কে এই চিকিৎসক সৈয়দ শওকত হোসেন

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগানের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট শৈল্যচিকিৎসক মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শওকত হোসেন। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির খ্যাতিমান মেডিকেল স্কুল মাইমোনাইডস মেডিকেল সেন্টার থেকে কার্ডিও ভাস্কুলার এবং ভাস্কুলারের ওপর জেনারেল সার্জারিতে ফেলোশিপ সম্পন্ন করেন। সৈয়দ শওকত হোসেন ১৯৭৫ সালে চলে আসেন গ্রেট লেক স্টেট মিশিগানে।

মিশিগানের বৃহত্তম নগরী বিশ্বের মোটর গাড়ির রাজধানী খ্যাত ডেট্রয়েটের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী হাসপাতাল সেন্ট জন থেকে জেনারেল সার্জারিতে ইন্টার্নশিপ এবং রেসিডেন্সি শেষ করে বিভিন্ন হাসপাতালে হার্ট সার্জন হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর কাজ করে অবশেষে মিশিগান স্টেটের লেক হিউরনের কোলঘেঁষা, ব্লুওয়াটার ব্রিজের পার্শ্ববর্তী পোর্ট হিউরন শহরে নিজস্ব একটি ক্লিনিক গড়ে তোলেন। সজ্জন এবং উদার প্রকৃতির সৈয়দ শওকত হোসেন চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি মিশিগানে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকান কমিউনিটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কমিউনিটির তৎকালীন নেতাদের সহযোগিতায় ইন্ডিয়ান ব্রাদারহুড অ্যাসোসিয়েশন এবং পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশনের উত্তরসূরি সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগানের হাল ধরেন বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডক্টর সৈয়দ শওকত হোসেন। আশি দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগানের সভাপতি  নির্বাচিত হন। টানা এক দশক সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে বিচ্ছিন্ন কমিউনিটিকে তিনি এক ছাদের নিচে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। অ্যাসোসিয়েশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ওই সময়ে কাউন্সিলর সার্ভিস, বনভোজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অসংখ্য জনহিতকর কাজের মাধ্যমে কমিউনিটিকে সেবা প্রদান করা হয়েছে এবং কনান্ট অ্যাভিনিউয়ে ক্রয় করা হয়েছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের জন্য একটি ভবন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা এবং বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অব মিডওয়েস্টের সভাপতি হিসেবেও সৈয়দ শওকত হোসেন অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

জন্ম ১৯৫০ সালে, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকার সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান আলীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে সৈয়দ শওকত হোসেন হলেন চতুর্থ। বড় ভাই সৈয়দ মঞ্জুল হাসান ছিলেন হাইকোর্টের একজন আইনজীবী, ১৯৭৭ সালে তিনি  মৃত্যুবরণ করেন। মেজো ভাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এস এম এ ফয়েজ, যিনি ২০০২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত পুরান ঢাকা তথা ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মুসলিম গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে তুমুল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের সেরা মেডিকেল স্কুল ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিজের জায়গা করে নেন সৈয়দ শওকত হোসেন। ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়দ শওকত হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারকে পেছনে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন এবং জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমেরিকার অফুরন্ত সুযোগ–সুবিধা, অঢেল সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা এবং পোর্ট হিউরনের প্রাসাদতুল্য বাড়ি, কিছুই তাঁকে দেশপ্রেম, দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি অদম্য ভালোবাসা থেকে বিমুখ করতে পারিনি। সব ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে হার্ট সার্জারির উন্নতমানের যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যেতেন বাংলাদেশে গরিব অসহায় মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে।

মানবতার কল্যাণে জীবনের মূল্যবান সময়কে উৎসর্গ দিয়ে আজ নিজেই হৃদ্‌রোগসহ শারীরিক নানা জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিলেও মানষিকভাবে তিনি এখনো একজন অপরাজেয় যোদ্ধা হিসেবে বেঁচে আছেন। বর্ণাঢ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অধিকারী বয়োবৃদ্ধ, আমাদের অগ্রজ এই সহযোদ্ধার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলো একটি অনুষ্ঠানে, আবেগাপ্লুত হয়ে কাছে ডেকে অনেক কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার কারণে প্রকাশ করতে পারলেন না, অন্তক্ষরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটল অশ্রুসিক্ত নয়নে, দুই চোখ ভরে উঠল গ্রেট লেকের বরফগলা পানির মতো। শওকত ভাই, ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো!

লেখক: সৈয়দ শাহেদ হক, সভাপতি, বাংলা প্রেসক্লাব মিশিগান