জ্যাম বাবা

যানজট
ফাইল ছবি

অতি সম্প্রতি আমি ‘নাগরিক জীবনে জ্যাম ও জীবন’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেছি। আগামী বইমেলায় নাকি সেটার বাম্পার ফলন (বিক্রি) হবে। এ ব্যাপারে গত সপ্তাহে ঢাকা হাইকোর্টের সামনে দেড় ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকাবস্থায় আধ্যাত্মিক এক ভিক্ষুক বাবার সঙ্গে কথা হয়। বাম্পার বই বিক্রির ভবিষ্যদ্বাণী সেই ভিক্ষুক বাবার। সে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এভাবে, ‘তোর বই কিন্তু বাংলা একাডেমি খাইব না, হয়তো বাতিল কইরা দিব। আর এই না খাওয়াই হইব তোর কপাল। কিন্তু মানুষ খাইব খাবলাইয়া। তাড়াতাড়ি বাইর কর, দেরি করিস না।’

এই আশার বাণী শুনে আমি আধ্যাত্মিক বাবাকে চকচকে দুই শ টাকার নোট দিয়ে দোয়া চাই। বাবা আরও তিন শ টাকার বিনিময়ে প্রাণ খুলে দোয়া দিছে। পরবর্তী সময়ে বাবার সঙ্গে বই নিয়ে আরও তিনটা ট্রাফিক জ্যামে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা বিস্তর কথা হয়। দ্বিতীয়টা ছিল শিল্পকলা একাডেমির সামনে পাক্কা দুই ঘণ্টা। তৃতীয়টা ছিল উত্তরা রোডে আড়াই ঘণ্টা। বাবাকে আমি এখন ‘জ্যাম বাবা’ বলেই ডাকি। যেখানেই জ্যাম, সেখানেই বাবার দেখা পাই।


গতবার ঢাকার গুলশান ১ নম্বরের জ্যামে এ রকম এক আধ্যাত্মিক বেদেনির দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল ভুয়া। আমি ছিলাম সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। বেদেনি হাতে ছোট একটা সাপ নিয়ে আমাকে অনবরত আশীর্বাদ দিতে থাকে। আমাকে বলে, ‘সাপের উছিলায় তোর মঙ্গল হইব। খুশি হইয়া ওরে কিছু দে।’
আমি তাকে বলেছিলাম, দেখো জ্যোৎস্না, তোমারে আমি চিনি না, জানি না, পূর্বপরিচয়ও নেই। আমারে কেন ‘তুই’ কইরা সম্বোধন করলা। পোশাক–আশাকেও তো আমি দেখতে গরিব না।

তা ছাড়া তোমার সাপটা খুবই কিউট, আমার পছন্দ হইছে।

বাসায় ঈগল পালি। তুমি চাইলে সাপটাকে ঈগলের জন্য কিনে নিয়ে যেতে পারি।
জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে অন্যত্র পা বাড়াল।

বইয়ের প্রসঙ্গ ও সফলতা নিয়ে জ্যাম বাবা আমাকে মোটামুটি যে ধারণাগুলো দিল, তা হচ্ছে ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে শহরবাসীর মনে যে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার জন্ম নিয়েছে, তা একেবারেই ঠিক নয়। এই মনমানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং সে জন্যই এর সুফল নিয়ে লিখতে হবে। সে বলে, ‘মানবজীবনে ঘৃণা কোনো কিছুরই সুফল বয়ে নিয়ে আসে না।’

‘যেই ঘৃণা তোরা পোষণ করিস, সেই ঘৃণাই একদিন তোদের ভক্ষণ করিবে।’
বাবার ভাষায়, ‘আমারেই দ্যাখ, জ্যাম না থাকলে তুই কি আমার সাক্ষাৎ পাইতি। আর তুইও তো বই লেখার জোগান পাইতি না।’

যা–ই হোক, বাবার আদেশানুযায়ী আমি এখন বইয়ের রসদ জোগাড় করতে ব্যস্ত। বইটিতে ট্রাফিক জ্যামের বিভিন্ন সুফল এবং শহরবাসীর প্রতি কিছু নির্দেশনা থাকবে। এই নির্দেশনাবলি এক নবযুগ বা সম্ভাবনার সুবর্ণ সুযোগ।

বাবার পরামর্শ অনুযায়ী বইটির ভিন্ন ভিন্ন চ্যাপ্টারে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হবে। যেমন ‘ট্রাফিক জ্যামে উৎফুল্ল থাকিবার উপায়’ নিয়ে একটি চ্যাপ্টার থাকবে। আরেক জায়গায় থাকবে ‘জ্যাম তৈরি হইবার পূর্বলক্ষণ’ নামে একটি বিষয়। এখানে থাকবে উপ, সহ, অতিরিক্ত, যুগ্ম, পাতি বা কোনো বিশেষ ব্যক্তির পতি—ইত্যাদি টাইটেলওয়ালা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চলাফেরার স্থান, যেখান থেকে জ্যাম তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ সেই সব স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র স্থানান্তরিত হবে। অথবা রাস্তায় নামার আগে শহরবাসী জানতে পারবে, কোন কোন রাস্তায় তাদের হাঁটবার অধিকার নেই বা সীমিত।

একটি চ্যাপ্টার থাকবে ‘জ্যামের ঝগড়া ও হারিয়ে যাওয়া দেশজ গালি’। এই চ্যাপ্টারটা হবে সবচাইতে ইন্টারেস্টিং। গালি হচ্ছে ভাষারই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা যে ভাষারই হোক। এখানে বর্ণিত হবে ঢাকার জ্যামে আটকা পড়া শহরবাসীর দেশি-বিদেশি গালি। কোন কোন বাহনের চালকেরা কোন কোন ধরনের গালি বেশি ব্যবহার করে। এই যেমন মিনিবাসের ড্রাইভার টেম্পুচালকদের কী ধরনের গালি দিতে পারে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। আবার ম্যানুয়াল রিকশাওয়ালারা পা–ছাড়া (ব্যাটারিচালিত) রিকশাওয়ালাদের কোন ধরনের গালি দেয় বা দেওয়া উচিত। এই চ্যাপ্টারে থাকবে নিরীহ পথচারী ও ফেরিওয়ালাদের বহুল ব্যবহৃত গালি। আরও থাকবে নিম্ন, মধ্য, উচ্চবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বহুল প্রচলিত গালি। বোনাস হিসেবে থাকবে আঞ্চলিক বা হারিয়ে যাওয়া গালির আধুনিক রূপান্তর।

‘কীভাবে একটি ঝগড়ার উৎপত্তি হয় এবং জিতে আসার উপায়’ অংশে থাকবে গ্রাম থেকে আসা দুই রিকশাচালক ও যাত্রীর চাঞ্চল্যকর জবানবন্দি। রিকশার চাকা লেগে গেলে গালি শুরুর আগে তারা কীভাবে একে অপরের প্রতি আট সেকেন্ড সরাসরি আইকন্ট্রাক্ট করে। এই আট সেকেন্ড একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। দুই রিকশাচালকের ঝগড়ায় কীভাবে তাদের যাত্রীরা নিজ নিজ চালকদের সমর্থন দিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর পেছনে আবদ্ধ থাকা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের ড্রাইভার। শেষমেশ ফুটপাতের হকার এবং কর্মবিহীন নিরীহ পথচারীদের নিয়ে বৃহত্তর ঝগড়ার কোয়ালিশন তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে সবচাইতে নিরীহ ভিকটিম হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। ২০ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে সেই বেচারার নিজের নাক পরিষ্কার করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

‘ঘৃণা নয় জ্যাম উপভোগ করুন’—এই চ্যাপ্টারের উপভোগ্য বিষয় হবে মনিটরে ইনস্ট্যান্ট নাচ, গান বা সিনেমা দেখার সৌভাগ্য। সাইনবোর্ডের মতো মনিটর নিয়ে কিছু বিনোদনকর্মী জ্যামে আটক পড়া মানুষদের কানে হেডফোন ঢুকিয়ে দিয়ে সিনেমা, নাচ, গান চালিয়ে দিবে।

‘ট্রাফিক জ্যামের ভবিষ্যৎ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ নামে চাপ্টারে থাকবে জ্যামকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি কীভাবে এগোতে পারে। এখনকার জ্যামে যেমন শুধু মুড়ি-চানাচুর, পানি, মুরগি, ভিক্ষাবৃত্তি, ইত্যাদি সার্ভিস আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে জ্যামে বসে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে পড়ানোর মতো ব্যবস্থাও হবে। থাকবে পোর্টেবল কাজী, টয়লেট, তৎক্ষণাৎ রান্নার আয়োজন, ডাক্তার, আই বা ডেন্টাল ক্লিনিকের মতো ব্যবস্থা। ট্রাফিকে আটকে পড়া ট্রাকের পেছনে জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজের আয়োজনও থাকবে।

জ্যামে বসে শিশুদের যাতে পড়ালেখার ক্ষতি না হয়, সে জন্য থাকবে জ্যাম প্রাইমারি স্কুল। প্রতিদিন শহরের রাস্তায় পোর্টেবল স্কুলবাস চলাচল করবে। বাচ্চা ও তাদের মা-বাবাদের সঙ্গে সেসব স্কুলবাসও জ্যামে আটকে থাকবে। মা–বাবা চাইলে তাদের সন্তানদের ওই একই জামে আটকা পড়া স্কুলবাসে উঠিয়ে দিতে পারবে। নিয়মিত ক্লাস হবে সেই বাসে। জ্যাম শেষ হওয়ার আগেই দু–একটা ক্লাস করে রিকশা বা গাড়িতে ফেরত আসবে শিশুরা। থাকবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য জ্যাম–কেয়ার সেন্টার (শীতাতপনিয়ন্ত্রিত), মহিলাদের মেকআপ ও চুল কাটার স্যালুন, ম্যাসাজ সেন্টার।

জ্যামে প্রায়ই দেখা যায়, দুই বা তিন পক্ষ মৌখিক গালিগালাজ বা কোপাকুপিতে মেতে ওঠে। সে জন্য রাস্তায়ই থাকবে পোর্টেবল বিচারক ও জেলখানা। একেক ট্রাফিক জ্যাম এলাকায় একেকজন দায়রা জজ কাজ ভাগাভাগি করে নেবেন। এখন যেভাবে করা হয়।

বই লেখার কাজ এগিয়ে চলেছে খুবই দ্রুত।
ভাবছি বইটি উৎসর্গ করব জ্যাম বাবার নামে।

উৎসর্গকৃত পংক্তিটি হবে এই রকম:
শ্রদ্ধেয় জ্যাম বাবাকে
যে আটকে পড়া জীবনকে
সচল করে দিল অপার সম্ভাবনায়।