জাপানে বহু সংস্কৃতির মিলনমেলা ও অবিস্মরণীয় মুহূর্ত
কানাজাওয়া ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যাল একটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাবলীল সংমিশ্রণ, যা এক যুগের বেশি সময় ধরে উদ্যাপন করা হচ্ছে। এ ফেস্টিভ্যাল এ বছরের ২১ ও ২২ অক্টোবর কানাজাওয়া সিটি হলের সামনের খোলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব বৈচিত্র্যের একটি প্রাণবন্ত উদ্যাপনের আয়োজনে আমি ২০০৯ সাল থেকে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছি। মাঝখানে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আয়োজন স্থগিত ছিল, ২০২২ সাল থেকে আবার এ উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে।
আমাদের বাংলাদেশি সংগঠন Ishikawa-Bangladesh Friendship Association–এর পক্ষ থেকে প্রতিবছর স্টল বরাদ্দ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তৈরি করে আসছি, যেখানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রদর্শন ও বিক্রয় করে থাকি। কানাজাওয়া ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের সেতুবন্ধ স্থাপনের মতো কাজগুলো করার মাধ্যমে পুরো আয়োজনে আমরা নিজেদের সক্রিয় রাখি।
কানাজাওয়া ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যালের মূল চত্বরের প্রবেশপথে ছিল আমাদের এবারের স্টল। স্টলের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশি খাবার বিক্রি আমাদের উদ্দেশ্য নয়, জাপানি ও অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের কাছে আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া ছিল আমাদের অন্যতম ও মূল লক্ষ্য। আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির প্রতি দর্শকদের মুগ্ধতা এবং কৌতূহল দেখে বাংলাদেশি হিসেবে অনেক গর্ব হয়। নানা রকম নিয়মের বেড়াজালে আটকানো এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্টল বরাদ্দ নেওয়ার সার্থকতা এখানেই।
এবারের ফেস্টিভ্যাল একটি বহু সংস্কৃতির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। প্রথম দিন বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাসের কারণে দর্শকদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকলেও দ্বিতীয় দিনের আবহাওয়া ভালো থাকায় দর্শকদের ব্যাপক সমাগম ঘটে। রৌদ্রোজ্জ্বল দ্বিতীয় দিনে আমাদের স্টলটি বিভিন্ন দেশের রসনাবিলাসীদের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন কথোপকথনের মাধ্যমে আমি যখন আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তাৎপর্য, প্রস্তুত প্রণালি এবং প্রতিটি খাবারের পেছনে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করি, তখন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির ব্যবধান দূর করার যে প্রয়াস এক যুগ আগে জাপানে এসে নিয়েছিলাম, তার কিছুটা হলেও যে করতে পেরেছি, তা উপস্থিত দর্শকদের বোঝাপড়া ও উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারি। দর্শকদের সঙ্গে আলাপচারিতা এবং খাবার বিতরণে এত ব্যস্ত ছিলাম যে ছবি তোলার সময় পাইনি।
কানাজাওয়া ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যালে সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী দিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলন। রঙিন স্টলের চারপাশে জমজমাট আড্ডা আর আলাপচারিতার মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে এমন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাদের আমি কয়েক বছরের মধ্যে দেখিনি। তাদের সঙ্গে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন আর দীর্ঘ বিরতিতে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় আমরা অতীতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যারা ইতিমধ্যে নিজেদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুসংহত করতে পেরেছে।
রঙ-বেরঙের পোস্টার আর ব্যানার, খাবারের নানা রকম সুগন্ধ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা তরুণ-তরুণীদের উচ্ছল হাসির ঝরনাধারায় ভরে উঠেছিল এ বর্ণিল উৎসব। আমাদের বুথের অদূরে ছিল সর্বজনীন স্টেজ, যেখানে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সবাই নিজেদের সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এমন প্রতিযোগিতামূলক ভিড়ের মধ্যেও আমাদের বুথে দর্শকদের সবান্ধব উপস্থিতি আর নতুন বন্ধুত্বের উষ্ণতা উৎসবকে অত্যন্ত উপভোগ্য করে তুলেছিল।
কানাজাওয়া ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যাল শুধু একটি অনুষ্ঠান ছিল না; এটি একটি রূপান্তরমূলক যাত্রা ছিল। আমাদের বুথের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার, এর রন্ধনসম্পর্কীয় তথ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার এবং সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া উৎসাহিত করার সুযোগ পেয়েছি। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আবার মিলিত হওয়া এবং নতুন বন্ধু তৈরি করা ২০২৩ সালের এই উৎসবে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। হাসি, গল্প আর ভাগাভাগি করে খাবার খাওয়া—এসব অভিজ্ঞতা উত্সবের আসল সারমর্ম তুলে ধরেছিল। মানব সংযোগের উদ্যাপন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং একটি বিশ্ব পরিবার হিসেবে বিশ্বকে আলিঙ্গন করার ফলে যে আনন্দ আসে তা ব্যক্তিগত নয়, সামষ্টিক। করোনা–পরবর্তী এমন নির্মল ও সামষ্টিক আনন্দ সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।
*লেখা: ডক্টর তৌফিক আহমেদ, প্রেসিডেন্ট, ইশিকাওয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, কানাজাওয়া, জাপান