পয়লা বৈশাখ: উৎসব, নাকি আদর্শের লড়াই
পয়লা বৈশাখ বাঙালির ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে প্রাণবন্ত দিন। নতুন বছরের এই প্রথম দিনটি কেবল সময়ের পাতা ওলটানোর উপলক্ষ নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও আবেগের প্রতিচ্ছবি। উৎসবের রঙে রাঙা এই দিনটি যেন আমাদের জাতীয় চেতনারই প্রকাশ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রাণের উৎসব নিয়েই তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক আর মতভেদ। কেউ একে দেখছেন নিছক আনন্দ-উল্লাসের দিন হিসেবে, আবার কারও চোখে এটি হয়ে উঠেছে আদর্শিক অবস্থান জানানোর উপলক্ষ। বর্ষবরণ কি তবে আজ আর শুধু আনন্দ নয়, একটি আদর্শের ময়দান?
শিকড় থেকে শহরে
একসময় গ্রামীণ বাংলায় ব্যবসায়িক বছর শুরু হতো পয়লা বৈশাখে। হালখাতার মাধ্যমে নতুন হিসাবের সূচনা দোকানে মিষ্টিমুখ আর গ্রামীণ মেলাই ছিল এর মূল অনুষঙ্গ। ঢাকায় এই উৎসব নাগরিক মধ্যবিত্তের হাত ধরে নতুন রূপ পায়। চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা সেই নববর্ষ উদ্যাপনকে দেয় এক শিল্পনির্ভর ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক মাত্রা।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শোভাযাত্রা ও উৎসব নিয়ে বিতর্কও বেড়েছে। কেউ বলছেন এটি বাঙালির পরিচয় ও সংস্কৃতির শক্তিমত্তার প্রকাশ। আবার কেউ একে ‘বিজাতীয় অনুকরণ’ কিংবা ‘বিধর্মীয় সংস্কৃতি’র চর্চা বলে আখ্যা দিচ্ছেন। প্রশ্ন জাগে, যে উৎসব এককালে সবাইকে একসঙ্গে আনন্দ দিত, সেটি কীভাবে এক আদর্শিক বিভক্তির ময়দানে পরিণত হলো?
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
নির্বাচনের রেশ ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। সেই প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতির মঞ্চেও। বর্ষবরণ উপলক্ষে প্রশাসনের কড়াকড়ি, নিরাপত্তাব্যবস্থা, এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য—সব মিলিয়ে বোঝা যায় এই উৎসব আজ কেবল সংস্কৃতির বিষয় নয়, বরং রাজনীতির এক নিঃশব্দ যুদ্ধক্ষেত্র।
সরকার বলছে, পয়লা বৈশাখ জাতীয় ঐক্য ও অগ্রগতির প্রতীক। অন্যদিকে বিরোধীদের অভিযোগ, এটি এখন ‘রাষ্ট্রীয় প্রচারণা’র অংশে পরিণত হয়েছে। এদিকে কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী তো বর্ষবরণকে সরাসরিই ‘ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি’ বলে দাবি করছে।
প্রতীকের আড়ালে বার্তা
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা একসময় ছিল শিল্প ও প্রতীকিতার সম্মিলন। কিন্তু এখন অনেকেই বলছেন, এই প্রতীকগুলোর মধ্য দিয়ে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনের টাইপোগ্রাফি, সাংবাদিক শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদ, ফ্যাসিবাদবিরোধী মুখাবয়ব—সব মিলিয়ে যেন এক রাজনৈতিক কোলাজ।
এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় থাকা মোটিফের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়, বার্তাগুলো কতটা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এখানে নেই সহজ-সরল লোকজ আনন্দ, নেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের নিরপেক্ষতা। আছে তীব্র ব্যঙ্গ, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চিত্রের মাধ্যমে কটাক্ষ করার এক নির্মম পরিকল্পনা।
সংস্কৃতি কার?
বিশ্লেষকদের মতে, যখন কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা রাষ্ট্র সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন তার স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে যায়। উৎসব হয়ে ওঠে আদর্শিক অবস্থান জানানোর মাধ্যম। এতে করে উৎসবের সর্বজনীনতা হুমকির মুখে পড়ে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ মানুষ এই বিতর্কে নেই। তাঁদের কাছে পয়লা বৈশাখ মানে নতুন জামা, পান্তা-ইলিশ আর এক দিনের আনন্দ। কিন্তু শহুরে সমাজে এই দিনটি হয়ে উঠেছে এক প্রতীকী প্রশ্ন—আপনি এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন, না বিরত থাকছেন, তা দিয়েই আপনার অবস্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে।
পয়লা বৈশাখ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এটি কোনো দল, গোষ্ঠী বা মতের নয়। বর্ষবরণ হোক আনন্দের দিন—সব মত, পথ ও বিশ্বাসের মানুষের জন্য। যেখানে সংস্কৃতি হবে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মানবিক। রাজনীতির রং নয়, থাকুক হৃদয়ের রং—এই হোক নতুন বছরের অঙ্গীকার।