মন যখন ছুটে যায় বাংলাদেশে

পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা।
ছবি: সংগৃহীত

দূর পরবাসে হাজারো কাজের ভিড়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় মন ছুটে যায় সুদূর বাংলাদেশে পরিবার–পরিজনের কাছে। বিশেষ করে যখন পরিবারে কোনো অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোনো উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনের মিলনমেলা হয়, তখন প্রতিটি মুহূর্তে মন ছুটে যেতে চায় সেখানে। কিন্তু প্রবাস, সে তো দূর বহুদূরের পরবাস। মন চাইলেই এখান থেকে যখন–তখন ছুটে যাওয়া যায় না বাংলাদেশে পরিবার–পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের কাছে। স্বামী-সন্তান আর সংসার, সঙ্গে নিজের পড়াশোনা তো আছেই।

সম্প্রতি একটি পারিবারিক মিলনমেলায় মন ছুটে গিয়েছে বারবার। ২০২৩ সালের ১০ মার্চ ভিন্ন রকমের কিন্তু ঐতিহাসিক এক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের পরিবারে। মিলনমেলা বসেছিল আমার মায়ের মামাবাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার মশাউড়া গ্রামে। সেদিন সেখানে বসেছিল চার প্রজন্মের মিলনমেলা। মিলনমেলা বসেছিল ফজর মোহাম্মদ বিশ্বাস ও সামসুন্নেসার ছেলে–মেয়ে, নাতি-নাতনি, পুতি ও তাদের বংশধরদের নিয়ে। এ যেন এক বিশাল বটবৃক্ষ ও তার শাখা-প্রশাখা।

এ পরিবারের সবচেয়ে বড় নাতি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দানকারী আ খ ম সাইফুল ইসলাম ঠান্ডু। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসীম বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজশাহীর ভদ্রার মোড়ে নির্মিত হয়েছে ‘স্মৃতি অম্লান’ ভাস্কর্য।

উত্তরসূরিদের মহা মিলনমেলার উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক চেনা পরিচয় বাড়ানো, আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করা, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো। একটা ফান্ড গঠন করে পরিবারের কোনো সদস্যের লেখাপড়া, চিকিৎসা, বিয়ে ইত্যাদিতে সহযোগিতার প্রয়োজন হলে সেখানে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন গঠনমূলক কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হয়েছে অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ।
ছবি: সংগৃহীত

ফজর মুহাম্মদ বিশ্বাস ও সামসুন্নেসার ছোট মেয়ে হাসিনা বানুর মেজ মেয়ে হাসিবা খাতুনের বড় মেয়ে আমি। বর্তমানে জার্মানির মাইঞ্জ শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি এবং জোহানেস গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি অব মাইঞ্জে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণারত।

প্রায় তিন শতাধিক আত্মীয়স্বজন অংশগ্রহণ করেছিল সেদিনের মিলনমেলায়। দেশের প্রায় সবাই অংশগ্রহণ করেছিল সে অনুষ্ঠানে। কিন্তু আমরা যারা প্রবাসে, তারা উপস্থিত হতে না পারলেও আমাদের মন পড়ে ছিল সেই মিলনমেলায়, চোখ ছিল মুঠোফোনের স্ক্রিনে অনুষ্ঠানের আপডেটের জন্য। কোনো কাজেই যেন মন বসাতে পারছিলাম না। মনের ভেতর এক অন্য রকম আবেগ কাজ করছিল সারা দিন।

ছবি: সংগৃহীত

কষ্ট আরও বেড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম, যখন মিলনমেলার ভিডিও দেখে জার্মানিতে জন্ম নেওয়া আমার তিন বছরের মেয়ে বলে ওঠে, ‘মাম্মি আমার যেতে মঞ্চ (মন চায়)’। নিজের আবেগ আটকে রাখতে পারছিলাম না। দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। মেয়েকে বুকে নিয়ে কল্পনায় চলে গিয়েছিলাম পারিবারিক সেই মহা মিলনমেলায়।

সন্তানসহ লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ইনশা আল্লাহ কোনো এক মিলনমেলায় আমিও আমার মেয়ে তাবিয়াহকে এবং মেয়ের বাবাকে নিয়ে সবার সঙ্গে উপস্থিত থাকব। আমার জার্মান মেয়ে সেদিন মঞ্চে উঠে গাইবে, ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই। আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই। আমি বাংলায় গান গাই....’

লেখক: তামান্না ফেরদৌস, গবেষক, জোহানেস গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটি, মাইঞ্জ-জার্মানি।