বালারাতের ঈদ ও নববর্ষের আনন্দ
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষার রাজ্য হিসেবে পরিচিত ভিক্টোরিয়ার রাজধানী বিখ্যাত মেলবোর্ন শহর থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে আমাদের বালারাত শহর। ছিমছাম ও ছবির মতো সুন্দর এ আঞ্চলিক শহরে বর্তমানে প্রায় ৫০টির মতো বাংলাদেশি পরিবার, আর সঙ্গে আছে এই শহরে অবস্থিত ফেডারেশন ইউনিভার্সিটির প্রায় ২০ জন বাংলাদেশি ছাত্র। ধর্মীয় বা বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে আমরা একত্র হয়ে যাই, আর হাসি-আনন্দে কাটিয়ে দিই বেশ কিছুটা সময়।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় আসিফ আনোয়ার ভাইয়ের ডাকে ঈদ ও বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে রোজা শুরুর আগেই আমরা একত্র হলাম। উদ্দেশ্য, কীভাবে ঈদ ও নববর্ষকে রাঙানো যায়। তিনটি কার্যকর কমিটির মাধ্যমে শুরু হয়ে গেল উৎসবের প্রস্তুতি, আর তার মূল আকর্ষণ ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন জমকালো আইটেমের রিহার্সাল। আর সেগুলো চমৎকার ও দক্ষভাবে সামলিয়েছেন তানজিলা ভাবি, মুনিরা ভাবি, প্রমিসহ আমাদের সাংস্কৃতিক কমিটির অন্যান্য সদস্যরা আর সহযোগিতা করেছেন রিহার্সালে অংশগ্রহণ করা বাচ্চাদের মায়েরা।
ওদিকে খাবার ব্যবস্থাপনা কমিটি সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে কোন কোন খাবার পরিবেশন করা যায়, যেখানে থাকবে ঈদ ও বৈশাখ—এই দুটিরই আমেজ। অন্যদিকে অনুষ্ঠানস্থল ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ শুরু করে দেয় কীভাবে মঞ্চ সাজানো যায় আর কীভাবে অনুষ্ঠানস্থলকে আরও আকর্ষণীয় করা যায়। অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে আয়োজনের জন্য সবার কাছ থেকে কিছু চাঁদা ওঠানো হয়; আর ব্যবস্থা করা হয় চারটি পৃষ্ঠপোষক ও স্পন্সর।
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় রোজা। ঈদের আগের রাতে ইফতারের পর দল বেঁধে আমরা চলে গেলাম অনুষ্ঠানস্থলে। হাতে হাত রেখে কাজ করে সাজিয়ে ফেললাম মঞ্চ। মঞ্চ আর অনুষ্ঠানস্থল সাজানোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আমাদের নাভেদ ভাই, আর সাথে ছিল একদল তরুণ, যারা কিছুদিন আগে বালারাতে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়ালেখা করতে। নাভেদ ভাইয়ের সঙ্গে সাউন্ড ও মাল্টিমিডিয়া পরিচালনায় সহযোগিতা করেন এজাজ ভাই। এলো ঈদের দিন, ২২ এপ্রিল, শনিবার। সকালের ঈদের নামাজ আর কয়েকটি বাসায় টুকটাক ঘোরাফেরার পর বিকেল তিনটার দিকে দলে দলে সবাই আসতে শুরু করল অনুষ্ঠানস্থলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আমন্ত্রিত অতিথিরা চলে আসেন। অনুষ্ঠানস্থলের ঠিক বাইরে একটি টেবিলে সারি সারি করে সাজানো হয় পৃষ্ঠপোষকদের বিভিন্ন লিফলেট ও পোস্টার। শুরুতে ছিল সবার জন্য ঝাল চটপটি, শিঙাড়া, স্প্রিং রোল, দুধ সেমাই, চা ও কফি।
বিকেল সোয়া চারটার দিকে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। দুই ভাই আফিফ আর আফফানের কোরআন তেলাওয়াত ও তরজমার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা। নিজের ও অন্যান্য বাংলাদেশির তোলা বিভিন্ন ছবি দিয়ে শুভর তৈরি দুটি মাল্টিমিডিয়ায় প্রদর্শন করা হয় বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত। উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে সন্মান জানান এই দুই দেশের জাতীয় সংগীতের প্রতি। তার পরপরই মঞ্চের দায়িত্ব নেয় নওশি। আসিফ ভাই ও সোফিয়া আপার বড় মেয়ে, মোনাশ ইউনিভার্সিটির অনার্সের ছাত্রী নওশি এবারই প্রথমবারের মতো এত বড় একটি আয়োজনের উপস্থাপনার দায়িত্ব নিল। পরিষ্কার বাংলা ও সাবলীল ভঙ্গিমায় অনুষ্ঠান পরিচালনা দেখে মনেই হচ্ছিল না সে এটা প্রথমবারের মতো করছে।
যেহেতু এটা ঈদ ও বৈশাখের অনুষ্ঠান, তাই শুরুতেই ছোট-বড় একদল শিল্পী পরিবেশন করেন ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ আর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ মন ভরিয়ে দেওয়া গান দুটি পরিবেশনার পর আদীপ্তা আসে একটি মাল্টিমিডিয়া পরিবেশনা নিয়ে। যেখান ছবিতে-ছবিতে সে ঈদ ও বৈশাখের ইতিহাস উপস্থাপন করে। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে রঙিন পর্ব ছিল তার পরপরই, ‘যেমন খুশি তেমন সাজো।’ কেউ সেজে এসেছিল বাংলার বউ, আবার কেউ এসেছিল চাকমা মেয়ে, সাকিব আল হাসান, বেলুনওয়ালা, ফুলওয়ালা, আইয়ুব বাচ্চু, স্মার্ট তরুণ হয়ে। আর তখন অনুষ্ঠানস্থলে বাজছিল কুমার বিশ্বজিতের বিখ্যাত গান ‘তোমরা একতারা বাজাইয়ো না।’
তার পরপরই ছোট ছোট বাচ্চা কোরাসে গেয়ে শোনাল ‘আমরা করব জয়’। চমৎকার এ পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করে মিহিরান, আদিয়ান, আয়ান তরফদার, ফারজাদ শাদিদ আয়ান, মুস্তাইন, আজমিনা, আরিশা, ইয়ারা, আল্ভিনা ও নীনা। অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ছিল তার পরপরই। তিনটি ছোট্ট পরী ইয়ানা, জান্নাত ও আদ্রিতা পরিবেশন করল ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গানটির সাথে মনমুগ্ধকর নাচ। উপস্থিত সবাই খুবই উপভোগ করে আমাদের তিন পরীর নাচ, বিশেষ করে আমাদের আমন্ত্রিত অতিথিরা, যারা করতালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর মঞ্চে এসে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ গানটি চমৎকারভাবে পরিবেশন করল নীনা।
অত্যন্ত সাবলীলভাবে সুকুমার রয়ের ‘সৎপাত্র’ কবিতাটি আবৃতি করল ইয়ারা। খালি গলায় সবাইকে একটি গান শোনাল ফারজাদ শাদিদ আয়ান। ‘চাঁদের পালকি চড়ে’ গানটি শুনে সবারই মনে পড়ে গেল আমাদের শৈশবের ঈদের আগের সন্ধ্যার কথা, যখন চাঁদ দেখতে পাওয়ার পর বিটিভিতে বেজে উঠত সৈয়দ আবদুল হাদির সেই বিখ্যাত গানটি। ছোটদের পর্বের সব শেষ পরিবেশনা ছিল নাওয়ারের। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় গিটার বাজানো দারুণভাবে রপ্ত করা নাওয়ার একে একে বাজিয়ে শোনাল তিনটি গানের কিছু অংশ।
অত্যন্ত সুচারুরূপে ছোটদের পর্ব পরিচালনা শেষে মঞ্চের দায়িত্ব আমার হাতে অর্পণ করে নওশি। ৪৫ বছরের অধিক সময় ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা, শ্রদ্ধেয় মাহমুদুল করিম আঙ্কেলকে সঙ্গে নিয়ে কবিতা ও সুরে পরিবেশন করলাম ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, আর মাল্টিমিডিয়ায় তখন ভেসে উঠছিল সন্তানদের সঙ্গে মায়েদের ছবি। তার পরপরই মঞ্চে আসে পাভেল-প্রমি জুটি, আর তারা পরিবেশন করে স্বপন গঙ্গোপাধ্যায় শ্রুতি নাট্য ‘পাকা দেখা’। চমৎকার বাচনভঙ্গি আর হাস্যরসে ভরপুর শ্রুতি নাট্যটি সবাই দারুন উপভোগ করেন।
বিদ্রোহী কবির ‘প্রিয় যাই যাই বোলো না’ গানটির সাথে চমৎকারভাবে নৃত্য পরিবেশন করলেন বৃষ্টি ভাবি। সংসার জীবনের খুনসুটি নিয়ে মজার নাটিকা পরিবেশন করলেন রোমান ভাই-ইমু আপু জুটি ও নাদিম ভাই-অনি ভাবি জুটি। যে সময় তারা নাটিকা দুটি তৈরি করছিলেন সেই সময় মাল্টিমিডিয়াতে সবাইকে দেখানো হলো সম্পূর্ণ বালারাতে চিত্রায়িত, বাপ্পা মজুমদারের বিখ্যাত গান ‘পরী’র ওপর নির্মিত একটি মিউজিক ভিডিও, যাতে মডেল হিসেবে ছিলেন নিপু-সুমি জুটি।
বৃষ্টি ভাবিকে গ্রামের বউ সাজিয়ে তাঁর চারদিকে ঘিরে রেখে কয়েকটি বিখ্যাত ফোক গান শোনালেন মুনিরা ভাবি, তানজিলা ভাবি, এনি ভাবি, তৃষিতা ভাবি ও প্রমি, আর অনেকটাই গ্রামের বিয়ের আবহ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুললেন তাদের পরিবেশনায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ চমৎকারভাবে পরিবেশন করলেন তৃষিতা ভাবি। মাত্রই বালারাতে আসা ছোট ভাই রওনাক দেখাল তার নাচের ক্যারিশমা। ‘বাংলাদেশের মেয়ে’ গানটির সঙ্গে যখন সে নাচছিল, সব দর্শক তখন জায়গা থেকে হাত নেড়ে, করতালির মাধ্যমে তারাও এককথায় মিশে গিয়েছিলো তার নাচের সাথে।
কিছুক্ষণের খাবার বিরতি। রাতের খাবারে সবাইকে পরিবেশন করা হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি, রোস্ট আর জালি কাবাব। খাবার সরবরাহ করা হয় মেলবোর্নের বিখ্যাত ‘মধুমতি’ রেস্তোরাঁ থেকে। সঙ্গে ছিল ভাবিদের তৈরি মুখরোচক সাত-আট পদের ভর্তা। মূল খাবারের পর ছিল বাংলাদেশিদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। যেমন রসগোল্লা, ছানার সন্দেশ, দই ইত্যাদি। খাবার ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন তানজিলা ভাবি, শুভ ও খাবার ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যান্য সদস্য। খাবারের বিরতির পর আবারও শুরু হয় আমাদের অনুষ্ঠান।
স্বামী-স্ত্রীর জানা-অজানা, পছন্দ-অপছন্দের কথা নিয়ে একটি ‘দ্রুত প্রশ্ন-উত্তর’ পর্বে অংশগ্রহণ করেন সাদ ভাই-লোবা আপু জুটি ও ওয়াসেক ভাই-তাজিন ভাবি জুটি। দুই জুটি একজন আরেকজনের থেকে ভালো করেছেন, আর তাঁদের প্রস্তুতির সময় মাউথ অর্গানে ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’র সুর মূর্ছনায় মোহিত করে রাখে আরিফ। তাহসান–ভক্ত শামিম রশিদ ভাই আমাদের শুনিয়ে যান তাহসানের বিখ্যাত ‘তুমি ছুঁয়ে দিলে এই মন’ গানটি, দারুন ছিল তার পরিবেশনা।
মূকাভিনয়ের মাধ্যমে কতটা দক্ষতার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে কীভাবে মনের কথা বোঝাতে পারেন, তারই প্রতিযোগিতায় নিজেদের পারদর্শিতা প্রদর্শন করে রাজ-সুমি জুটি ও এজাজ-নুসরাত জুটি। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী মিজান ভাই অত্যন্ত সুন্দরভাবে গেয়ে শোনান জলের গানের ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’ গানটি। বালারাতের বাঙালি কবি নিপুর লেখা কবিতা চমৎকার আবৃতি করে শোনাল সাহবাজ সিয়াম। আর সবশেষে পরিবেশনায় ছিল মিজান ভাই ও শাজাহান ভাইয়ের কণ্ঠে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গান।
আসিফ ভাই এবার মঞ্চে এসে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং আগামীর কিছু দিকনির্দেশনা দেন। তার পরপরই তিনি র্যাফেল ড্রয়ের জন্য না দেখে একটি একটি করে নাম তুলছিলেন আর আমন্ত্রিত অতিথিদের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছিলেন বিজয়ীরা। সবশেষে বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে চমৎকার কিছু কথা বললেন আমাদের আমন্ত্রিত অতিথি অধ্যাপক সুন্দ্রাম সিভামালাই, যিনি ‘Emotional Well-being Institute, Geneva’র প্রেসিডেন্ট ও ‘Ethnic Community Council of Vic’-এর বোর্ড ডিরেক্টর। পুরো অনুষ্ঠানের মিউজিকের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রমী, আর অনুষ্ঠান চলাকালে মাল্টিমিডিয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছে তিন ছোট ভাই কামরুল, রায়হান ও রিফাত। মঞ্চের পেছনে সবকিছু সমন্বয় করছিল পাভেল, এজাজ ভাই, নাভেদ ভাই, প্রমী, বৃষ্টি ভাবি আর তাদের সঙ্গে ছিল সেই তরুণ বাহিনী।
দেশ থেকে হাজারো মাইল দূরে থাকা এটাই আমাদের ঈদ ও বৈশাখ আনন্দ। আমাদের এখানে দল বেঁধে ঈদগাহে যাওয়া হয় না, হয় না রমনা বটমূলে সবার সাথে গান শোনা। সব বাঙালি একসঙ্গে হয়ে কিছুক্ষণ হাসি আনন্দে কাটিয়ে দেওয়াই আমাদের ঈদ, আমাদের বৈশাখ।
*লেখক: এহসান রাজা চৌধুরী ফারহান, বালারাত, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া