আমাদের ঈদ সালামি ৫ টাকা থেকে শুরু হতো
ঈদের নামাজ পড়ে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়ার পর বাসার খাটে বসে আব্বা পান খেতেন। পাশে আম্মা বসা থাকতেন আর আমরা চার ভাই কেউ খাটে, কেউ পড়ার টেবিলে। ছোট ভাই বেশি ছোট হওয়ার কারণে আব্বার পাশেই থাকত। তখন একে একে নাম ধরে ডেকে ঈদ সালামি দিতেন আব্বা। বড় ভাই পেত পাঁচ টাকার কচকচে নোট। তারপর মেজো ভাই পেত চার টাকা। আমি সেজো পেতাম তিন টাকা আর ছোট ভাই পেত দোয়েল পাখিওয়ালা দুই টাকার কচকচে নোট, তার পছন্দের ছোট্ট টাকা।
পাঁচ থেকে দুই টাকা ঈদ সালামি আমাদের দেওয়ার সময়টা ছোট বয়সে একেবারে বিশেষ সময় মনে হতো। আর মধুর সময় সালামি বণ্টনের ক্ষণটা। কিন্তু সময়ে সঙ্গে সঙ্গে আব্বা ৭ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল সালামি। কিন্তু সমস্যা হলো, পারিপার্শ্বিকতা আশপাশের সমবয়সীরা তখনো ২০, ৫ ও, ১০০ টাকা অহরহ ঈদ সালামি পেত। আমরা যখন বড় হতে থাকলাম দেখলাম, চাহিদা বাড়ছে। সে তুলনায় আব্বার ঈদ সালামি বাড়ছিল না। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে আনন্দঘন মুহূর্ত ঈদ সালামি বণ্টন সময়টা আকর্ষণ হারাল। একসময় ঈদ সালামি বণ্টন সময়টুকু বিরক্তিকর ও বিষাদময় হয়ে উঠল। কারণ, আমরা যতটুকু বড় হচ্ছিলাম, বন্ধুর সংখ্যা ও খরচ বাড়ছিল, সে তুলনায় ঈদ সালামি বাড়ছিল না। সেদিক থেকে পরবর্তী সময়ে জানাশোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের নামাজ শেষে খাওয়াদাওয়ার পর প্রতিবেশী ও বন্ধুদের বাড়িতে ঈদের সালাম বিনিময়ে প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল। এতে আব্বা আর ঈদ সালামি দেওয়ার জন্য সব সন্তানকে পেতেন না। এভাবে আব্বার আয়োজন করে ঈদ সালামি দেওয়ার রীতি কয়েক বছর পর বিলুপ্ত হয়ে গেল।
যেহেতু আব্বা রেলওয়েতে চাকরি করতেন, সরকারি চাকরি করার কারণে সব সময় বেতন ও বোনাসে নতুন টাকা আনতেন। নতুন নোট বা একেবারে নতুন কোনো নোট বা কয়েন বের হলে সেটা অনেকের আগে আমরা পেতাম। এই নিয়ে সমবয়সী বা স্কুলবন্ধুদের মধ্যে নতুন টাকা নিয়ে আগ্রহ দেখা যেত। অনেকে সবার আগে নতুন নোট বা কয়েন দেখতে পেরে অবাক হতো।
ঈদ সালামি ছাড়া স্কুলে পরীক্ষার ফি, খাতা-কলম ও নিয়মিত দুই টাকা পেতাম, এর বাইরে ছোট অবস্থায় আব্বার পাঞ্জাবির সাইড পকেটের পয়সাগুলো মাঝেমধ্যে নিতে পারতাম। একটা সময় কয়েনের বাজারিক দাম ছিল। পাঁচ টাকা দিয়ে নাশতা করা যেত। এক কাপ চা, দুটি নান রুটি খাওয়ার পর এক টাকা ফেরত আসত। টাকার যেহেতু এত বাজারকদর, তাই আব্বাও তাঁর সাদা পাঞ্জাবির সাইড পকেটের কয়েন নিয়ে সচেতন থাকতেন।
এখন এসে ঈদের দিন আমরা আর আগের মতো এক টেবিলে খেতে পারিনি। চার ভাইয়ের কেউ না কেউ বাইরে থাকছে। আব্বারও সরকারি চাকরি নেই, তিনি রিটায়ার্ড করেছেন। আমাদের সন্তানেরা ঈদে গাঁয়ে যাচ্ছে, তারা দাদা-দাদির কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে বোনাস পাচ্ছে। এসবের মধ্যে আমাদের ঈদ সালামি পাঁচ টাকা থেকে শুরু হতো, সে ক্ষণটাও মনে পড়ছে।