স্মৃতিচারণ: আলোর ঝরনাধারা
বিয়ের পর চিঠি লিখে, দ্বিতীয়বার দেখাদেখি না করেই কেটে গেলে অর্ধেকটা বছর। ছয় মাস পর জানুয়ারি মাসের শুরুতে সন্ধ্যার আকাশে আতশবাজির শব্দ ও আলোয় বাড়ির আঙিনা আলোকিত করে ঘরে এল নতুন বউ। বাসররাতের পর কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোরে দুজনে বেরিয়েছি হাঁটতে। সারপ্রাইজ দিতে অনুজতুল্য ফটোগ্রাফার পিটারও চুপিচুপি চলে এসেছে ছবি তোলার জন্য। এরপর বন্ধুর বাড়ি ও আপার বাসার দরজায় কড়া নাড়ি। সকালের আলোয় নিরাভরণ নতুন বউ দেখে আকাশসমান বিস্ময় ঝনঝন শব্দে নেমে আসে তাদের চোখের পাতায়। শীতের রোদ গায়ে মেখে কর্মচঞ্চল শহরের শব্দ দুহাতে নিয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরি। পরিচিত অফিসযাত্রীদের বিস্ময়মাখা হাসির ঢেউ ওঠে চারপাশে। ‘ইশ্ দেখো, মেহেদির আলপনায় জড়ানো নতুন বউ শীতের সকালে রিকশায়!’ দুই যুগ আগের হারিয়ে যাওয়া দুজনের সেসব চিঠির সন্ধান পেয়েছি এই তো সেদিন। উদ্ধার করা সেসব চিঠি দ্বিতীয়বার আর পড়া হয়নি আজও। চিঠির পৃষ্ঠা কি খুলে ধরব রোদ্দুরের আলোয়?
কনসিভ করলেও দেখেছি, সন্তানসম্ভবারা খাবার খেতে পারেন। এ যে একেবারেই উল্টা। কিছুই খেতে পারে না। দিন-মাস ঘুরে সময় ঘনিয়ে এলে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও কোনো জটিলতা ছিল না। ছিয়ানব্বই সালের শেষলগ্নে শীতের এক দুপুরে কন্যাসন্তানের (আফসারা তাসনিম—কারিমা) আগমন এ ধরায়। অগ্রজ পারভেজ ভাইকে শিশুর আগমনবার্তা জানালাম ফোনে। প্রশ্ন করলেন, ‘ক্যামেরা এনেছেন?’ নাহ, টেনশনের সাগরে সাঁতরে হাবুডুবু খাই। আবার ক্যামেরা, ক্যামেরার নিকুচি করি, খেতা পুড়ি। করিৎকর্মা বন্ধু অন্তঃপ্রাণ পারভেজ ভাই কারওয়ান বাজারের বস্ত্র ভবনের অফিস থেকে দুপুরে শীতরোদের অলসতার জট খুলে ছবি তুলে ঋণী করে গেলেন। পরদিনই তোয়ালে জড়ানো তুলতুলে কন্যার রক্তিম দ্যুতি ছড়ানো রঙিন ছবি নিয়ে হাজির।
আহ্, নবম দিনেই শিশুর ডায়রিয়া। রাতে ডাক্তার বললেন, শিশুসহ মহাখালী চলে যান। ফজরের নামাজের আজানের পরপরই সেজ দুলাভাই (প্রয়াত) জানালার কাছে এসে ডাকছেন, ‘দুলাভাই, চলেন, এখনই হাসপাতালে যাই।’ আরে, শিশুর তো পুঁটি মাছের প্রাণ। স্কুটারে মহাখালী আসার পর অ্যাডমিশনে অসংখ্য প্রশ্ন। এ এক প্রশাসনিক বালখিল্যতা! ভর্তির পর ৩–৪ ঘণ্টার মধ্যেও কোনো ট্রিটমেন্ট মেলেনি। আবার কন্যাকে নিয়ে ছুটলাম নিবেদিতা নার্সিং হোমে। অগণিত মানুষের মধ্যে নিবেদিত, শিশু অন্তঃপ্রাণ ডাক্তার এম আর খান (প্রয়াত)। গুঞ্জন ও ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে বললাম, নিউবর্ন বেবির ডায়রিয়া। ডিউটিরত জুনিয়র এক ডাক্তারকে ডেকে বললেন, ‘তুমি এখনই বেবির ট্রিটমেন্ট শুরু করো, অন্য কাউকে বলো অ্যাডমিশনের পেপার রেডি করতে।’ ডাক্তার ব্লেড নিয়ে এসে বললেন, ‘মাথার চুল সেইভ করে স্যালাইন দেব, আপনি সরে যান, একটু পরে আসবেন।’
প্রথম শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অনুভূতির, অনুভবের অপঠিত আকাশের দ্বার খুলে যায়। আর একমাত্র তখনই এই অনাবিল অনুভূতির কথা উপলব্ধি করা যায়। নিজের পিতা-মাতার প্রতিও শ্রদ্ধায় আপ্লুত হই। একটি শিশু তার চোখ বন্ধ করে তিল তিল করে বেড়ে ওঠে মায়ের পেটের দুই স্তরের অন্ধকার জগতে। শিশুটি বাবার কোলে এসে আলোকিত করে বাবার হৃদয়। সময়ের বৈতরণী বেয়ে বাবার অশ্রু ঝরিয়ে আবার আলো ছড়ায় আরেকজনের ঘর ও মন। আলোয় স্নাত হয় আরেক ভুবন। জায়গা বদল করা এই আলোর ভুবনের অপর নাম ‘কন্যা’। তারই আলোর ঝরনাধারায় আলোকিত এই ধরা।