নওলিনস নোটবুক: বাবাকে নিয়ে লেখা

বাবা দিবস পালিত হয়েছে ১৬ জুন। এ-সংক্রান্ত পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।

বাবার সঙ্গে লেখক। ছবিটি ১৯৯৬ সালে তোলা। পূর্বধলা, নেত্রকোনা, বাংলাদেশছবি: সংগৃহীত

মেয়েরা নাকি বাবার চেহারার সঙ্গে বেশি মিল পায়। আর বাবারাও নাকি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি আদর করেন। ছোটবেলা থেকেই এসব কথা শুনে আসছি। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম নয়। আমার ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে রাগ–অভিমানের চেয়ে বেশি আদর–ভালোবাসার মুহূর্তগুলোই বেশি মনে পড়ে।
আমি দেখতে বাবার কার্বন কপি। বাবার বিমানবাহিনীতে চাকরির সুবাদে ছোটো থেকেই অসুখবিশুখে সিএমএইচে যেতে হতো। একবার এক আঙ্কেল আমাকে দেখে বললেন, ‘এই তুমি আশরাদের মেয়ে না? একটা মোচ পরিয়ে দিলেই তো তোমাকে ওর মতো দেখতে লাগবে, তাই চিনতে ভুল হয়নি।’ আমি সেদিন ওই কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনি। কিন্তু আঙ্কেলের কথাটা ঠিক, আমি দেখতে একবারে বাবার মতো, শুধু তা–ই নয়, আমি ইদানীং নিজের অনেক কিছুতে বাবার সঙ্গে মিল পাই। জীবিত থাকাকালে আমার নানু প্রায়ই বকাঝকা করতেন, বলতেন, ‘এই তুমি বাবার মতো এত দ্রুত কথা বলো কেন, দম নিবা, ধীরে কথা বলবা...।’ সেই থেকে কত চেষ্টা করলাম, কথার স্পিড আর কমেনি! ব্যাপারটা কিন্তু একবারে খারাপ না, সবাই যেই কথা বলতে লম্বা সময় নেয়, আমি হয়তো সেটা আধা সময়ে বলে ফেলতে পারি। পড়াশোনা করার জন্য আমার পাঁচটা দেশে থাকা হয়েছে। জীবনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সব সময়ই দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করতে হয়েছে। সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারলে হয়তো পিছিয়ে যেতাম। ওই দ্রুত কথা বা কাজ করাটা মনে হয় অনেকটাই কাজে দিয়েছে!

বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগটাও হয়েছিল বাবার কারণে। পরিষ্কার মনে পড়ে ২০০৮ সালে এক দুপুরবেলায় বাবা সোফায় বসে প্রথম আলো পত্রিকা পড়ছেন আর আমি মাটিতে শুয়ে টিভি দেখছিলাম।

আমার কাছে পত্রিকার একটি পাতা দিয়ে বললেন, এখানে অ্যাপ্লাই কর তো, ওরা ফুল স্কলারশিপ দিচ্ছে।

আমি তখন ব্র্যাকে ইসিইতে পড়ি। যেই কথা সেই কাজ, অ্যাপ্লাই করলাম। হংকং থেকে আমার ইউনিভার্সিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এশিয়া ট্যুর বাংলাদেশে এসেছিলেন। সোনারগাঁও হোটেলে আমার ইন্টারভিউ হয়। ওই বয়সে আমি জানতাম ও না ফাইভ স্টার হোটেলে কীভাবে যেতে হয়। কোনো একটা জরুরি কাজে বাবার সেদিন আশকোনায় যেতে হয়েছিল। আমার জন্য গাড়িটা রেখে যান। আমি চালক আঙ্কেলের সঙ্গে গেলাম। ইন্টারভিউ দিলাম। সে বছর আমি একমাত্র বাঙালি শিক্ষার্থী হিসেবে হংকংয়ে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাই।

মজার ব্যাপার হলো, বাবা একেবারেও ভাবেননি আমি স্কলারশিপটা পাব। কারণ হয়তো আমার গোল্ডেন এ প্লাস ছিল না। বাবা জাস্ট আমার কাগজগুলো স্ক্যান করে ই–মেইল আর ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দেন, রিকোয়্যারমেন্ট অনুযায়ী অরিজিনাল পেপার কুরিয়ার করেননি। পরের আরেক ফ্রাইডেতে হং কং আলারা বাসায় ল্যান্ডফোনে ফোন দেয় আর আমি জানতে পারি যে আমার ইন্টারভিউ হবে!

একই কাহিনি আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ঘটে। আমার আড়াই বছরের বড় একমাত্র ভাই। আবীর ভাইয়া চীন সরকারের স্কলারশিপে আবেদন করে। রেজাল্ট দেওয়ার দিন বাবার মিনিস্ট্রি থেকে খবর নেওয়ার কথা। আমার ভাইয়ের গোল্ডেন এ প্লাস ছিল এবং সে বরাবরই আমার চেয়ে অনেক মেধাবী। ভাইয়া রেজাল্ট জানার জন্য বাবাকে কল করলে বাবা রেজাল্ট চেক না করেই বলেন, আবীর তুমি চান্স পাওনি, মন খারাপ কোরো না, পড়াশোনায় মন দাও. সে সময় আমার ভাইয়া ও ব্র্যাকের ইসিইর শিক্ষার্থী। যাহোক, তিন-চার দিন পরে বাসায় ল্যান্ডফোনে কল আসে, আমি ধরি আর ভাইয়াকে চাওয়া হয়। ভাইয়াকে ওপাশ থেকে বলে, নাইয়াদ খান, আপনি কি স্কলারশিপটা একসেপ্ট করবেন। আপনি না গেলে আমি যেতে পারি, আমি ওয়েটিং লিস্টে, আপনার ডিসিশনের জন্য অপেক্ষা করছি।

কাকতালীয়ভাবে ল্যান্ডফোনের কলে আমরা দুই ভাইবোন জানতে পারি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো। যেগুলো আমাদের জীবন পরিবর্তন করে দেয়। এ অমূল্য উপহারগুলো যে এমনি এমনি আসেনি, সেটাও বাবা খুব গর্ব করে বলেন। ছোটো থেকেই দেখে আসছি যে আমাদের চেয়ে বাবা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি বেশি খেয়াল রাখেন। নিজেকে উজাড় করে ওদের জন্য করে গেছেন, হয়তো সব সময় তার প্রাপ্য প্রতিদানটুকুও সবার কাছ থেকে পাননি। (এর চেয়ে বেশি লেখা যাবে না; কারণ আমি জানি, বাবা এটা প্রথম আলো পড়ে জানতে পারলে আমার খবর আছে!) বাবা বলেন এসব ভালো কাজের প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ আমাদের দুই ভাই–বোনকে দিয়েছেন।

আমার বাবা খুব আমোদ–ফুর্তি করতে পছন্দ করেন। মুখে সব সময় হাসি থাকবে, মানুষ নিয়ে হইহুল্লোড় করতে থাকবেন। বাসায় বসে থাকার মানুষ না। আমিও দেখলাম, আরে আমিও তো বাবার মতো বাসায় বসে থাকতে পারি না! অফিস আওয়ারের পর মানুষ যেখানে রেস্ট করে, সেখানে আমার কিছু একটা করতে হবে। উইকএন্ডে বাইরে যেতেই হবে। বাসায় থাকা যাবে না। বিকেল বেলায় স্নিকার পরে বাবার মতো হাঁটতে যাই। সব কাজ একবারে বাবার মতো!

ছোট থেকেই দেখে আসছি, বাবা কাপড়চোপড়ে বরাবরই ফিটফাট। ইন করে শার্ট পরেন। আয়রন ছাড়া কাপড় গায়ে দেন না, জুতা ক্লিন থাকে। খুব গোছানো। আমার মনে পড়ে, বিদেশে পড়তে আসার আগে আমি নিজের হাতে কাপড় আয়রন করে রাখতাম। জুতা পালিশ করে আয়না বানিয়ে ফেলতাম। জুমার নামাজের আগে পাঞ্জাবি আয়রন করে রাখতাম। বাবা চুল কালার করার সময় পেছনে দেখতে পারতেন না, আমি ব্রাশ দিয়ে কালার করে দিতাম। খুব মিস করি সে সময়গুলো।

স্কুলে পড়ার সময় পেনসিল কেনা লাগলে সবচেয়ে ভালো পেনসিলটা কিনে দিতেন, যেকোনো কিছুতেই কোনো সময় কার্পণ্য করেননি। এখন নিজের জন্য কিছু কিনতে গেলে, যখন বেশি দামের কারণে কম দামে কিছু কিনি, তখন মনে হয়, বাবা সঙ্গে থাকলে ভালোটাই পছন্দ করতেন।

আমার হাতের যেকোনো রান্না বাবার খুব পছন্দ। এখনো মনে পড়ে, পুডিং বানালে বাবা গরম পুডিং একবারে পুরোটা খেয়ে বলতেন ‘খুব মজা হইছে, যাও আরেকটা বানায় নিয়ে আসো।’ আমি মন খারাপ আর খুশি দুটোর মিক্সড ফিলিং নিয়ে অত্যুৎসাহে বানিয়ে নিয়ে আসতাম! বাবা সব সময় মানুষের সামনে আমার এত প্রশংসা করতেন যে আমি লজ্জায় পালিয়ে যেতাম। বাবা আমাদের দুই ভাই–বোনকে এত ভালোবাসেন যে সেটা লেখায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকি আর আমার ভাইয়া সামনের মাসে আমেরিকায় পার্মানেন্টলি চলে আসছে। ইনশা আল্লাহ সব কিছু ঠিক থাকলে বাবা আর আম্মু সামনের বছর মে মাসে আসবেন, কিছু গল্প না হয় আজ রেখে দিই, সামনের বছর তাদের ছবিসহ সামনের বাবা দিবসে প্রথম আলোয় আরেকটা লেখা পাঠাব। অপেক্ষায় রইলাম .

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com