অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে-প্রান্তরে
গত ১৭ মার্চ ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। ম্যানচেস্টার থেকে বাসে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নেমে পড়ি। গুগলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় লিখে সার্চ দিলে আমাদের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের কাছে নিয়ে যায়। প্রশাসনিক ভবনের কাছে গিয়ে ভারতীয় এক শিক্ষার্থী আমাকে প্রশ্ন করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়? আমরা সচরাচর যেমন বিশ্ববিদ্যালয় দেখে থাকি, অক্সফোর্ড তার চেয়ে ব্যতিক্রম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৪৩টি কলেজ আছে, যার মধ্যে ৩৯টি কলেজ স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রতিটি কলেজেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।
এই কলেজ সিস্টেম গড়ে ওঠার পেছনে নাকি একটি গল্প আছে। ঠিক আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে যেমন মাঝেমধ্যে মারামারির খবর আসে, ঠিক তেমনই। ১৩ শতকের মাঝামাঝি কোনো একসময় অক্সফোর্ডের স্থানীয় বাসিন্দা ও ছাত্রদের মধ্যে তুমুল মারামারি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২৪৯ থেকে ১২৬৪ সালের মধ্যে আবাসিক ব্যবস্থায় প্রথম কলেজ সিস্টেম গড়ে ওঠে।
ব্যালোলি ও মার্টন কলেজকে অক্সফোর্ডের সবচেয়ে পুরোনো কলেজ ধরা হয়। তবে অনেক কলেজই নাকি নিজেদেরকে সবচেয়ে পুরোনো বলে দাবি করে। এক্সিটার কলেজের গেটে বসে থাকা এক অফিস সহায়ককে প্রশ্ন করেছিলাম, এখানে সবচেয়ে পুরোনো কলেজ কোনটি? উনি তখন উত্তরে ওপরের দুটি কলেজের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, এর বাইরে অনেক কলেজ নিজেদের সবচেয়ে পুরোনো কলেজ বলে দাবি করে।
অক্সফোর্ডের প্রশাসনিক ভবনের এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা গুগল ম্যাপ চালু করে এগিয়ে চলেছি অক্সফোর্ডের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপনা ‘রেডক্লিফ ক্যামেরা’ দেখার জন্য। এটি আসলে একটি লাইব্রেরি কিন্তু এর অনন্য স্থাপত্যশৈলী একে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ রেডক্লিফ ক্যামেরার সামনেই অবস্থিত ‘দ্য ইউনিভার্সিটি চার্চ অব সেন্ট মেরি দ্য ভার্জিন’। আমরা রেডক্লিফ ক্যামেরার সামনে ছবি তুলে চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলাম। এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। নিচতলায় প্রার্থনা কক্ষ ও ওপরতলায় গ্যালারি রয়েছে, যেখানে বসে প্রার্থনা করা যায়। চার্চের ভেতরকার রাজকীয় পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্যকে ধারণ করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।
চার্চ থেকে বেরিয়ে কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো। তার কাছে জানতে চাইলাম, সবচেয়ে সুন্দর কলেজ কোনটি? সে প্রত্যুত্তরে বলল, এখানে সব কলেজই সুন্দর, তবে আজ বেশির ভাগ কলেজে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে তোমরা নিউ কলেজে যেতে পার। মেয়েটির কথামতো নিউ কলেজের দিকে এগিয়ে চললাম। মূল রাস্তা থেকে একটি গলি ধরে নিউ কলেজের দিকে এগিয়ে চলেছি। গলিটি দেখে মনে হচ্ছিল কত শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। গলির দুই পাশের স্থাপনাগুলো সেই পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে আছে। পাথরগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে, কাঠের দরজাগুলো কেমন যেন বিবর্ণ, দেয়ালের গায়ে স্যাঁতসেঁতে ভাব ধরে আছে। এই যে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরা, এটাই আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করেছে। এই পুরাতনকে সাক্ষী রেখে নিউ কলেজের প্রবেশদ্বারে গিয়ে হাজির হলাম। ভেতরে প্রবেশের জন্য সাড়ে সাত পাউন্ড ফি দিতে হবে। ফির কথা শুনতেই উপলব্ধি হলো ব্রিটিশরা ব্যবসা বোঝে!
সাড়ে সাত পাউন্ড ব্যয় করার পড় নিউ কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। মাঝখানে সবুজ লন, তার চারপাশে সেই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা একেবারে অন্য রকম পরিবেশ। মাঝখানের গেট পেরিয়ে আরও ভেতরে প্রবেশ করতেই মনটা আরও ভালো লাগায় আছন্ন হয়ে গেল। রাজকীয় গেট স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। গেট পেরোতেই সবুজ মাঠ, মাঠের একপাশে রাস্তা, আরেক পাশে ফুলের সমারোহ। মাঠের পাশেই সরু রাস্তা। সেই রাস্তা পেরিয়ে কলেজের একাডেমিক ভবনের দিকে এগিয়ে চললাম। পুরোনো স্থাপনার ভবন আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেটি অক্সফোর্ডের ঐতিহ্য আর আভিজাত্যকে ধারণ করে আছে।
নিউ কলেজ থেকে বেরিয়ে এবার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির দিকে এগিয়ে চললাম। চলার পথে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজের দেখা মিলল। এই কলেজের গেট থেকে ভেতরটা খুব সুন্দর লাগল। এখানেও যথারীতি সবুজের সমারোহ; সঙ্গে সেই আইকনিক স্থাপনা। মিউজিয়ামের ভবনটা দেখতে অসাধারণ। এখানে প্রবেশ উন্মুক্ত। এই ভবনে তিনটি ফ্লোর আছে। নিচের ফ্লোরে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস, প্রাণের বিবর্তনের ইতিহাস, ডাইনোসরের কঙ্কালসহ হাজারো সংগ্রহের সমারোহ। এর সঙ্গে পৃথিবী বিখ্যাত মনীষীসহ অক্সফোর্ডের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের ভাস্কর্য মিউজিয়ামের শোভা বৃদ্ধি করেছে। দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন দেশের কারুশিল্পের সমারোহ আর তৃতীয় তলায় মানুষের বিভিন্ন আবিষ্কারের নমুনা রাখা আছে। বন্দুকের বিবর্তনের গ্যালারি দেখে অভিভূত হলাম। নানা আকৃতির হাজারো বন্দুকের সংগ্রহ আছে; সঙ্গে মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কুঠারের সংগ্রহও দেখার মতো। আসলে এই মিউজিয়ামে এত কিছু সংগ্রহ আছে যে এগুলো ভালোভাবে দেখতে গেলে কয়েক দিন লেগে যাবে।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এবার বিখ্যাত হাই স্ট্রিট ধরে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি কলেজ, পরীক্ষাকেন্দ্র। বেশির ভাগ কলেজের প্রবেশদ্বার বন্ধ। চলতি পথে দ্য কুইন কলেজের চ্যাপেলের প্রবেশপথ খোলা দেখে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চ্যাপেলে প্রবেশের রাস্তার দুই পাশে এক বিশেষ প্রজাতির প্রস্ফুটিত ফুলের সারি দেখে অভিভূত হলাম; সঙ্গে চ্যাপেলের মূল ভবনের নকশার ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো।
দ্য কুইন কলেজের চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে অক্সফোর্ড বোটানিক গার্ডেনের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। এখানে প্রবেশ ফি ছয় পাউন্ড দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো বোটানিক গার্ডেন, বয়স প্রায় চার শ। এখানে পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। বোটানিক গার্ডেনের পাশ দিয়ে একটি খাল বয়ে গেছে। অনেকেই এই খালে নৌকায় ভ্রমণ করে। বোটানিক গার্ডেনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে পৃথিবীর নানান দেশের উদ্ভিদ জন্ম দিয়েছে। এক জায়গায় বাংলাদেশের খাল–বিলে ফুটে থাকা লাল শাপলা ও শ্যাওলা দেখে অভিভূত হলাম। এক জায়গায় কফিগাছের চারা দেখে ভালো লাগল। দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার এক পাহাড়ে নাকি এই কফির উৎপত্তি। ১৬ শতকের দিকে প্রথমে মুসলিমদের মধ্যে কফি খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। এরপর সতেরো শতকের দিকে খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত এলাকায় কফির প্রচলন শুরু হয় আর এখন তো সারা বিশ্বে অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় কফি। বোটানিক গার্ডেন আসলে একদিনে দেখে শেষ করা মুশকিল।
অপ্রাপ্তি নিয়ে বোটানিক গার্ডেন থেকে বেরিয়ে হাই স্ট্রিট ধরে বাসের গন্তব্যে হেঁটে চলেছি। প্রতিটি কলেজের সঙ্গেই মোটামুটি গির্জার দেখা মেলে। একই সময়ে গির্জা থেকে ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠতেই কেমন যেন একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। বাসায় এসে অক্সফোর্ডের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখলাম এখনো নাকি কলেজগুলোয় খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ ধরে রাখার প্রচেষ্টা আছে। এখানে আধুনিকতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার যোগ এখনো রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার সময় এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরে আসার পর আমার এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করে, অক্সফোর্ড আসলে কেমন? আমি তার প্রত্যুত্তরে বলি, অক্সফোর্ড আসলে জাদুর ঠিকানা। কী নেই সেখানে? ইতিহাস, ঐতিহ্য, আভিজাত্য, স্থাপত্য, শিল্প, শিক্ষা, গবেষণা আর দুনিয়াজোড়া সুনাম এই সব প্রপঞ্চের সমন্বয় হলো অক্সফোর্ড। ‘Dominus Illuminatio Mea’ বা ‘প্রভু আমার আলো’ এই প্রত্যয় নিয়ে ১০৯৬ সালের কোনো এক সন্ধিক্ষণে গড়ে উঠেছিল যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, তার রেশ রয়ে যাবে অনাদি কাল ধরে।
লেখক: সুব্রত মল্লিক, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, ইউকে এবং সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।