সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি কাক
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর ভ্রমণ করতে গিয়ে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। এ শহরের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশের এলাকা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। উঁচু উঁচু দালান। বেশ সাহেবি পোশাক পরে লোকজনের চলাফেরা।
আমি হাঁ করে ওপরে তাকিয়ে দালানের তলা গণনা করি... সতেরো, আঠারো, উনিশ ইত্যাদি। হঠাৎ দেখি এক দালানের উঁচুতে বিশাল করে লেখা সুইস ক্রেডিট ইউনিয়ন। এই সেই জগৎ বিখ্যাত সুইস ব্যাংক, যেখানে ধনীদের সম্পদ লুকিয়ে থাকে। আশেপাশে এই ব্যাংকের আরও অনেক দালান।
ভাবলাম এত বড় লোকদের ব্যাংকের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, একটু লেনদেন বা ঢু না মারলে তো ইজ্জতের ব্যাপার। গেলাম এটিএম মেশিনের সামনে। উদ্দ্যেশ্য বিশ ডলার উত্তোলন। এটিএম কার্ড ঢোকানোর পর মেশিন তার পর্দায় দেখালো ইনভেলিড কাস্টমার। অর্থাৎ অবৈধ গ্রাহক।
কি আর করা। উল্টো দিকে ফিরে দরজা দিয়ে ফেরত আসব, এমন সময় দেখি দরজার পাশে দুই কাক বিধ্বস্ত অবস্থায় মাটিতে বসে বাংলায় ঝগড়া করছে,
—তোর লাইগা আমার আইজকা এই অবস্থা?
—চুপ কর, দ্যাশে গেলে তোর বিচার করমু।
মাটিতে মুখ আটকানো অবস্থায় একটা ছালার ব্যাগ পড়ে আছে।
আমাকে দেখেই পুরুষ কাকটা ঝগড়া থামিয়ে বলে উঠলো,
—ভাইজান কি বাংলাদেশি?
—জ্বি। আপনারা?
—আমরাও। দ্যাশ থাইক্যা আইছি এই ব্যাংকে টেকা থোয়নের লাইজ্ঞা।
—কিন্তু এই ব্যাংকের দরজায় বসে কী করছেন? ব্যাগ কার? কী আছে তাতে?
—ভাই, আমাগো একটু সাহায্য করেন। কাহিনি অনেক লম্বা। গত ১১ দিন যাবৎ ঢাকা থেকে এই ব্যাগ নিয়া উড়াল দিয়া আমি আর আমার বউ এইখানে আসছি।
বলেন কি! আপনার পরিচয়? ব্যাগের ভেতর কী? কেন এসেছেন? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন।
কাক বলল, আমার নাম আলফাজ মিয়া। আমার বউয়ের নাম মুন্নি আক্তার (কাকী)। এই ব্যাগের ভেতর বাংলাদেশি টাকা। শুনছিলাম সুইস ব্যাংকে টাকা রাখলে নাকি দুনিয়ার কেউ সেই টাকায় হাত দিতে পারে না। তাই এত কষ্ট কইরা ঢাকা থেকে টাকা নিয়া সোজা উইড়া আইছি।
—তাই নাকি! কিন্তু ব্যাংকে জমা দেন নাই কেন?
—ভাই, বিরাট ভুল হইছে। গেছিলাম জমা দিতে। বলল ওরা নাকি সরাসরি টাকা জমা নেয় না। এই সবগুলি টাকারে ডলার বানায়া নিয়া আসতে হবে। দ্যাশে থাকতে আমারে একজন এই কথা বলছিল কিন্তু শুনি নাই। এখন বিরাট বিপদে আছি।
—কী আজব ব্যাপার। আচ্ছা, আলফাজ মিয়া, আপনি ঢাকায় করেন কি? থাকেন কোথায়?
আলফাজ মিয়া বলল, আমি ঢাকার রাজউক বিল্ডিংয়ের ৫ নাম্বার নারিকেল গাছে থাকি ৯ বছর যাবত। আমার বউ থাকে দুদক বিল্ডিংয়ের কাঁঠাল গাছে। আপনাদের দোয়ায় উত্তরা ও বানানী এলাকায় আমার আরো ১১টা বাসা আছে। আমার বউয়ের নামে নিকেতনে নতুন বাসা বানাইতাছি। নাম দিছি ‘কাকালয়’। ওই বাসাটা হইবো ইরানি রাজহাঁসের পালক দিয়া। কসম দিয়া কইতে পারি এই রকম বাসা দুনিয়ায় আর কোন কাকের নাই। আমার বউয়ের আবার সাধ–আল্লাদ একটু বেশি তো। হের অনেক দিনের হাউশ রাজহাঁসের পালক দিয়া তৈরি বাসায় থাকব।
—বাহ বেশ! কিন্তু এখন এই টাকা নিয়ে কী করবেন?
—ভাই, আইছিলাম তো জমা দিতে, কিন্তু এখন কি করমু কিছুই বুঝতে পারতাছি না। ব্যাংকের একজন কইলো দুবাইতে চেষ্টা করতে। আমি এখন এত দূরে কেমনে যামু? আমার বউয়ের অবস্থা আরও খারাপ। আইছিলাম তার নামে একাউন্ট খুইলা টাকা জমা দিমু।
আমি লক্ষ্য করলাম, কাকের স্ত্রী মুন্নি আক্তারের অবস্থা বেশ খারাপ। দীর্ঘ ভ্রমণে সে বিপর্যস্ত। দুই ডানা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে শুয়ে আমাদের কথা শুনছে। কোথাও কোথাও পালক এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। ঠোঁটের এক পাশ দিয়ে লালা পড়ছে। খুব কষ্ট করে অস্পষ্ট ভাষায় আমাকে বলল,
—আফনে আমার ধর্মের ভাই লাগেন গো ভাই। এই ব্যাগে যত টেকা আছে, সব আফনের ভাই গো। বিনিময়ে আমাগো দুইজনরে যেমনেই হউক একটু দ্যাশে পাডানোর ব্যাবস্থা করেন। আমরা মইরা যামু। এই মরার দ্যাশে সারাদিন খুইজ্জাও কোন খাবার পাই নাই। সব ডাস্টবিন তালা মারা থাকে। এই টাকার ব্যাগ নিয়া হেয় আর আমি কত হোটেলে গেলাম খাইতে। কেউ পাত্তা দিলো না। এহন আমরা কী করুম কন দেহি?
—আচ্ছা, এত টাকা পেলেন কোথায়?
—টেকা আমাগো আরও আছে। হের এই বস্তা আইছে বিসিএসের নির্বাচনের নমিনেশন থেইক্কা।
বলেন কি? কাকদেরও আবার বিসিএস পরীক্ষা আছে নাকি?
—না ভাই। এইডা পরীক্ষা না, আলাদা ব্যাপার। আলফাজ মিয়া তার স্ত্রীর কথার ধারাবাহিকতা চালিয়ে গেল...
—এই বিসিএস হইলো বাংলাদেশ ক্রো সোসাইটির নির্বাচন। পুরা বাংলাদেশের কাকদের নিয়ে আমাদের এই সংগঠন। ভাইজান মনে হয় জানেন না যে আমরা কাক হইলেও দেশ স্বাধীন হইবার পর থেকে আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য ফাইট কইরা যাইতাছি।
—খুবই ভালো উদ্যোগ। আপনারা কী নিয়ে ফাইট করেন? কিছু উদাহরণ দেন তো।
—এই ধরেন আমরা এখন দুই দফা দাবী আদায়ের জন্য আন্দোলন করতাছি।
এক, কাক জাতীয়করণ দাবী (কাজাদা)। আমরা চাই সরকার অতি শীঘ্রই কাককে জাতীয় পাখি হিসেবে স্বীকৃতি দেউক।
—ভাই আপনেই কন, শুধু ঢাকার হাইকোর্ট এলাকায় আমরা যে কয়জন কাক আছি, পুরা বাংলাদেশ খুঁজলেও কি সেই কয়টা দোয়েল পাখি পাইবেন? তাইলে কন! আমরা কেন জাতীয় পাখি হিসাবে স্বীকৃতি পাব না?
২ নম্বার দাবী, কাকদের গৃহায়ণ বা আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য শহরগুলোতে কাকবান্ধব বৃক্ষরোপন। দেশের মানুষ খালি ফুল আর ফলের গাছ লাগায়। আমাগো কথা চিন্তা করে কেউ বড় বড় গাছ লাগায় না।
কি কমু ভাই, কয়েক বছর আগে শুধু রমনা পার্কের বড় বড় কিছু গাছ কাটাতেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কাক বাস্তহারা হয়।
কন দেহি, হেরা যাইব কই? আমরাতো চড়ুই পাখি না যে আপনের দালানের চিপায় গিয়া ডিম দিবো বা সংসার পাতব। আমাদের এই দাবিতে আমেরিকান ক্রো অ্যাসোসিয়েশন পুরা সমর্থন দিতাছে। ভবিষ্যতে জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গেও কাজ করার ইচ্ছা আছে।
—মানলাম, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এতো টাকা পেলেন কোথায়?
—ভাই, কাকদের নিয়া রাজনীতি করি সাত বছর ধইরা। আমি মহানগর কাক সমিতির প্রেসিডেন্ট...
মুন্নি আক্তার হঠাৎ আলফাজ মিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
—হের এই টেকার পুরাডাই চুরির। সামনে বিসিএস নির্বাচনের নমিনেশন বিক্রি কইরা এই বস্তা বানাইছে। এই বুইড়ার লোভে পইড়া আমার এই অবস্থা।
কাক আলফাজ মিয়া ইতস্তত করে কিছু বলতে চাচ্ছিল। মুন্নি আক্তার তাকে থামিয়ে দিয়ে
বলে চললো—
বিয়ার পরে রাজউক ভবনের নারকেলগাছে যখন উঠি, তখন আমাগো সংসার মহাসুখের। খাই-দাই আর দুইজনে মিইল্ল্যা উড়ি। ইস্টেডিয়ামে খেলা দেহি, বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর দিয়া উড়ি, ঢাকায় বড় বড় বিয়া থাকলে বাসার পিছনে গিয়া খাবার খাই, আরও কত কত ফুর্তি করি। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর প্রথমবার চাইরটা ডিম দিলাম। সব কয়ডা থিক্ক্যাই বাচ্চা ফুটল। তিনটা পোলা, একটা মাইয়া। বড় পোলা জুলহাস ১৭ দিনের মাথায় গাছ থিইক্ক্যা পইড়া মইরা গেল। অনেক দুঃখ পাইছিলাম। তারপরেও আমি মানায় নিলাম।
কিন্তু জুলহাসের বাপেরে লোভে পাইল। হের নতুন নতুন এলাকায় নতুন নতুন গাছে বাসা বানানোর নেশায় পাইল। শুধু তাই না। সঙ্গে মেয়ে লোকের নেশাও। খরকুটা বাদ দিয়া সোনার চেন, চুরি, বিদেশি পাখির পালক দিয়া বাসা বানানোর নেশা। বনানী, গুলশান, উত্তরাসহ ঢাকার সব নামীদামি এলাকায় হের বাসা আছে। নতুন নতুন বাসায় নতুন নতুন মেয়েলোক তোলে।
তারপর রাজউকে শুরু করল দালালি। ওই অফিসে জমিজমা, বাসাবাড়ির সমস্যা নিয়া যত লোকজন আইতো, হেগো গোপন কথা শুইনা অফিসের কর্মচারীদের জানায় দিত। ওইখান থিইক্ক্যা সে পার্সেন্টেজ নেওয়া শুরু করল। তারপর আরও কিছু সন্ত্রাসী কাক নিয়া দল কইরা দালালি শুরু করল দুদক, ওয়াসা ভবন, পিজি হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কারওয়ান বাজারসহ শহরের সব অলিগলিতে।
রমনা পার্কে যে কয়টা গাছ কাটা হইছে, তাতে ওর হাত আছে। শুনছি ওই গাছগুলিতে ওর বিরোধী দলের কাকেরা থাকত।
তিন মাস আগে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যে তিনডা বিলাইরে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়, হের মূলেও এই বেডা আছিল…
কি সর্বনাশ? বিড়ালের সঙ্গে আবার আপনার মতো কাকদের কী সম্পর্ক?
—শুধু বিলাই না। কুত্তাগো লগেও আমাগো যুদ্ধ করতে হয়। বেশির ভাগই হয় কাঁচা বাজারের দখল লইয়া, নাইলে খাবারের ভাগ বাটোয়ারা লইয়া। গত বছর কারওরান বাজারের কসাই পট্টিতে পুরান ঢাকা আর এলাকার গলির কাকগো লইয়া বিরাট ক্যাচাল হয়। ওই ক্যাচালে সন্ত্রাসী লেঞ্জা কাটা মিউ বিলাইরে মাইরা ফ্যালায় জিমি কুত্তা। জিমি কুত্তারে ৯ কেজি গোশতের বিনিময়ে ভাড়া করে গলির কাকেরা। হুনছি কাম সাইরা জিমি গা ঢাকা দিছে। মিউ বিলাই বহুদিন ধইরা কাকেগো কিছুরই ভাগ দিতো না। সব একাই খাইতো।
কাকের স্ত্রী মুন্নী আক্তার যখন তার গল্পের ঠিক এই পর্যায়ে এল, তখন এক সুইস গ্রাহক বিশাল আকৃতির জার্মান শেফার্ড কুকুর নিয়ে দরজার ভেতর ঢুকল। মাটিতে বসা দুই কাক দেখে কুকুরটি ভয়ংকর শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
মুন্নি আক্তার মরি কি বাঁচি বলে কা…. কা…. কা… কা…. চিৎকার করে উঠল,
‘ও…রে জুলহাসের বাপ, এইডা তো দেহি জিমির থিক্ক্যাও বড়। আমারে মাইরা ফালাইবো। জলদি পালাও। কা…কা….কা…
...ও মা গো..বাঁচাও বাঁচাও বলে কোন রকমে দরজার ফাঁক দিয়ে সে উড়ে চলে গেল। তার পেছন পেছন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে গেল আলফাজ মিয়া।
আমি খুব দ্রুত বাইরে এসে তাদেরকে অনেক করে খুঁজলাম। কিন্তু আশপাশের দালানগুলোতে কোথাও খুঁজে পেলাম না।
জুরিখ শহরের পরিষ্কার নীলাকাশে শুধু দেখলাম একদল কবুতর পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
উপায়ান্তর না বুঝে আমি অগত্যা জুরিখ সেন্ট্রাল রেলস্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।
বি. দ্র.: এটি একটি অলীক কাহিনি বা গল্প। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নয়। স্রেফ বিনোদন।
*লেখক: জামাল সৈয়দ, জুরিখ, সুইজারল্যান্ড
**দূর পরবাস-এ লেখা পাঠাতে পারবেন প্রবাসের পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]