আমার দেখা রাশিয়ার ৮০তম বিজয় দিবস: ভ্লাদিভস্তক থেকে রেড স্কয়ার দেখা

১০ মে ছিল রাশিয়ার বিজয় দিবস। রাশিয়ার ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব ঠিক যতটা ঐতিহাসিক, ততটাই আবেগময় ও রাজনৈতিক। এ বছর দিনটির ৮০তম বার্ষিকী। রাশিয়াজুড়ে দিবসটি পালিত হয়েছে এক অসাধারণ বিশালতা ও তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে। আমি এই দিনটি কাটিয়েছি ভ্লাদিভস্তকে। তবে চোখ রেখেছিলাম মস্কোর রেড স্কয়ারের দিকেও, যেখানে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক অভূতপূর্ব কূটনৈতিক ও সামরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বকে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছিলেন।

বিজয় দিবসের সকালটা শুরু হয়েছিল সুরম্য ভ্লাদিভস্তক শহরের কেন্দ্রীয় স্কয়ারে। ভ্লাদিভস্তক—প্রশান্ত মহাসাগরঘেঁষা এই শহর একদিকে যেমন সমুদ্রের সৌন্দর্য বহন করে, তেমনি সামরিক ইতিহাসের গর্বে উদ্ভাসিত। রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হলেও, বিজয় দিবস এখানে ঠিক ততটাই গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপিত হয়, যতটা মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গে। এদিন প্রথম সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এখানেই। সামনের সারিতে ছিল ঐতিহাসিক টি-৩৪ ট্যাংক, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত সামরিক শক্তির প্রতীক ছিল। এরপর একে একে হাজির হলো আধুনিক অস্ত্র, মিসাইল সিস্টেম এবং জিটি-১৩ ও জিটি-১৪ অ্যান্টেনা মাস্টসহ মুরমানস্ক-বিএন ইলেকট্রনিক যুদ্ধব্যবস্থা। শুধু সামরিক মিছিল নয়, সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। বয়োজ্যেষ্ঠরা ‘অমর রেজিমেন্ট’ মিছিল করে হাতে তাঁদের পরিবারের যুদ্ধাহতদের ছবি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন—এক দৃষ্টিনন্দন ও আবেগময় দৃশ্য।
যখন ভ্লাদিভস্তকে দিনের কুচকাওয়াজ শেষের দিকে, তখন মস্কোতে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় মূল কুচকাওয়াজ। আমি একটি স্থানীয় ক্যাফেতে বসে বড় পর্দায় লাইভ সম্প্রচার দেখতে থাকি।

রেড স্কয়ার—ইতিহাসের গর্ব, রাজনীতির কেন্দ্রে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাঁড়িয়ে আছেন চীনা নেতা সি চিন পিংয়ের পাশে। একে একে অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের নানা দেশের রাষ্ট্রনেতারা—ব্রাজিল, মিসর, সার্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ফিলিস্তিন ও এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী। এ যেন এক অনন্য কূটনৈতিক বার্তা। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া যে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে—এই ধারণার বিপরীতে একটি জবাব যেন রেড স্কয়ারের এই মহাশোভা।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

১০ মে রাশিয়ার জন্য শুধু একটি তারিখ নয়—এটি রাশিয়ান জাতিসত্তার অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২.৭ কোটি সোভিয়েত নাগরিকের প্রাণ বিসর্জনের স্মরণে এই দিন পালিত হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি একধরনের রাজনৈতিক বার্তার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। পুতিন এবারও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ন্যায্যতা হিসেবে ইতিহাসের পুনঃব্যাখ্যা করেন। তাঁর ভাষণে বারবার উঠে আসে মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসেবে তা রক্ষার কথা। অনেকেই এই তুলনাকে সমর্থন করেন না, কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এটি এক শক্তিশালী আবেগঘন বয়ান।

গত দুই বছরের তুলনায় এবার রাশিয়ার সামরিক কুচকাওয়াজ ছিল অনেক বেশি দৃঢ় ও গোছানো। ১১ হাজার ৫০০ সৈন্যের অংশগ্রহণ, আধুনিক এবং ঐতিহাসিক ট্যাংকের মিশ্রণ, সামরিক ড্রোনের প্রদর্শন এবং রেড স্কয়ারের ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমানের ওড়াউড়ি—সব মিলিয়ে এটি এক পরিপূর্ণ সামরিক প্রদর্শন ছিল। বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে শাহেদ ধরনের রাশিয়ান ড্রোন ‘জেরানিয়াম-২’ ইউক্রেন যুদ্ধের পর যার ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এ ধরনের অস্ত্রের প্রকাশ্য প্রদর্শন রাশিয়ার ভবিষ্যৎ যুদ্ধ কৌশলের দিক নির্দেশ করে।

এই বিজয় দিবস শুধু একটি সামরিক প্রদর্শন নয়, বরং ইতিহাস, রাজনীতি ও জনমতের একজোট প্রকাশ। ভ্লাদিভস্তকের রাস্তায় যুদ্ধপ্রবীণদের হাতে থাকা ছবি যেমন মন ছুঁয়ে যায়, তেমনি রেড স্কয়ারের কৌশলগত বার্তাও ভাবায়। যদিও অনেকেই রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন, কিন্তু একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে বলতেই হয়, রাশিয়া ইতিহাসকে ব্যবহার করে তার বর্তমানকে গড়ে নিচ্ছে এবং বিজয় দিবস সেই কৌশলের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হয়ে উঠেছে।

৮০তম বিজয় দিবস ছিল একটি মুহূর্ত, যেখানে ইতিহাস, আধুনিকতা, সামরিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একসঙ্গে মিশে গিয়েছে। ভ্লাদিভস্তকের শান্ত দৃশ্য থেকে রেড স্কয়ারের গর্জন—সবকিছুই যেন একটি বৃহৎ বার্তা বহন করছিল: রাশিয়া এখনো তার অতীতকে আঁকড়ে ধরে ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে।