সাফল্যের আড়ালে নীরব সাহচর্য: বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়দের জীবনে জীবনসঙ্গিনীদের অদৃশ্য ভূমিকা

রোনালদো ও জর্জিনা রদ্রিগেজফাইল ছবি

সাফল্যকে আমরা প্রায়শই একক অর্জন হিসেবে দেখি। খেলাধুলার জগতে তো বটেই—যেখানে গোল, শিরোপা আর রেকর্ডই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু একজন অ্যাথলেট যখন বিশ্বজয় করেন, তখন কি সেই জয় শুধুই তাঁর? নাকি পর্দার আড়ালে থাকে আরও একটি হৃদয়ের আত্মদান—একজন জীবনসঙ্গিনীর নীরব ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও মানসিক শক্তি?

এই লেখা ঠিক সেই আত্মদান, সেই অদৃশ্য, কিন্তু অপরিহার্য ভালোবাসার কাহিনি—যা বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের জীবনে এনে দেয় ভারসাম্য, শিকড় এবং আত্মবিশ্বাস।

রজার ফেদেরার ও মিরকা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

রজার ও মিরকা ফেদেরার: খেলোয়াড় থেকে সহযোদ্ধা

রজার ফেদেরার একবার বলেছিলেন, ‘Discipline শব্দটির মানে আমায় মিরকাই শিখিয়েছেন।’ মিরকা নিজেও ছিলেন প্রতিভাবান টেনিস খেলোয়াড়। কিন্তু ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রজারের ছায়াসঙ্গী, ভ্রমণের সংগঠক, জীবন পরিচালনার নেপথ্য পরিচালক ও নিঃশব্দ অনুপ্রেরণা।

রজারের ২০টি গ্র্যান্ড স্লাম জয়, ২৪ বছরের ক্রীড়াজীবন এবং চার সন্তানের পরিপূর্ণ পরিবার—সবই মিরকার অবিচল সমর্থনের নির্যাস। ভালোবাসা এখানে শুধু আবেগ নয়, এক সংগঠিত জীবনযাত্রার প্রেরণা।

মেসি ও আন্তোনেলা: শৈশব থেকে শীর্ষে

হোটেলের ব্যালকনিতে স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জো ও সন্তানদের সঙ্গে মেসি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

লিওনেল মেসি ও আন্তোনেলা রোকুজ্জোর প্রেম কেবল হৃদয়ের গল্প নয়—এটি একটি প্রামাণ্য দলিল, যা বলে ভালোবাসা মানে শিকড়ে থাকা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং অটুট বন্ধন। শৈশবের প্রেম, তারপর দূরত্ব, আবার মিলন—এই সম্পর্ক পেরিয়েছে বহু বাঁক, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। আন্তোনেলা হয়েছেন একাধারে স্ত্রী, তিন সন্তানের মা, ফ্যাশন উদ্যোক্তা এবং মেসির আত্মিক আশ্রয়। মেসির পাশে থেকে তিনি নিঃশব্দে নির্মাণ করেছেন এক সুরেলা সংসার, যেখানে ব্যর্থতা কিংবা সাফল্য—সবই ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়।

রোনালদো ও জর্জিনা: মোহ থেকে মানসিক বলিষ্ঠতায়

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও জর্জিনা রদ্রিগেজ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

একজন গুচি শোরুমকর্মী ও বিশ্বখ্যাত সুপারস্টার—এই অসমাপ্ত সমীকরণ থেকেই গড়ে উঠেছে রোনালদো ও জর্জিনার সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্কের শক্তি কখনো বাহ্যিক প্রভাব দেখে না, দেখে অন্তরের সাহচর্য।

জর্জিনা শুধু একজন প্রেমিকা নন—তিনি একজন মা, একজন সফল উদ্যোক্তা, একজন সহচর, যিনি রোনালদোর জীবনের প্রতিটি সাফল্য ও দুঃখে থেকেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাঁদের সম্পর্ক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হলেও, আস্থা, দায়িত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত।

উসাইন বোল্ট ও কাসি বেনেট: দ্রুতগতির জীবনে ধৈর্যের ছায়া

বিশ্বের দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টের জীবনে কাসি বেনেট আছেন অনেক বছর ধরেই। তিনি শুধু একজন ‘চিয়ারলিডার’ নন, বরং বোল্টের জীবনে আত্মবিশ্বাস ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তির নাম। বিশ্বমঞ্চে বোল্টের সাফল্যের নেপথ্যে কাসির সমর্থন ছিল অটুট। পাশাপাশি তিনি দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করেন। একাধারে বোল্টের জীবনসঙ্গী, মায়ের ভূমিকা, আবার সমাজসেবিকা—তিনটি ভূমিকায়ই কাসি দুর্দান্তভাবে সফল।

মাইকেল জর্ডান ও ইভেট প্রিয়েতো: কিংবদন্তির দ্বিতীয় জীবন

বাস্কেটবল ঈশ্বর মাইকেল জর্ডান তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ইভেট প্রিয়েতোর মাধ্যমে খুঁজে পান এক নতুন জীবনের রূপরেখা। কিউবান বংশোদ্ভূত ইভেট একজন মডেল ও ব্যবসায়ী, যিনি মাইকেলকে সমাজজীবনে আবার স্থিতি এনে দিয়েছেন। তাঁরা একসঙ্গে দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছেন এবং জর্ডানের আগের সন্তানদেরও আপন করে নিয়েছেন। ইভেট সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত, এবং পরিবারের ভারসাম্য রক্ষায় হয়ে উঠেছেন একজন নিঃশব্দ পরিচালক।

নাদাল ও শিসকা
ছবি: রাফা নাদাল একাডেমি

নাদাল ও ফ্রান্সিসকা শিসকা পেরেল্লো: নীরবতা যার শক্তি

রাফায়েল নাদালের স্কুলজীবনের প্রেমিকা শিসকা পেরেল্লো ১৪ বছরের প্রেমের পর ২০১৯ সালে হন তাঁর জীবনসঙ্গিনী। তিনি সব সময় ছিলেন প্রচারবিমুখ, কিন্তু তাতেই তাঁর প্রজ্ঞা ও শক্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নাদাল নিজেই বলেছেন, তাঁর মানসিক ভারসাম্যের মূল স্তম্ভ শিসকা। তিনি ‘রাফা নাদাল ফাউন্ডেশন’-এর পরিচালনায় আছেন, কাজ করছেন সমাজ উন্নয়নে, আবার একই সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনেও দিয়েছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব।

আরও পড়ুন

তবে কি তাঁরা কেবল প্রেমিকা নন—নির্দেশকও?

এই জীবনসঙ্গিনীরা কি কেবল একেকজন প্রণয়িনী? নাকি তাঁরা একেকজন নেপথ্য নেত্রী, যাঁরা গড়েছেন সম্পর্কের মানে, রক্ষা করেছেন সাফল্যের ভারসাম্য, এবং আবার করে তুলেছেন মানুষটিকে একজন মানুষ হিসেবেও পূর্ণ?

মিরকা শিখিয়েছেন শৃঙ্খলা, আন্তোনেলা দিয়েছেন স্থিরতা, জর্জিনা দেখিয়েছেন আত্মগঠনের সাহস। কাসি শিখিয়েছেন উৎসাহের শক্তি, ইভেট ফেরালেন পারিবারিক স্থিরতা, আর শিসকা দেখিয়েছেন, প্রচারের আলোয় না থেকেও কীভাবে কারও আত্মা হয়ে ওঠা যায়।

জয়ের প্রতিচ্ছবিতে যে মুখ দেখা যায় না

পরেরবার যখন আমরা কাউকে বিশ্বকাপ হাতে তুলতে দেখব কিংবা উইম্বলডনের ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে, তখন শুধু তাঁর পারফরম্যান্স নয়—চোখ রাখুন তাঁর চোখে, বুঝতে চেষ্টা করুন তাঁর পাশে থাকা সেই মানুষটির, যিনি নিঃশব্দে বলেছেন, ‘তুমি পারবে।’

একজন অ্যাথলেটের সাফল্য হয়তো রেকর্ডে লেখা থাকে, কিন্তু একজন জীবনসঙ্গিনীর অবদান থাকে হৃদয়ে লেখা—নির্বাক, অথচ অমলিন। সাফল্য সব সময় স্টেডিয়ামের আলোয় জন্মায় না। অনেক সময় তা জন্ম নেয় নীরব রাত্রির কান্নায়, ভালোবাসার চোখে, ধৈর্যের ভেতর দিয়ে। এই মানুষগুলো—মেসি, রোনালদো, ফেদেরার, নাদাল, জর্ডান কিংবা বোল্ট—শুধু খেলার মাঠের নায়ক নন, তাঁরা জীবনের ময়দানেও অনুপ্রেরণা। তাঁরা দেখিয়েছেন—সংসার আর সাফল্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরিপূরক। যে ভালোবাসতে জানে, সেই লড়তেও পারে।

নতুন প্রজন্মের প্রতি এই লেখার সহজ কিন্তু গভীর আহ্বান: কেবল নিজের জন্য বড় হও, তা নয়; তোমার পাশে থাকা মানুষটার জন্যও বড় হও। যিনি তোমার পাশে নীরব থেকে অপেক্ষা করেন, ভালোবাসেন, সহ্য করেন, তাঁকে তুমি যেন ভুলে না যাও।

তোমার পেশাদার সাফল্যের পাশে পারিবারিক চর্চা, দায়িত্ব ও সহানুভূতির পরিচর্যা করো। কারণ, একজন আসল চ্যাম্পিয়ন শুধু গোল করে না, একজন আসল চ্যাম্পিয়ন ভালোবাসে, শোনে, সহ্য করে, পাশে থাকে।

*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন, প্রবাসী বাংলাদেশি

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]