১৬২তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অনালোচিত-ব্রাত্য রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের স্মরণে পাঠশালার আসর

ছবি: সংগৃহীত

কানাডার টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ৪৩তম ভার্চ্যুয়াল আসরটি ২০ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ আসরে রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য দেন ‘রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার’ বইয়ের লেখক রবীন্দ্র–গবেষক পীতম সেনগুপ্ত। বিভিন্ন স্বরলিপিকারের স্বরলিপি করা রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনায় ছিলেন গুণী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক তানিয়া মান্নান ও মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা। সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

‘গীতবিতান’-এ রবীন্দ্রসংগীতের পুরোপুরি পরিচয় মেলে না। রবীন্দ্রসংগীত শব্দটি পূর্ণতর রূপ পায় ‘গীতবিতান’ ও ‘স্বরবিতান’ এ দুই বইয়ের (স্বরবিতানের অনেক খণ্ড) সমন্বয়ে। কাজেই রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং প্রধান বিষয় স্বরবিতানকে সবার আগে মান্যতা দিতে হয়। স্বরলিপি-সংক্রান্ত বিতর্কের বিষয়ে রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমীরা কমবেশি সবাই জানেন। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একেবারেই হয় না তা হলো, রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি লেখার ইতিহাস এবং স্বরলিপি রচয়িতাদের প্রসঙ্গ। অল্প কয়েকজন জনপ্রিয় স্বরলিপিকারদের নামটুকু ছাড়া অধিকাংশ রবীন্দ্রগানের অনুরাগীর জানা নেই, কবির গান শোনার যে সৌভাগ্য হচ্ছে, তার পেছনে কোন কোন গুণী মানুষের অসামান্য অবদান কাজ করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কমবেশি দুই হাজার গানের মধ্যে মাত্র দু-একটি গানের স্বরলিপি নিজে করেছিলেন। ১৬২তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সেই অনালোচিত-ব্রাত্য রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার এবং তাঁদের স্বরলিপি করা রবীন্দ্রগানের পরিবেশনা নিয়েই ছিল এবারের পাঠশালার আসর।

‘রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার’ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশক কলকাতার সাহিত্য সংসদ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে রবীন্দ্রগানের সব স্বরলিপিকারের স্মৃতির উদ্দেশে। বইয়ে ৩২ জন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকার সম্পর্কে লেখা আছে। আরও আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানের বর্ণানুক্রমিক সূচি, রাগ/সুর, তালসহ রচনাকাল, স্বরবিতানের নম্বর, স্বরলিপিকারদের নাম।

আলোচক পীতম সেনগুপ্ত ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে কয়েকটি ভাগে আলোচনা হয়।

ছবি: সংগৃহীত

আসরের শুরুতেই স্বল্প আলোচিত-অনালোচিত স্বরলিপিকারদের তালিকা একটি ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। স্বরলিপিকারদের মধ্যে আছেন অনাদিকুমার দস্তিদার, অরুন্ধতী দেবী চট্টোপাধ্যায়, অশোকা দেবী চৌধুরী, আর্নল্ড এড্রিয়েন বাকে, ইন্দিরা দেবী চৌধুরী, কাঙালীচরণ সেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিভা দেবী চৌধুরী, প্রফুল্লকুমার দাস, বামনমোহন শিরোদকর, বিদ্যাধর ভেঙ্কটেশ ওয়াঝালকার, বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়, ভি বালসারা, ভীমরাও হসুরকার শাস্ত্রী, মোহিনী দেবী সেনগুপ্ত, রমা কর মজুমদার, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শৈলবালা রায়, সমরেশ চৌধুরী, সরলা দেবী, সাহানা দেবী, সুধীরচন্দ্র কর, সুভাষ চৌধুরী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ভঞ্জচৌধুরী, হিমাংশুকুমার দত্ত, অবনীভূষণ গোস্বামী, কৃষ্ণকিশোর দাস, দিলীপকুমার রায়, প্রিয়নাথ রায়, প্রেমলতা দেবী, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর স্টাফ নোটেশন করেছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, হার্বার্ট আর্থার পপলে, দ্যানিয়েঁল আল্যাঁ ও আর্থার গেডেস।

রবীন্দ্রনাথের গান সংরক্ষণের পেছনে থাকা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কোথাও সচরাচর আলোচনা হয় না। অথচ রবীন্দ্রসংগীতে বহুল জনপ্রিয় বিষয়টি কিন্তু শুধু ‘গীতবিতান’ গ্রন্থের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় না। ‘গীতবিতান’-এর পাশাপাশি ‘স্বরবিতান’-এর (৬৫ খণ্ড) সংযোগেই রবীন্দ্রসংগীতের আসন। কেন এমনটা বলা হয়, এর জবাবে পীতম সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘গীতবিতান’-এ রবীন্দ্ররচিত প্রায় দুই হাজারের গান মুদ্রিত আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০-এর মতো গান সুরে বদ্ধ আছে, যা বিভিন্ন খণ্ডের স্বরবিতানে লিপিবদ্ধ। এর বাইরে বাকি ২০০-এর মতো গানের সুর আর আজ পাওয়া যায় না। হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই সব গানের সুর করে থাকলেও কাছেপিঠে স্বরলিপি করতে জানা কোনো সংগীতবিশেষজ্ঞকে পাননি সুরটিকে স্বরলিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণের জন্য। ফলে ‘গীতবিতান’-এর সেই গান গীতিকাব্য হিসেবে মুদ্রিত থাকলেও তা গাওয়া যায় না। সেসব গানকে রবীন্দ্রসংগীত বলা যায় না। রবীন্দ্রসংগীত বলতে গেলে স্বরবিতানের আশ্রয় তাই অনিবার্য।

ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের নিয়ে পীতম সেনগুপ্তের গবেষণায় জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপি করেছেন তাঁর গানের। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। ১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিলাইদহ পর্বে থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ ১৪টি গান লিখেছিলেন। এর মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর লেখা ‘এ কি সত্য সকলই সত্য’ গানটি তিনি রেলপথে লিখেছিলেন। এ গানের স্বরলিপি কবি নিজেই করেছিলেন, স্বহস্তে লেখা সেই স্বরলিপি কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর কাছে ছিল। কবির প্রয়াণের তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেন ইন্দিরা দেবী এবং দাবি করেন, সম্ভবত এটাই কবির একমাত্র নিজের করা স্বরলিপি। কিন্তু এই শিলাইদহ পর্বেই তিন দিন আগে; অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর কবি লিখেছিলেন, ‘বঁধু, মিছে রাগ কোরো না’ গানটি এবং এই গান এক মাস পর প্রথম মুদ্রিত হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকার ১৩০৪ সনের কার্তিক সংখ্যায়। সেখানে এ গানের স্বরলিপিও প্রকাশিত হয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার, স্বরলিপিকারের নাম মুদ্রিত হয় রবীন্দ্রনাথের। আরও অবাক করার বিষয় হলো, দুটি গানের স্বরলিপি কিন্তু আকারমাত্রিক স্বরলিপির আদিরূপের। তাই গবেষক পীতম সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই স্বরলিপি করতে জানতেন এবং তার একাধিক প্রমাণও আছে। যেমন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে গেহেন্দ্রর বিয়েতে পর্তুগিজ সাহেব লোবোর ব্যান্ডে বাজানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজের দুটি গান, ‘শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল’ ও ‘শান্তি করো বরিষন নীরব ধারে’র নোটেশন লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার থেকে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে শান্তিনিকেতন পর্বে একাধিক স্বরলিপিকারদের পাশে পেয়েছিলেন। তাই নিজে স্বরলিপি রচনা থেকে বিরত থেকেছেন।

পীতম সেনগুপ্তের আলোচনায় নানা প্রশ্নের মাধ্যমে জানা গেছে, কীভাবে আকারমাত্রিক স্বরলিপি তৈরি হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। সেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখ্য ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়েছে। এখানেই আলোচক জানিয়েছেন, জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী সম্পাদিত ‘বালক’ পত্রিকার  প্রথম সংখ্যার ‘সহজ গান শিক্ষা’ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বল্ গোলাপ, মোরে বল্’ গানটির স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির গুণী সংগীতজ্ঞ-কন্যা প্রতিভা দেবী স্বরলিপিটি করেছিলেন এবং এটাই কবির গানের প্রথম মুদ্রিত স্বরলিপি। এমন করেই জানা যায়, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা ও সুরে বদ্ধ করার পর তা স্বরলিপি আকারে সংরক্ষণের জন্য কেমন করে তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের পাশে পেয়েছিলেন। বিশেষ করে এই পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা দেবী, ইন্দিরা দেবী, ভাগনি সরলা দেবী, নাতনি অশোকা দেবী ও নাতি দীনেন্দ্রনাথকে পাশে পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দীনেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ছবি: সংগৃহীত

দীনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির সম্পর্কের রসায়ন জানতে চাইলে আলোচক জানান, কবির জীবনের দীর্ঘ সময়ে তাঁর গানের ভান্ডারের কান্ডারি হিসেবে দীনেন্দ্রনাথ অত্যন্ত গর্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের মধ্যে বৈষয়িক ব্যাপারে কবি তাঁর এ পরমপ্রিয় নাতিকে ভুল বুঝতে শুরু করেন। দীনেন্দ্রনাথ কবির গানের সুর রক্ষণে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না, এমনতর নিন্দা সহচরদের কাছে যেমন শুনেছেন, তেমনই নিজেও প্রকাশ্যে নাতির বিরুদ্ধে খুব কঠিন কথা বলেছেন। দীনেন্দ্রনাথ একরাশ অভিমান নিয়েই সবার আড়ালে শান্তিনিকেতনের মায়া কাটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। অথচ তাঁর রবিদার জন্য তিনি নিজের অমন প্রতিভাকে বিকশিত না করে রবীন্দ্রসংগীতেই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এমন ত্যাগ কবির অন্য কোনো রবীন্দ্রসংগীত-সহচর করেননি।

ছবি: সংগৃহীত

পীতম সেনগুপ্ত ও শিউলীর কথোপকথনে আরও অনেক স্বরলিপিকারের নাম ও প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্বরলিপিকারের স্মরণে একগুচ্ছ রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের দুই প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী তানিয়া মান্নান ও মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা। তাঁদের একক কণ্ঠে একের পর এক গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।

স্বরলিপিকার ভি বালসারার জন্মশতবর্ষে ও সাহানা দেবীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে এবং রবীন্দ্রগানের সব স্বরলিপিকারকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে ও স্মরণ করে পাঠশালার এ আসরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয়।