সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবায় যে অভিজ্ঞতা হলো

ডাক্তারপ্রতীকী ছবি

আইসল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং সুইডেনসহ অন্যান্য নরডিক দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবা এবং গুণমানে আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে অবস্থান করে। আমি থাকি সুইডেনে, মাঝেমধ্যে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বা হাসপাতালে যেতে হয়। আজ পৃথিবীর সেরা স্বাস্থ্যসেবার দেশের হেলথ কেয়ার বা স্বাস্থ্যসেবার সম্পর্কে বর্ণনা দেব। সঙ্গে আমার ভাবনায় ঢুকেছে কৌতুহল, তা হলো, জানতে ইচ্ছে করছে কী হয় দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

আসুন জেনে নিই তার আগে সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে। এখানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, সাধারণ হাসপাতাল, বিশেষ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রুটিনমাফিক চেকআপ বা সাধারণ অসুস্থতার প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রথম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এখানেই সচরাচর সাধারণ চেকআপ বা কন্ট্রোল হয়ে থাকে এবং রোগীর পরবর্তী স্টেপ কী হবে, তা চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক রেফারেল করেন কোথায় বা কী করতে হবে। রোগীর ফি ২৭৫ ক্রোনার প্রতিবারের দর্শনে (বাংলা ২ হাজার ৭৫০ টাকা)। তবে এই ফি কার্যকর ১৮ বছর থেকে ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৮ বছরের কম এবং  ৮৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে ফ্রি চিকিৎসা। মজার ব্যাপার তা হলো ১৮-৮৫ বছর বয়স্কদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফির ব্যবস্থা রয়েছে, যা ১৪০০ ক্রোনার প্রতি ক্যালেন্ডার বছর বা ১২ মাসে, এই ১২ মাসের বধ্যে যদি কেউ ক্রিটিক্যাল বা জরুরি অবস্থার কারণে পাঁচবারের বেশি স্বাস্থ্যসেবাতে যান, সে ক্ষেত্রে বাকি সময়ে ফ্রি চিকিৎসার জন্য ফ্রি-কার্ড দেওয়া হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন ক্যালেন্ডার বছর শুরু না হয়। এখন যদি রোগীর এমআরই থেকে শুরু করে মেজর সার্জারি বা পেস মেকারের মতো কোনো ক্রিটিক্যাল অস্ত্রোপচার করা লাগে বা হেলিক্যাপ্টরে করে অন্য হাসপাতালে রোগীকে নিতে হয়, তার জন্য কোনো অতিরিক্ত খরচ লাগে না, তবে হাসপাতালে যে সমস্ত রোগী ভর্তি থাকে, তাদের প্রতিদিন ১৩০ ক্রোনার দিতে হয়। ৩০ দিনের বেশি সময় হাসপাতালে থাকলে প্রতিদিনে ৬৫ ক্রোনার। এর মধ্যে রোগীর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়ে থাকে এবং এখানেও খরচের ব্যাপারে একটি লিমিটেশন রয়েছে।

যেমন যাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ভালো না বা বেকার, তাদের ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ বিভাগ সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এমারজেন্সির ক্ষেত্রে  ১১২-তে কল করা মাত্রই অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হয় এবং নিকটতম চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীকে নিয়ে অবিলম্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। ওষুধের ক্ষেত্রে একটি নিদির্ষ্ট দাম নির্ধারিত রয়েছে, প্রতি ক্যালেন্ডার বছরে ১ হাজার ৪২৫ ক্রোনার হলেই ৫০% রিডাকশন এবং ২ হাজার ৮৫০ ক্রোনার হলেই বাকি ক্যালেন্ডার বছরের শেষ অবধি ফ্রি ওষুধের ব্যবস্থা রয়েছে, কোনো রকম অতিরিক্ত খরচ ছাড়া। এখানে জরুরি (ইমারজেন্সি) ছাড়া সবার জন্য চিকিৎসার সমান অধিকার রয়েছে। কোনো রকম দুর্নীতির সুযোগ নেই বা চিকিৎসকদের কোনো কমিশন নেই বা তাদের এক্সট্রা ইনকামের কোনো ব্যবস্থা নেই যে তাঁরা তাঁদের পছন্দের ক্লিনিক বা হাসপাতালে রেফার করলে কমিশন বা অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা পাবে। সুইডেন গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিসে বিশ্বের সেরা স্থানটি আগাগোড়াই তাদের দখলে রেখেছে যা সত্যি প্রশংসনীয়।

দীর্ঘ ৪০ বছর এমন একটি দেশে আছি, একই সঙ্গে এত বছরের রোজগারের বেশিরভাগ অর্থ যখন বাংলাদেশে পাঠিয়েছি, স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে ভাবনা আসতেই পারে, তাই আমার ভাবনা থেকে কিছু প্রশ্ন— কী অবস্থা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার?

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় সরকার বলছে; সরকারি খাতে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে চারটি অধিদপ্তর যথাক্রমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং সেবা পরিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে। স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রভূত কাজ করেছে। সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্যসুবিধাগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

বাস্তবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় কী হচ্ছে—

বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতাল যেগুলোকে মেডিকেল হাসপাতাল বলা হয়ে থাকে এবং সেখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ অনেক সময় দেখা যায় যে চিকিৎসক রোগীকে প্রাথমিক পর্যায়ে দেখার পরে অনেক সময় রেফার করে বাইরের ক্লিনিক বা হাসপাতালে নানা ধরনের চেকআপের জন্য। আমার প্রশ্ন এ সব মেডিকেল হাসপাতালে কি কোনো যন্ত্রপাতি নেই? যদি না থাকে তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা কীভাবে প্রশিক্ষণ পায়? হাসপাতালের যন্ত্রপাতির মেইনটেন্যান্সই বা কীভাবে করা হয়? এটাও বা কীভাবে সম্ভব যে ওষুধ বিক্রেতাও ওষুধ বিক্রি করে প্রেসক্রিকশন ছাড়া? সরকারি হাসপাতাল এবং প্রাইভেট ক্লিনিকের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? যে সমস্ত চিকিৎসক সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত, তাঁরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করেন তাদের কাজে? তাঁরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করেন প্রাইভেট ক্লিনিকে? যে পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়, দেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সে পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত সেবা দেশের জনগণ কি পেয়ে থাকে? দুর্নীতি কি এখানেও বিরাজ করছে?

স্বাস্থ্যকেন্দ্র মানবজাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এটা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। হচ্ছে কি এখানে তেমন প্রশিক্ষণ, যে প্রশিক্ষণে সুশিক্ষার সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের ওপরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে? হচ্ছে কি তেমন সুশিক্ষা এখানে? তীব্র গরমে ওষুধ সংরক্ষেণে কী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

এখন দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপর, কোথায়ও কোথায়ও এর কম চলছে, বিভিন্ন ফার্মেসির ওষুধগুলো কীভাবে রাখা হয়েছে সেটা মনিটরি করার দায়িত্ব নিশ্চয় বিক্রেতার। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ওষুধের ফার্মেসিগুলো কোনো বিধি মোতাবেক নিয়মকানুন মেনে বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে কি? এখন যদি কর্মকর্তারা অডিট করতে গিয়ে দুর্নীতি করে তবে রোগীর জীবনের নিরাপত্তা এবং সঠিকভাবে রোগ নিরাময়ের কিছুই হবে না, সেক্ষেত্রে সততা এবং সচেতনতার খুবই প্রয়োজন।

ওষুধের ওপর যেসব নিয়মকানুন রয়েছে তা ওষুধ বিক্রেতাদের জানতে হবে ও মানতে হবে, তা না হলে ওষুধ খাওয়া বিপদ বাড়াবে। সোনার বাংলা বা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে, হেলথ কেয়ার টেকনোলজির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, পুরো জাতি যদি মানসিক অসুস্থতায় জীবনযাপন করতে থাকে, তাহলে কি সোনার বাংলা গড়া হবে?

উল্লেখ্য, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের অবহেলার কারণে হাজারো বিলাসবহুল অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে মেশিন, প্রিন্টার, এমআরআই, পিসিআরসহ শতশত যন্ত্রপাতি সময়মতো সংস্কার না করায় সেগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে। ঢাকাসহ দূরের স্থানে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীরা যেতে পারছে না। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অথচ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কেরা এ বিষয়ে উদাসীন! যদিও ইদানিং বাংলাদেশেই বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হচ্ছে (বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং হল চিকিৎসা ক্ষেএে ইঞ্জিনিয়ারিং নীতি এবং প্রযুক্তির প্রয়োগ)। একজন বায়োমেডিকেলের শিক্ষার্থী প্রকৌশলের অর্জিত জ্ঞানকে চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতির পেছনে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক, যেমন চিকিৎসায় ব্যবহৃত নানা যন্ত্রপাতির ডিজাইন, ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধন, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অধুনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চিকিৎসায় প্রয়োগ ইত্যাদি ইত্যাদি। জানি না তারা প্রশিক্ষণ শেষে দেশে না বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে! দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বিশেষ করে সব ধরনের প্রকৌশলি যন্ত্রপাতি তদারক থেকে শুরু করে তার মেইন্টেন্যান্স করা এবং চিকিৎসকদের পাশাপাশি কাজ করা আশু প্রয়োজন। মোটকথা প্রকৌশলের আইডিয়াগুলোকে তারা চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে কাজে লাগাবে বলে আমি মনে করি।

সুস্থ বা স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন দিতে পারে সুন্দর মন-মানসিকতা আর সুন্দর মন-মানসিকতাই পারবে মানবজাতির পরিবর্তন আনতে। দেশের স্বাস্থ্যসেবায় একদিকে রয়েছে নানা অজ্ঞতা, অন্যদিকে রয়েছে স্বার্থপরতা ও দুর্নীতিপরায়ণতা—যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কেউ উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারছে না। তারপর সরকারি চাকরিরত ক্যাডারকে প্রমোশন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ক্রমাগতভাবে বেশি দেওয়ার ফলে চিকিৎসকদের আপেক্ষিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এবং সেটা বেড়েই চলেছে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, ওষুধনীতি, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি কোনোটাই স্বাস্থ্য গঠন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির অনুকূলে নয়। কেবল স্বপ্নে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয় তাই তুলনা করলাম দুটো দেশের স্বাস্থ্যসেবার, আশা করি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে কাজে লাগবে।

*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক ফাইজার, সুইডেন। [email protected]