একজন নাগরিকের দায়িত্ব থেকে
আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে আমেরিকা থেকে, যেমন আমি সুইডেনে থাকি অথচ বাংলায় কেন লিখি, ইংরেজি বা সুইডিশে লিখি না কেন? আমি মাঝেমধ্যে ইংরেজিতে লিখি ও সুইডিশেও লিখি, তবে লেখার বিষয়বস্তু সব সময় ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমি ঘরের কথা পরকে জানাতে পছন্দ করি, যদি সেটা গর্বের কিছু হয়; কিন্তু যদি সেটা নিজেদের সমস্যা, যেমন ধরুন দুর্নীতি, গণতন্ত্রের গাফিলতি বা যেসব বিষয় আমার দেশের মানমর্যাদা জড়িত, সেসব বিষয় মূলত বাংলায় লিখি। কারণ, যখনই মত-দ্বিমতের প্রশ্ন, সেখানে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি। বলতে পারেন, আমি কিছুটা জাতে মাতাল তালে ঠিক। তা ছাড়া আমি নিজেই দেশটির জন্মের শুরুতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার কোনো ক্ষতি বা অবমাননা হোক, সেটা তো মেনে নিতে পারি না। তারপর আমি একেবারে গ্রামের বাঙালি। সেই রবি ঠাকুর যে ভাষায় বলতেন কথা, আমিও তা-ই বলি।
এখন যে বিষয়টি নিয়ে লিখব, সেটা নিশ্চয়ই বিদেশিদের চোখে নিন্দনীয়, যদি তাঁরা জানেন, যেমন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কী কী বিষয় নিয়ে দেশের সব মিডিয়া মেতে আছে বলুন! একজন খুনিকে নিয়ে, একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে এবং দুই বা তিনজন চলচ্চিত্রজগতের শিল্পীদের নিয়ে। এ ধরনের খবর বা ঘটনা পাশ্চাত্যেও ঘটছে প্রতিনিয়ত, তবে এসব ঘটনা মিডিয়ার শীর্ষস্থান কখনো দখল করে না। এসব খবরের জন্য সন্ধ্যার কাগজ, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বা বিনোদনের জন্য যেসব গণমাধ্যম রয়েছে, সেসব জায়গা দখল করে।
একটি দেশে যেখানে তেল আনতে নুনের পয়সা নেই, যেখানে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিদেশি অর্থের অভাবে নাগরিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, যে দেশের জাতীয় সংসদে বিরোধী দল নেই, যে দেশে আইনের শাসনে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব, যে দেশে শিক্ষায় সচেতনতার অভাব, যে দেশে সরকারি কর্মচারীর কাছে জাতি জিম্মি, যে দেশে শত শত সংবাদপত্র অথচ সঠিক ও গঠনমূলক সাংবাদিকতার চর্চার অভাব, সে দেশের পরিকাঠামো কীভাবে মজবুত হতে পারে? ভেবেছেন কি? ভাবুন, সারা জীবন দেশের সেবা করার পর অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সব সেক্টরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে আশ্রিত, এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয় হতে পারে না? প্রতিদিনের খবরের কাগজের প্রতিটি পাতা খবরে ভরা; কিন্তু একটু দয়া করে পড়ে দেখুন, কী খবর সেখানে, কিসের ওপর খবর, কাকে বা কাদের নিয়ে খবর এবং কেন খবর? একটি উদাহরণ দিই। আশা করি এসব অপ্রিয় সত্য কথা দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে কোনো বাধার সম্মুখীন হবে না এবং যাঁকে নিয়ে কথাটি তুলে ধরছি, তিনি দেশের স্বার্থে বিষয়টি শিক্ষণীয় হিসেবে দেখবেন। বর্তমানে দেশের বৃহত্তম পার্টি আওয়ামী লীগ। সেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু বিরোধী পার্টির বদনাম প্রচারে ব্যস্ত। অথচ কেউ একবারও প্রতিবাদ করেন না। এভাবে চলতে থাকলে কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ, যেদিন ভোট জালিয়াতি বন্ধ হবে? সংগঠনকে মজবুত করতে হলে, তার পরিকাঠামোকে শক্ত করতে হলে, শুধু বিরোধী দলের বদনাম করলেই কি হবে? অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ডিজিটাল-পদ্ধতিতে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন? এটা কি হাস্যকর নয়? এসব কথা কীভাবে সুইডিশ বা ইংরেজিতে লিখব, বলুন?
যা-ই হোক, প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশ গরিব দেশ। নানা সমস্যা থাকতেই পারে। সমস্যা কি শুধু গরিব দেশগুলোর? সমস্যা সবার জন্যই, তবে ধরন হয়তো ভিন্ন। এক সপ্তাহ ধরে চলছে ব্যাংক ক্রাইসিস। প্রথমে আমেরিকা, পরে সুইজারল্যান্ড, তারপর বিশ্বযুদ্ধ, যা গোটা বিশ্বকে তছনছ করছে অর্থনৈতিকভাবে। এখানে ব্যাংক ক্রাইসিসের ধরন আর বাংলাদেশের ব্যাংক ক্রাইসিসের ধরন কি এক? মোটেই না। আমাদের দেশের ব্যাংক লুট হচ্ছে নিজ দেশের মানুষের দ্বারা। যাঁদের জাতি বিশ্বাস করে দায়ভার দিয়েছে দেশ গড়ার কাজ। অথচ তাঁরা দেশকে ধ্বংস করে দেশ ছাড়ছেন। দেশের সর্বস্ব শেষ করছেন এবং সব স্তরে সেটা চলমান। অথচ এর জবাবদিহি নেই!
পাশাপাশি আমি আশার আলো দেখছি প্রযুক্তির মধ্যে, দেখছি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা। এটি হলো একধরনের সফটওয়্যার টেকনোলজি, যা রোবট বা কম্পিউটারকে মানুষের মতো কাজ করায় ও ভাবায়। যেমন কারও কথা বুঝতে পারা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, দেখে চিনতে পারা—এককথায় মেশিন লার্নিং।
মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ জ্ঞান রয়েছে, তা ধারণার বাইরে। সমস্যা হচ্ছে, আমরা সারাক্ষণ আবর্জনার মধ্যে থাকতে থাকতে অকেজো হয়ে পড়ছি। কারণ, অন্যের কথা শুনতে শুনতে নিজের মধ্যে যে ক্রিয়েটিভিটি, সেটা নষ্ট করে ফেলছি। তারপর আমরা রক্ত-মাংস দিয়ে গঠিত এবং আমাদের শরীরে নানা ধরনের নফস রয়েছে, যা আমাদের ইমোশনালি ব্যস্ত রাখে। ফলে সিলেকটিভভাবে কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখন যদি এআই-কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে সম্ভব ভবিষ্যৎকে বর্তমানে এনে কাজে লাগানো। এআই রক্ত-মাংসের শরীর নয়, সেখানে সব ধরনের নফসের সংযোজন থাকবে না। এআই-কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ফলে এআই ডিমান্ড বাই সাপ্লাই কনসেপ্টের ওপর শতভাগ কাজ করবে এবং সব সময় গুড টু বেটার মানের হবে।
অতএব বাস্তবকে ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমানে এনে সেটাকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য করতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা ভালো জ্ঞান পায় এবং তারা তাদের নিজ জ্ঞান দিয়ে কিছু করতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এআই-এর ডিজিটালাইজেশন এবং ব্যবহার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে এখন যে জিনিসটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, শিক্ষকেরা যেন ভালোভাবে এআই-এর প্রশিক্ষণ পান এবং ডিজিটাল টুলগুলো কীভাবে কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। তা না হলে তাঁরা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারবেন না। এত দিনের শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠ্যপুস্তক; হঠাৎ সেটা রেখে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান এবং গ্রহণ করা কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি করবে বৈকি! শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত হয়েছে, এখন এআই ব্যবহার করে শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ করা এবং তা নিশ্চিত করা শিক্ষকদের জন্যও একটি কঠিন সময়, যা ধীরে ধীরে সহজ হবে। হাজারো কোটি টাকা খরচ করে স্যাটেলাইট তৈরি করা হয়েছে, অথচ তার সঠিক ব্যবহার নেই, তা তো হতে পারে না? এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচলিত বই-পদ্ধতি সরিয়ে এআই-কে প্রতিস্থাপন করার সময়; কিন্তু বাংলাদেশ কি প্রস্তুত এ বিষয় নিয়ে ভাবতে? হুট করে বলা হলো, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে? সেটা দেখতে কেমন হবে, আছে কি সবার কমিটমেন্ট এর পেছনে?
বর্তমানে ডিজিটালাইজেশন অনেক দূর চলে গেছে। তাকে বাদ দেওয়া মানে সমাজের উন্নয়নের বিরুদ্ধে যাওয়া, যেখানে প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার জন্য এআই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুসরণ এবং একীভূত করা গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করতে এআই চিন্তাশীল উপায়ে শেখানো ও প্রয়োগ করা খুবই দরকার। সে ক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমকে অবশ্যই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এআইর সঙ্গে কাজ করা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, যাতে সাংবাদিকেরা প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিক শিখতে পারেন। দেশের সব গণমাধ্যমের উচিত হবে আজেবাজে খবর দিয়ে খবরের কাগজের পাতা না ভরে এআই শেখানো ও প্রয়োগ করা, যাতে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং নতুন কর্মজীবন সৃষ্টিতে অবদান রাখে। তাতে সবাই প্রযুক্তি ও এর সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও বিস্তৃত বোঝার সুযোগ পাবে এবং সমাজে প্রযুক্তির আরও টেকসই এবং ন্যায্য ব্যবহার পাওয়া সম্ভব হবে।
আরেকটি বিষয় ভাবা দরকার সেটা হলো, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং। এক নায়কতন্ত্রের শাসন থেকে সরে প্রচারমুখী হতে শিখুন। কে বা কারা আমার অবর্তমানে দেশের তথা সমাজের দায়িত্ব নেবে। কারণ, আমরা মানুষ, মরতে আমাদের হবেই। হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি, পৃথিবীতে জীবন এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, অতএব এটাও ভাবার উপযুক্ত সময় এখন।
প্রতিদিন আমি মনের মধ্যে একটি সহজ চিন্তা নিয়ে আমার দিন শুরু করি যে আজ যেখানেই যাই না কেন এবং যা-ই করি না কেন, নিজের ও অন্যদের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, প্রেমময় এবং আনন্দময় জীবন তৈরি করব। আমি যদি দিনে শতবার কাজটি করতে ব্যর্থ হই, তাতে কী আসে যায়? একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষের জন্য ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আমি শতবার ব্যর্থ হলেও এ ব্যর্থতার মধ্যে শত শত নতুন কিছু শিখব। আমি সত্যিই যদি প্রতিজ্ঞা করি এবং যত্নশীল হই, সেটা পূর্ণ করতে ও নিজেকে যদি এভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি, তাহলে আমার মন সংগঠিত হবে। একবার মন সংগঠিত হলে, আমার চিন্তাভাবনা ও আবেগগুলোও সংগঠিত হবে। আমার শক্তিও একই দিকে সংগঠিত হবে। একবার আমার মন, মস্তিষ্ক, আবেগ, শক্তি সংগঠিত হলে আমাকে কোনো কিছুই ঠেকাতে বা বাধা দিতে পারবে না, আমার ফোকাস করার ক্ষমতা এত শক্তিশালী হবে যে আমার মনকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। এটা অভূতপূর্ব, জাগো বাংলাদেশ জাগো, নতুন করে ভাব।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন