মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৫
মরক্কোর আগাদির শহরে দুই রাত থাকার পর আজ আবার চলে যাব মারাকাশ। আদিলকে ফোন করলাম। আমাদের মরক্কোর বন্ধু, যে মারাকাশ থেকে ২৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে নিতে আসবে আমাদের। সাবেক একজন আইটি ম্যানেজার।
কী আদিল, আপনি কি মারাকাশ থেকে রওনা দিয়েছেন?
আমি তো আপনাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই।
কী বলেন! আপনি কি আগাদির থেকে মারাকাশ ফিরে যাননি ওই দিন?
না।
কোথায় ছিলেন?
সমুদ্রসৈকতে তাঁবু টানিয়ে থেকেছি। সমুদ্রকে এনজয় করেছি।
ওরে আল্লাহ! এ তো দেখছি আরেক হিমু।
চা-নাশতা খেয়েছেন?
না।
অ্যাপার্টমেন্টে আসেন। এসে চা-কফি খান। তারপর আমরা রওনা দেব।
সে অ্যাপার্টমেন্টে এল। আমরা তাকে কফি, পিৎজা ও বিস্কুট খেতে দিলাম। দুপুর ১২টায় রওনা দিলাম মারাকাশের উদ্দেশে। পথে টুকটাক কেনাকাটা করলাম। গাড়ি এগিয়ে চলছে মরুভূমির মধ্য দিয়ে। আজ আবহাওয়া খুবই চমৎকার। গান বাজছে। হঠাৎ পরিচিত একটা সুর বেজে উঠল। ব্যাপার কী! মরক্কোর এই লোক ‘দমাদম মাসক্যালেনদর’ বাজায়! কথা বলে জানলাম, সে অমিতাভ বচ্চনকেও চেনে। আমার ছেলে অনুভব বলল, তাহলে এবার বাংলা গান শোনো। এ-ই বলে সে ছেড়ে দিল ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ গান। আফ্রিকার অচেনা এই মরুভূমিতে বাংলা গান তালে তালে বাজে। হৃদয়ে দোলা দেয়, লাল-সবুজের মায়া। ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি চলার পর আমরা একটা রেস্তোরাঁয় এসে থামলাম। বিরতি। দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর এসে পৌঁছালাম মারাকাশে। আদিলকে নিয়েই গেলাম সুপারস্টোরে। কাল মরক্কোয় ঈদ। সুপারস্টার মানুষে পরিপূর্ণ। মরক্কোর অনেক ধরনের খাবার কিনলাম। মিষ্টিজাতীয় খাবার। আদিলকেও উপহার দিলাম কিছু। তারপর নতুন ফ্ল্যাটে উঠে দেখি বিরাট সমস্যা। বারান্দার পাশে যে গ্লাসের দরজা, তার লক কাজ করে না। শাওয়ার কাজ করে না। ইন্টারনেট কাজ করে না। ফোন করতেই এয়ার বিএনবির এক নারী ছুটে এলেন। তাঁকে বললাম, দেখেন, শাওয়ার কাজ করে না। একটু আগে সুপারস্টোর থেকে বালতি কিনে এনে গোসল করেছি। লক লাগে না, দরজা খোলা রেখে ঘুমানোটা তো নিরাপদ নয়।
ওই নারী বললেন, কাল ঈদ, সবাই ছুটিতে চলে গেছে। এখন লোক পাব কোথায়!
এ নিয়ে ঝুটঝামেলা করতে করতে অনেক সময় গেল। ইন্টারনেট ঠিক হলো, কিন্তু নষ্ট হয়ে গেল এয়ারকন্ডিশন। ছেলে–বউ খুব বিরক্ত। পারলে তারা আমাকে রেখেই অন্য হোটেলে চলে যায়। হঠাৎ অনলাইন ঘেঁটে ছেলে বলল, বাবা, পাশেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছি, দাম একটু বেশি, নিয়ে নেব কি না?
নিয়ে নাও। বুক করে ফেলল নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। আজ রাতটা পুরোনো ফ্ল্যাটেই থাকতে হবে। বউয়ের ঈদের প্রস্তুতি শুরু হলো। রান্না করল চিকেন ভুনা, গরুর তেহারি। বাপ–ছেলে লেগে গেলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেখতে। বাংলাদেশ-নেপালের খেলা। রাত দেড়টায়। সকাল ছয়টায় ফজরের নামাজ পড়ে, বেরিয়ে পড়লাম ঈদের নামাজ পড়তে। নামাজ সকাল সাতটায়। ১০ মিনিট হাঁটার পর মসজিদ পেয়ে গেলাম। আফ্রিকা মহাদেশে এটাই আমাদের প্রথম ঈদ। ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে পড়তে খেয়াল করলাম, আমাদের মতো ছয় তাকবিরে তারা নামাজ পড়ে না। পড়ে বারো তাকবিরে। খুতবাও পড়ে না তারা। নামাজের পর কোলাকুলিও নেই। তাদের পাঞ্জাবি অন্য রকম। পেছনে একটা হুডি দেওয়া। প্রায় সব মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশের মতো পাড়ায়-পাড়ায় মসজিদ নেই। এখানে ঈদ উদ্যাপন করতে ভালো লাগছে না। প্রিয় কোনো মুখ নেই। ‘হোসেন’ বলে কোনো ডাক নেই। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে খাওয়াদাওয়া করলাম। তারপর ঘুম। বেলা ১১টায় উঠে শুরু হলো অ্যাপার্টমেন্ট বদলের কাজ। ব্যাগপত্র টেনে টেনে, হেঁটে হেঁটে নতুন অ্যাপার্টমেন্টে গেলাম। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট দেখে বউ-ছেলে খুব খুশি। মডার্ন অ্যাপার্টমেন্ট, সবকিছুই ঝকঝকে। গোসল শেষে সবাই বিরিয়ানি খেলাম। আজ ঈদ। মরক্কোর সব দোকানপাট বন্ধ। ট্যাক্সি নেই। বিকেলে ছেলে একা একা গেল হাঁটতে। এসে বলল, বাবা, দুই পুলিশ অফিসারকে পেয়েছিলাম। ওরা একটু একটু ইংরেজি জানে। জিজ্ঞাসা করলাম, দোকানপাট কখন খুলবে? ওরা বলল, সময় ৯০০–তে। এটা কেমন ইংরেজি? মানে কী!
মানে, সকাল ৯টা।
মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনজন বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। আমরা যে এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি, সেটা বেশ ব্যস্ত এলাকা। চারদিকে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ। আলোকিত সন্ধ্যায়, মারাকাশ নগরী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। প্রশস্ত রাস্তায় স্যান্ডেল পরে হাঁটছি। বাতাস ধুয়ে নিচ্ছে শরীর। আহা, কী প্রশান্তি! ভালো লাগা। রেস্তোরাঁগুলোও খুলেছে। হঠাৎ ছেলে বলল, বাবা, চলো এই রেস্তোরাঁয় আমরা ডিনার করে ফেলি। ব্যস্ত রেস্তোরাঁ। কাস্টমারে পরিপূর্ণ। সবাই বড় পর্দায় ফুটবল দেখছে। ইউরোপিয়ান কাপ। ফ্রান্স বনাম অস্ট্রিয়ার খেলা। মরক্কোতে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে অনেকেই। আমরাও এই রেস্তোরাঁয় বসে গেলাম খেতে। ফুটবল দেখতে। রাতে খেয়ে ১১টার দিকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম। কাল আদিল আমাদের নিয়ে যাবে বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। আমরা সেই স্বপ্ন নিয়েই ঘুমোতে গেলাম। আপাতত। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: মরক্কো ভ্রমণের গল্প: শেষ পর্ব
দূর পরবাসে ভ্রমণ, ভিডিও, ছবি, ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]