো জাকির সাহেবও লাঠি নিয়ে পাবলিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে তিনি লাঠি চালাতে লাগলেন। কতজনের ওপর তিনি লাঠি চালিয়েছেন, তা তিনি সঠিকভাবে বলতে পারবেন না। তবে তাঁর ধারণা, তাঁর পারফরম্যান্স ছিল একদম ফাটাফাটি।

সন্ধ্যায় ডিসি, এডিসিসহ তিনজন বড় কর্তা জাকির সাহেবদের থানায় এলেন। তাঁরা এসেই থানার কনফারেন্স রুমে গিয়ে বসলেন। একটু পর তাঁরা জাকির সাহেবকে সেখানে ডেকে পাঠালেন। জাকির সাহেব ভাবলেন, আজকের প্রেসক্লাবের সামনে তাঁর ফাটাফাটি পারফরম্যান্সের জন্য হয়তো বসেরা তাঁকে এখন অভিনন্দন জানাবেন। তিনি মনে একপ্রকার আনন্দ নিয়ে কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করলেন।

জাকির সাহেব রুমে ঢুকে দেখলেন তিনজন বড় কর্তা চেয়ারে বসে আছেন। আর থানার দারোগা সালাম সাহেব, আর সাব-ইন্সপেক্টর রফিক সাহেব দুজনে দাঁড়িয়ে আছেন। জাকির সাহেব রুমের ভেতরে ঢুকেই স্যালুট করলেন।

এডিসি আনাম সাহেব হাসিমুখে নরম গলায় জাকির সাহেবকে প্রশ্ন করলেন,
-আপনার নাম কী?
জাকির সাহেব চিৎকার করে বললেন,
-আমার শার্টে লাগানো নেমপ্লেটে আমার নাম লেখা আছে, স্যার। আপনি কষ্ট করে ওখান থেকে পড়ে নিন, স্যার।

এমন উত্তরে এডিসি আনাম সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি জাকির সাহেবকে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলেন না। অপর এডিসি সুলতান সাহেব বললেন,
-আপনার নাম যে নেমপ্লেটে লেখা আছে, সেটা আমরা জানি। তবুও আপনার মুখ থেকে আমরা আপনার পুরো নামটা শুনতে চাচ্ছি। নামটা কি বলা যাবে?
-যাবে স্যার। আমার পুরো নাম মো. জাকির হোসেন, স্যার।

-আচ্ছা আপনি এভাবে চিৎকার করে উত্তর দিচ্ছেন কেন?
-ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের শেখানো হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সব প্রশ্নের উত্তর উচ্চ স্বরে দিতে হবে, স্যার।
-বুঝলাম। তবে এখন আর চিৎকার করে কথা বলবেন না। কানে লাগে।
-জি না, স্যার। আমি আপনার কথায় নিয়মের বাইরে কিছু করতে পারব না, স্যার।

এ পর্যায়ে এডিসি সুলতান সাহেব চিৎকার করে বললেন,
-ঠিক আছে জাকির সাহেব। আপনি গলা ফাটায়ে গায়ের সব জোর দিয়ে কথা বলুন। এতে আমাদের কান ফাটলে ফাটুক। তা আপনার দেখার দরকার নেই।

জাকির সাহেবও চিৎকার করে বললেন,
-ওকে স্যার।

এডিসি সুলতান সাহেব আর কিছু বললেন না। এবার এডিসি আনাম সাহেব আস্তে করে মৃদু গলায় বললেন,
-আপনি কনস্টেবল পদে কত দিন?
জাকির সাহেব একইভাবে চিৎকার করে বললেন,
-চাকরি করি যত দিন।

-এই, আপনি সব প্রশ্নের উত্তর এমন বাঁকা বাঁকাভাবে দিচ্ছেন কেন? এখন বুঝতে পারছি, সবাই আপনাকে কেন ঘাড় ত্যাড়া বলে? আপনার তো মিয়া আসলেই ঘাড়ের রগ একটা বাঁকা।

-জি না স্যার। আমার ঘাড়ের রগ একদম সোজা। আমি মেডেক্যালি ফিট। তা না হলে পুলিশে আমার চাকরি হতো না, স্যার।
এ পর্যায়ে ডিসি সাহেব মুখ খুললেন?
-জাকির সাহেব শোনেন, এখন থেকে আপনাকে যা যা প্রশ্ন করা হবে, আপনি তার সোজা সোজা উত্তর দেবেন। একটুও প্যাঁচাবেন না।
-জি স্যার।

ডিসি সাহেব এবার এডিসি আনাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে বললেন। এডিসি আনাম সাহেব আবার তার প্রশ্ন শুরু করলেন,
-এবার বলুন আপনার চাকরির বয়স কত?
-তিন বছর স্যার।

-এই তিন বছরে আপনি কত জায়গায় বদলি হয়ে গিয়েছেন?
-আমি কোথাও বদলি হয়ে যাইনি, স্যার। অফিস আমাকে বারবার বদলি করে দিছে, স্যার।
-আপনি কি বলতে পারবেন, কেন আপনি বেশি দিন কোনো জায়গায় টিকতে পারেন না?
-না স্যার। আমি বলতে পারব না, স্যার।

-শুনলাম, মানুষ নাকি আপনাকে পাগলা জাকির বলে ডাকে। আপনার কি মাথায় কোনো সমস্যা আছে?
-না, স্যার। আমার মাথা ফ্রেশ অ্যান্ড ক্লিয়ার, স্যার। যারা আমাকে পাগলা বলে, তাদের মাথায় সমস্যা আছে, স্যার। আসলে আমি না, ওরাই পাগল, স্যার।

-ওকে বুঝলাম। আপনি একাই সুস্থ, আর আমরা সব পাগল।
-ধন্যবাদ স্যার।

-আচ্ছা আপনি কি আপনার পারিবারিক কোনো বিষয় বা সমস্যা নিয়ে মানসিক সমস্যায় আছেন?
-না স্যার। আমি এখনো বিয়ে করিনি, স্যার। যেহেতু বিয়ে করিনি, তাই আমার কোনো পারিবারিক বা মানসিক সমস্যাও নেই, স্যার।

-আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?
-একজন আছে স্যার। তবে তাকে নিয়ে আমি একটু কনফিউজড, স্যার। কারণ সে আমার জীবনে আছে, না জীবন থেকে চলে গেছে, সেটা আমি বুঝতে পারছি না, স্যার।
-মানে কী?
-গত তিন বছর থেকে সে আমার সঙ্গে দেখা করে না, কথা বলে না, স্যার। আমি ফোন করলেও সে ফোন ধরে না, স্যার। তবে সে প্রতিদিন রাত বারোটার সময় আমাকে ফোন করে। আমি ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে, সে আমাকে হারামজাদা বলে একটা গালি দিয়ে লাইন কেটে দেয়, স্যার।

-উনি কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন?
-আমি জানি না স্যার। তবে একটু আইডিয়া করতে পারি, স্যার।

-বলেন শুনি আপনার আইডিয়া। আর শোনেন, প্রতি লাইনের শেষে আপনার এ স্যার বলাটা বন্ধ করুন, প্লিজ।
-এটা সম্ভব না, স্যার। আমি আমার ট্রেনিংয়ের বাইরে কিছু করব না, স্যার।
এডিসি আনাম সাহেব টিটকারি করে জাকির সাহেবের মতো করে বললেন,
-ঠিক আছে জাকির স্যার। আপনাকে ট্রেনিংয়ের বাইরে কিছু করতে হবে না, জাকির স্যার। আপনার মতো করেই আপনি কথা বলুন, জাকির স্যার। এবার আপনার আইডিয়াটা বলুন, জাকির স্যার। আমরা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছি, জাকির স্যার।

জাকির সাহেব টিটকারিটি গায়ে মাখলেন না। তিনি আগের মতোই চিৎকার করে বললেন,
-ছাত্রজীবনে আমি খুবই মেধাবী ছিলাম, স্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কেয়া আমাকে বলেছিল, আমাকে সে পুলিশের পোশাকে দেখতে চায়, স্যার। আমিও আবেগের বশে তাকে কথা দিয়েছিলাম, স্যার।

-আপনি তো আপনার কথা রেখেছেন। তাহলে সমস্যা কী?
-কেয়ার ধারণা ছিল, আমি বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি পদে যোগদান করব, স্যার। কিন্তু আমি তাকে না জানিয়ে হুট করে কনস্টেবল পদে যোগদান করে ট্রেনিংয়ে চলে যাই, স্যার। এর পর থেকেই সে এ আচরণ শুরু করছে, স্যার। তার ধারণা, আমার মাথায় জটিল সমস্যা আছে।
-তা আপনার কী ধারণা? আপনি কি মনে করেন আপনি সুস্থ?
-জি স্যার। আমি এক শত ভাগ সুস্থ, স্যার।
এবার ডিসি সাহেব প্রশ্ন করলেন,
-আপনি আজ বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনে কী করেছেন?
-পিটাইছি স্যার। অ্যাকশন শোনামাত্র লাঠি নিয়া ঝাঁপায়ে পড়ছি। তারপর অনবরত পিটাইছি, স্যার। দারোগা স্যারসহ কয়েকজন পাবলিক মিলে আমারে ধইরা না থামানো পর্যন্ত যারে সামনে পাইছি, তারেই পিটাইছি, স্যার।

-আপনার কি ধারণা আছে, আপনি কতজন পিটাইছেন?
-না স্যার। গোনাগুনি আমার কাজ না, স্যার। আমার কাজ হইল পিটানো, স্যার।

-আচ্ছা আপনি কনস্টেবল হারিছ, কনস্টেবল জব্বার, কনস্টেবল কুতুব, নায়েক কামালসহ অন্য পুলিশ সদস্যদের পিটাইছেন কেন?
-স্যার আমার ওপর অর্ডার ছিল, সামনে যারে পাবি তারে পিটাবি। তাই পিটাইছি, স্যার।
-তাই বলে আপনি পুলিশ পেটাবেন? আপনার সাথিদের পেটাবেন?
-উনারা আমার সামনে ছিল তাই পিটাই দিছি, স্যার। সে পুলিশ নাকি পাবলিক সেটা আমি দেখি নাই, স্যার। আর এটা দেখা আমার কাজও না, স্যার।

রুমের সবাই হাঁ করে জাকির সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ সময় ডিসি স্যার হতাশ কণ্ঠে বললেন,
-আপনি কারে মারতেছেন সেটা দেখা আপনার কাজ না!
-জি না স্যার। আজ প্রেসক্লাবে মানববন্ধনের আগে আমাদের স্যারে বলছে, ‘আমি আক্রমণ বলার সঙ্গে সঙ্গে পিটানো শুরু করবি। যারে সামনে পাবি, তারে পিটাবি।’ তখন আমি বলছিলাম, স্যার এটা আপনি কী বললেন? সবাইরে পিটামু ক্যান? যে ভেজাল করবে, যে ভাঙচুর করবে, তাকে পিটামু। তখন স্যারে বলছে, ‘তোর তো অত কিছু দেখার দরকার নাই। আমার হুকুম সামনে যারে পাবি তারে পিটাবি।’ আমি স্যার সেই হুকুম পালন করছি। যে আমার সামনে পড়ছে, তারেই খায়া দিছি, স্যার।
-এটা কোনো যুক্তি হলো? আপনার তো মিয়া আসলেই মাথায় সমস্যা আছে।

জাকির সাহেব কিছু বলার আগেই, সাব-ইন্সপেক্টর রফিক সাহেব বললেন,
-এই পাগলের পাগল, আপনি জানেন আপনি আমাদের কতজন পুলিশ পিটাইয়া আজ হাসপাতালে পাঠাইছেন?
-জানি না, স্যার।

-একটু আন্দাজ করে বলেন তো, আজ আপনি কতজনকে পিটাইছেন?
-সঠিক হিসাব তো বলতে পারব না, স্যার। তবে আমার ধারণা পনেরোজন তো হবেই, স্যার।

এবার থানার দারোগা সাহেব চিৎকার করে বললেন,
-স্যার এর মধ্যে চৌদ্দজনই পুলিশ। বদমাইশটা আমার চৌদ্দজন পুলিশ পিটাইয়া, মাথামুথা ফাটাইয়ে হাসপাতালে পাঠায় দিছে। বাকি পুলিশ পাবলিক থামাইব কি? ওরা এই উরাধুরা মাইর দেইখা ভয়ে দৌড়াইয়ে পালাইছে। আমি যখন দেখলাম অবস্থা ভয়াবহ, আমি দৌড়ায় গেছি ওরে থামাইতে। ও আমারেও লাঠি নিয়া দৌড়ানি দিছে। আমারে চিৎকার করে বলে, শালার পুত তুইও মিছিলে আইছোস? তুইও গাড়ি ভাঙোছ? আমি তখন ধমক দিয়া বললাম, জাকির সাহেব আপনি এসব কী বলছেন? খবরদার আপনি আমারে গালি দেবেন না। আপনি আর একজনকেও মারবেন না। এ কথা বলামাত্র সে আমারে বলে, শালার পুত তুই পুলিশের কাজে বাধা দিছ? তোর এত বড় সাহস? আজ তোরে খাইছি। বিশ্বাস করেন স্যার, এরপর সে লাঠি নিয়ে আমারে প্রায় আধা মাইল দৌড়াইছে। স্যার আপনারা একটু কল্পনা করেন, একজন দারোগারে মারার জন্য একজন কনস্টেবল লাঠি নিয়া দৌড়াচ্ছে। এটা কোনো কথা? আপনারা জানেন, রাস্তার সবাই তখন ওই দৃশ্য ভিডিও করছিল। শেষ মুহূর্তে কোনো উপায় না দেখে জীবন বাঁচাতে আমি এক মহিলার পেছনে যাইয়া লুকাইছি। এরপরও পাগল থামে না। সে ওই মহিলার মাথার ওপর দিয়া আমারে লাঠি দিয়া মারতে গেছে। এরপর কয়েকজন পাবলিকের সহায়তায় ওরে চাইপা ধইরা তারপর ওরে হ্যান্ডকাফ পরাইছি। স্যার, এই পাগল আমি আমার থানায় রাখব না। এরে এখান থেকে সরায় নিয়ে যান। আর না হলে আমারে বদলি করে দেন। আমি এই পাগলের সঙ্গে চাকরি করব না।

সাব-ইন্সপেক্টর রফিক সাহেব বললেন,
-স্যার, একটু আগে ফেসবুকে দেখলাম, কে জানি ওই ভিডিও পোস্ট করে দিছে। মানুষ তো এখন আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। টিকটক ভিডিও বানাবে। আমরা এখন মুখ দেখাব কী করে?
ডিসি স্যার জাকির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এ ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে? আপনি কি আপনার দোষ স্বীকার করছেন?
এ সময় জাকির সাহেব গলার আওয়াজ নিচু করে শান্ত বাচনভঙ্গিতে বললেন,
-স্যার, আমি নির্দোষ। আমি শুধু হুকুম পালন করছিমাত্র। আপনাদের বলা উচিত ছিল, নিরীহ লোকদের মারা যাবে না। শুধু যারা ভাঙচুর করবে, তাদের থামানোর জন্য যদি মারতে হয়, তবে মৃদু লাঠিচার্জ করতে হবে। তা না বলে, আপনারা বলছেন, যারে সামনে পাবি তারে মাইরা ফাটায়ে ফেলবি। কোনো দিকে তাকাবি না। আপনারা যেমন নির্দেশ দিয়েছেন, আমি তেমনিই করেছি। এখানে আমার কোনো দোষ নাই, স্যার।
-আপনি এই এক কথা বারবার কেন বলছেন? আপনারে কি পুলিশ পিটাইতে বলছে? আপনারে বলছে পাবলিকরে পিটাইতে।

-সেটা কিছু বলে নাই, স্যার। বলছে যারে পাবি, তারেই মারবি।
-আচ্ছা, আমি যদি ওই সময় আপনার সামনে যেতাম, আপনি কি আমারেও মারতেন?
জাকির সাহেব আবারও আগের মতো উচ্চ স্বরে বললেন,
-অবশ্যই মারতাম, স্যার। মাইরা একেবারে ফাটায়ে ফেলতাম।

এ কথা শুনে ডিসি সাহেব বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বললেন,
-কী! আপনি আমাকেও মারতেন! আপনার এত বড় সাহস? আপনি আমার গায়ে হাত তুলতেন? এ কথা বলতে একবারও আপনার বুক কাঁপল না?
জাকির সাহেব আবারও স্বর নরম করে বললেন,
-স্যার, আপনি রাগ করছেন কেন? আজকের মানববন্ধনে তো সবাই গন্ডগোল করেনি। দু-একজন করেছে। বাকিরা সবাই নিরীহ সাধারণ মানুষ। বিনা কারণে যদি সেই সব সাধারণ মানুষকে আমি পিটাইতে পারি। তাহলে আপনি কে? আপনি তো পাবলিকের থেকে বড় কেউ না, স্যার।

ডিসি সাহেব জাকির সাহেবের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এরপর হতাশ হয়ে উনি আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর উনি ঠান্ডা গলায় বললেন,
-আপনি কি কখনো পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন?
-না, স্যার। তবে যাওয়ার শখ আছে। আল্লাহ চাহে তো একদিন যাব ইনশা আল্লাহ।

-কোন এলাকার পাহাড় দেখার শখ আপনার? বান্দরবান নাকি খাগড়াছড়ি?
-বান্দরবান স্যার। জায়গাটার নামটা খুউব সুন্দর। আর তা ছাড়া বান্দর আমার খুবই প্রিয়। ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন, একবার বান্দরবান যাব। সেখানে গিয়া বান্দরের মতো গাছে গাছে ঝুলব, আর মুখ দিয়া বান্দরের মতো আওয়াজ করব।

-যান আপনার স্বপ্ন পূরণ করে দিচ্ছি। আগামীকাল থেকে আপনাকে সাত দিনের ছুটি দেওয়া হলো। এর মধ্যে সব গোছগাছ করে নিন। সাত দিন পর আপনি বান্দরবান গিয়ে কাজে যোগ দেবেন।

-স্যার, আমি জানি আমারে কেউ বেশি দিন রাখবে না। তাই আমার সবকিছু সব সময় গোছানোই থাকে। আপনি চাইলে আমি আগামীকালই চলে যেতে পারব। স্যার, আমি কি আপনাদের দুইটা প্রশ্ন করতে পারি?
-জি করেন?
- আচ্ছা স্যার, বান্দর কীভাবে আওয়াজ করে? ক্যা ক্যা ক্যা নাকি এ্যা এ্যা এ্যা…? আসলে এ নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড। আপনারা কেউ কি বান্দরের ডাক দিতে পারেন? পারলে আমারে একটু শিখায়ে দেন। বান্দরবানে যাওয়ার আগে আমি ডাকটা শিখে যেতে চাই।

কেউ কোনো উত্তর দিলেন না। সবাই চোখ বড় বড় করে জাকির সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু অপেক্ষা করে জাকির সাহেব তাঁর ২ নম্বর প্রশ্ন করলেন।
-স্যার, আমার জানামতে, সৈনিকদের সবচেয়ে বড় শাস্তিমূলক বদলি হচ্ছে পাহাড়ে বদলি। যেটা আমাকে এইমাত্র আপনি করলেন। স্যার, এরপর ডিপার্টমেন্ট আমাকে কোথায় বদলি করবে বলতে পারেন? আমি আসলে বদলি হতে হতে একদম ক্লান্ত হয়ে গেছি। একদিকে প্রেমিকার অদ্ভুত ব্যবহার। আর অন্যদিকে আপনাদের এ ধরনের আচরণ। আমি আর নিতে পারছি না, স্যার।

জাকির সাহেব অনুভব করলেন, তার চোখ দুটো জলে ভরে যাচ্ছে। রুমে উপস্থিত সবাই জাকির সাহেবের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। জাকির সাহেব আর কিছু না বলে স্যালুট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।

বি: দ্রষ্টব্য: জাকির সাহেবের গল্প কি আপনারা আরও শুনতে চান?