রাজনীতি ও প্রতিহিংসা: বাংলাদেশের বাস্তবতা শেক্সপিয়ারের আলোকে
শেক্সপিয়ারের অমর নাটক ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর এক প্রসঙ্গে দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা অ্যান্টোনিওর থেকে এক পাউন্ড মাংস দাবি করেন ঋণদাতা শাইলক। এই দাবি আইনসম্মত হলেও তা মানবিকতার সব সীমা লঙ্ঘন করে। আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি যেন সেই একই নাটকের প্রতিফলন, যেখানে ক্ষমতার খেলায় শাইলকের মতো একপক্ষীয় আইন আর প্রতিহিংসা ছাড়া অন্য কোনো উপাদান নেই।
বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শাসনকালের প্রতিটি পর্যায়ে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে প্রতিহিংসার পথ বেছে নিয়েছিল।
অন্যদিকে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার আগে তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু সেই দেশত্যাগ ছিল একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের প্রতিফলন। বাস্তবতা হলো, ক্ষমতার কেন্দ্রের প্রতি অবিশ্বাস তখনো ছিল, এখনো আছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা জনগণের ক্ষোভকে আরও ঘনীভূত করেছে, আর এ দুই ঘটনা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।
শেক্সপিয়ারের নাটকে শাইলক তার ঋণপত্রের দাবি প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রতিশোধ; ন্যায়বিচার বা মানবিকতা সেখানে গুরুত্বহীন ছিল। শেষ পর্যন্ত বিচারকের হস্তক্ষেপে ন্যায়বিচার জয়ী হয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে কি সব সময় এমনটি ঘটে? বাংলাদেশে রাজনীতির শাইলকরা আইনের ব্যবহারকেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে সব সময়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। কিন্তু বাস্তবে এই শক্তি প্রায়ই প্রতিহিংসার খেলায় ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাস বলে, জনগণের ঐক্য সরকারের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তার অনেক প্রমাণ আমরা দেখেছি। জনগণ অনেক সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, তবে প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে কঠিন জবাব দিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা চলছে, সেখানে স্বৈরাচারী চক্র নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশ কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। জাতি আজও ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়ছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—গণতন্ত্র কি কেবল নির্বাচন আর ভোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন জনগণ প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিত্যাগ করে ন্যায়বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন একটি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানবিকতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীন চিন্তাকে শিক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রদের শুধু চাকরির জন্য তৈরি করছে, কিন্তু মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও সৃজনশীল চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের আর্থিক সফলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কিন্তু নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা শেখাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি শুধু লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষানোর জন্য, নাকি মানবিক চিন্তাধারার প্রসার ঘটানোর জন্য?
আজকের শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং জীবনের গভীর অর্থ অনুধাবনের দীক্ষা দেবে। শিক্ষা হবে সৃজনশীলতা, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তোলা। পাঠ্যক্রম এমন হতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা করতে শেখাবে এবং শিক্ষকদের আলোর পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়ে তুলবে।
রাজনীতিতেও মানবিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজন, যা প্রতিহিংসার পথ পরিত্যাগ করবে। জনগণের ভূমিকা হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ হওয়া। আইন হবে মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে, শাসকের হাতিয়ার নয়। শেক্সপিয়ারের শাইলকের মতো প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, আমাদের শিক্ষা ও রাজনীতি উভয়ের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত মানবিক মূল্যবোধ।
‘তুমি যদি আমাকে কেটে ফেলো, আমার রক্তও লাল’—শেক্সপিয়ারের এই উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি মানুষ সমান, আর ন্যায়বিচারের জন্য মানবিক মূল্যবোধ অপরিহার্য। যদি আজকের শিক্ষা সৃজনশীলতার কারাগার হয়, তবে আগামী দিনের শিক্ষা হবে মুক্তচিন্তার আলো।
একটি সুশিক্ষিত সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন এমন শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি হবে স্বাধীন, চিন্তা হবে মুক্ত, আর মানবতা হবে সর্বোচ্চ আদর্শ। মানবিক মূল্যবোধে দৃঢ় এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন শিক্ষা হবে মুক্তচিন্তার বাহন এবং রাজনীতি হবে ন্যায়বিচারের প্রতীক।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]