সিডনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক ভাবনা, অংশগ্রহণ ও অগ্রগতি

এআই/প্রথম আলো

অস্ট্রেলিয়ায় আগামীকাল শনিবার (৩ মে) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফেডারেল নির্বাচন। দেশজুড়ে নির্বাচনী উত্তেজনা তুঙ্গে, এবং এর প্রভাব পড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির মাঝেও। বিশেষ করে সিডনির বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নির্বাচনী আলোচনার পাশাপাশি দলীয় প্রচারণায় সরব ভূমিকা রাখছেন অভিবাসী বাঙালিরা। লেবার ও লিবারেল দলের প্রতি সমর্থনকে ঘিরে কমিউনিটিতে স্পষ্ট বিভাজন থাকলেও একটি বিষয়ে সবাই একমত—অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার।

প্রবাসে রাজনৈতিক সক্রিয়তার উন্মেষ

সিডনির গ্র্যাইন্ডলার নির্বাচনী এলাকা, ওয়াটসন নির্বাচনী এলাকার কিছু অঞ্চল, ব্যাংকস্টাউন, ল্যাকেম্বা, রকডেল, ক্যাম্পবেল্টাউন, মিন্টো, ব্ল্যাকটাউনসহ আরো কিছু এলাকায় বাংলাদেশি কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এবারের নির্বাচনে লিবারেল পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একমাত্র প্রার্থী জাকির আলম লেনিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিডনির ওয়াটসন আসন থেকে। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন শতাধিক বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক। তাঁদের একজন গত নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য নির্বাচনে লিবারেল পার্টির সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন এএনএম মাসুম। তিনি বলেন, `এই নির্বাচন আমাদের গর্বের। একজন বাংলাদেশি প্রার্থী জাতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন—এটা আমাদের রাজনৈতিক অগ্রগতির প্রতীক।'

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ
ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঐতিহ্যগত বিপুল সমর্থনও দৃশ্যমান। ল্যাকেম্বার মতো এলাকায় ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশি ভোটার রয়েছেন। সরকারি চাকুরীজীবী নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। তিনি বলেন, "অ্যালবানিজ সরকার অভিবাসন নীতিকে সহজ করেছে, নতুন ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছে। তাই আমরা লেবারকেই সমর্থন করছি।”

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ও রাজনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ ও অগ্রগতি

৩৪ বছর ধরে লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত ও ক্যাম্পবেল্টাউন সিটি কাউন্সিলে ১০ বছর ধরে নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছেন মাসুদ চৌধুরী। তাঁর প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে আরও বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন। তিনি বলেন, "প্রবাসে থাকলেও আমাদের শিকড় বাংলাদেশে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই আমরা গড়ে তুলছি আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই এখানকার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন আর শুধু দর্শক নন, তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির সক্রিয় অংশ। ভোট, প্রার্থীতা, দলীয় দায়িত্ব—সব জায়গায় তাঁদের উপস্থিতি বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির আরও শক্তিশালী অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করবে—এ আশাই এখন সকলের আর এবার লেবার পার্টিকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন, আশা করি বাংলাদেশিসহ বহু সংস্কৃতিময় সম্প্রদায়ের ভালো-ই হবে।"

বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সাতটি স্থানীয় সিটি কাউন্সিলে বাংলাদেশি প্রতিনিধি রয়েছেন। তবে জাতীয় পর্যায়ে এখনো দৃশ্যমান অংশগ্রহণ গড়ে ওঠেনি। এই ঘাটতি পূরণে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে দুই প্রধান দলেই বাংলাদেশি নেতৃত্বকে।

লিবারেল পার্টির নিউ সাউথ ওয়েলসের ল্যাকেম্বা ও ব্যাংকস্টাউন শাখার সভাপতি এবং সাবেক কাউন্সিলর শাহেজামান টিটু বলেন, "আমরা চাই বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে একজন সংসদ সদস্য জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হোক। কিন্তু দলীয় বিভাজন আমাদের সামনে প্রধান বাধা। প্রথমে একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে হয়তো এটা অসম্ভব নয়। আর এটার জন্য কাজ করে যাচ্ছি অক্লান্তভাবে”

বাঙালিদের নানা অনুষ্ঠানে প্রায়ই উপস্থিত থাকেন লেবার পার্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ক্রিস বুয়েন্স
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশি ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি

ভোটারদের মধ্যে রয়েছে অভিবাসন, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ। ইস্টলেকের বাসিন্দা হায়দার খান বলেন, "বৈচিত্র্যময় সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার। প্রবাসে থেকেও আমাদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, বাংলাদেশিরা যেকোনো পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। প্রজন্ম বদল হচ্ছে, আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করুক। অভিবাসন নীতি কিংবা সামাজিক কল্যাণনীতি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যে দল ভালো সে-ই দলের প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল”। অন্যদিকে, আদনান আহমেদ বলেন, "রাজনীতিতে ভারসাম্য থাকা জরুরি। আমাদের উচিত দুই দলের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখা, যাতে আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারি।"

এবার নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশিদের জন্য বাংলায় নির্বাচনী প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে। এতে কমিউনিটির মধ্যে নির্বাচনী সচেতনতা ও অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কমিউনিটির প্রবীণ সমাজকর্মী গামা আব্দুল কাদির বলেন, "এমন সময় এক যুগ আগে ছিল কল্পনার বাইরে। এখন আমরা শুধু ভোট দিচ্ছি না, নেতৃত্ব দিচ্ছি। এটাই আমাদের উন্নতির প্রমাণ।”

এছাড়া, সিডনির ক্যাম্বারল্যান্ড সিটি কাউন্সিলের তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর প্রবাসী বাংলাদেশি সুমন সাহা মনে করেন, আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করা জরুরি। তাঁর ভাষ্যে, অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি অভিবাসন নীতিতে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন এনেছে। এদেশে সাদা পলিসি বাতিল করে লেবার সরকার-ই বহুসাংস্কৃতিক সমাজ গঠনের পথ সুগম করেছে, যার সুফল পাচ্ছেন বাংলাদেশিসহ অন্যান্য অভিবাসী জনগোষ্ঠী।

লিবারেল পার্টি থেকে জাতীয় পর্যায়ে মনোনয়ন পাওয়া একমাত্র প্রার্থী প্রবাসী বাংলাদেশি জাকির আলমের প্রচারণা
ছবি: সংগৃহীত

সুমন সাহা আরও বলেন, ‘অ্যালবানিজ নিজে সরকারি হাউজিং কমিশনের একটি বাসায় বেড়ে উঠেছেন। তিনি সাধারণ মানুষের কষ্ট বোঝেন এবং জানেন, কমিউনিটির প্রকৃত উন্নয়নের জন্য কী প্রয়োজন।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে লেবার সরকার অবগত এবং বহুসাংস্কৃতিক অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে বাংলাদেশিদের ইতিবাচক ভূমিকা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে দিকেও তারা মনোযোগী। তিনি বলেন, ‘আপনার ভোট শুধু একটি রাজনৈতিক সমর্থন নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে। তাই বুঝে শুনে ভোট দিন, যেন আগামী দিনে আমরা আরও ভালো থাকতে পারি।’