আমার স্যার ডাকতে সমস্যা নেই

অবস্থান কর্মসূচিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক
ছবি: প্রথম আলো

স্যারের সাদাসিধে অর্থ জনাব। বিয়ে, হালখাতার নিমন্ত্রণপত্রে শুরুতেই স্যার বা জনাব বলে ছোট-বড় সবাইকে সম্বোধন করা হলেও এর ব্যাপক ব্যবহার হয় সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এটি চলে এসেছে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে, যা আমাদের সংস্কৃতিতে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে।

স্যার সম্বোধনের রীতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এতটা কড়াকড়ি নয়, যতটা আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। তার কারণও আছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়র মিলিয়ে পাঁচ-সাতজন আছেন, বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সব সময় ভাই হিসেবে সম্বোধন করে এসেছেন, তাঁদের এখানে নতুন করে আর স্যার বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেটির সুযোগ হয় না।

আরও পড়ুন

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সংস্কৃতির লোক একই অফিসে থাকেন। সেই সুযোগে এই অভ্যাস বেশ ভালোভাবে জেঁকে বসেছে। যেহেতু অফিসের পদাধিকার বলে সব সময় ছোটরা বড়দের স্যার বলে সম্বোধন করেন, তাই এ শব্দের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই একটা আভিজাত্য, অহমিকা ভাব ভর করে বসেছে বড়দের মধ্যে। এ আভিজাত্য বা অহমিকা দূরত্ব তৈরি করেছে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, সেটি দূরত্ব তৈরি করছে তাঁদের সহকর্মীদের মধ্যেও। দূরত্ব তৈরি করা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো মঙ্গলজনক নয়।

প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব কিছু রীতিনীতি থাকে, যেটা তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। যেমন পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা রীতি আছে, প্রফেসরদের নামের শেষের অংশের সঙ্গে শুরুতে ডক্টর বা প্রফেসর যোগ করে দিতে হয়। যেমন আমার প্রফেসরের নাম ইয়াংহো নি। তাই তাঁকে অনেকেই ডক্টর নি বা প্রফেসর নি বলেই ডাকে। আমাদের ল্যাবে এসবে তেমন কিছু মানি না। আমাদের অনেকেই শুধু নি বলি, আর আমি সরাসরি তাঁর নামের প্রথম অংশ ইয়াংহো বলে ডাকি।

তাতে কখনোই নামের সম্বোধন নিয়ে কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। অথচ তিনি কানাডার সামনের সারির কয়েকজন গবেষকের অন্যতম একজন, যাঁর পাবলিকেশনের সংখ্যা বছরে ৫০-৬০টি হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো ল্যাবে সম্বোধনের ক্ষেত্রে এটা মানতে হয়, নয়তো প্রফেসর নিজেকে অপমানিত বোধ করতে পারেন, কিন্তু সেখানে আভিজাত্য বা অহমিকার লেশমাত্র নেই।

আরও পড়ুন

যদি অপমানিত বোধ করেও থাকেন, তবে তিনি একটু হেসে, নরম সুরে, ভদ্রোচিতভাবে বলবেন, তুমি আমাকে অমুক নামে ডাকতে পারো বা ল্যাবের অন্য কেউ সেখানকার রীতি সম্পর্কে অবহিত করবেন।

কিন্তু এটা করতেই হবে বা বাধ্য করা হবে, এমন কোথাও নেই। আসলে নামে কি আসে যায়, কাজেই তো পরিচয়। রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীনকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক এবং এ নিয়ে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেছেন। ঘটনাটিতে জেলা প্রশাসকের দাম্ভিকতা, অহমিকার প্রতিফলন স্পষ্ট; কিন্তু যদি অধ্যাপক উমর ফারুকও দাম্ভিকতা বা অহমিকার কারণে স্যার না বলে থাকেন, তাহলে কেউ কারও থেকে ভালো নয়।

আর অধ্যাপক যদি প্রশাসকের দাম্ভিকতার প্রতিবাদ স্বরূপ স্যার না বলতে চান, তাহলে তিনি প্রশাসককে নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। দুটি আলোচিত ঘটনা, রংপুরের জেলা প্রশাসক ও বগুড়ার জজ। দুজনই আমাদের সমাজে উঁচু শ্রেণিতে বসবাস করেন। দুজনেই অহমিকার দোষে দুষ্ট। অহমিকার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এটি আমাদের মধ্যে চলে আসে আমাদের পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক লোকজন থেকে।

তাই এ দুটি ঘটনা শুধু দুটি ঘটনা নয়, আমাদের সমাজের, কর্মক্ষেত্রের হিমশৈলের অগ্রভাগের মতো। অহমিকা সামাজিক ও পারিবারিক জীবন, এমনকি ব্যক্তিজীবনও বিষাদময় করে তুলতে পারে। শব্দের সংযোজন বা বিয়োজনে তেমন কিছু যায় আসে না। যেমনটি আমাদের স্যার, বাইরের ডক্টর, প্রফেসর বা শুধু নাম ধরে ডাকার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।

ভেতরে ক্যানসার থেকে গেলে বাইরে চিকিৎসা করে যেমন লাভ হয় না, তেমনি স্যার বলা না বলাতে তেমন কাজে আসবে না। ক্যানসার সরাতে হলে দরকার সেই ক্যানসার কোষকে সরানো। তেমনই নাম নয়, দরকার নামের ভেতরে যে দাম্ভিকতা, অহমিকা লুকিয়ে আছে, তা সরানো।

স্যার একটা সম্বোধনের ভাষা, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এর মানে প্রভু নয়। আমি যদি বাইরে সংস্কৃতিতে প্রফেসর, ডক্টর ডাকতে পারি, তবে দেশের সংস্কৃতিতে স্যার ডাকতেও আমার সমস্যা নেই।

লেখক: নূর আলম, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রানসউইক, কানাডা