আমান্তে

কাব্যর ভালো নাম বললে অনেকেই চিনবে। দেশের ডাকসাইটে বিজনেস ম্যাগনেট। পত্রিকায় প্রায়ই নাম আসে ওর কোনো না কোনো কারণে। তবে ইদানীং কাব্য একটু হাঁপিয়ে উঠছে কাজের চাপে। কুচকুচে কালো চুলে তার লেগেছে সাদার ছোঁয়া। এমনিতে স্বপ্নময় চোখের অধিকারী কাব্য কারও কারও চোখে ভীষণ হ্যান্ডসাম, কিন্তু সাফল্য ওর ঝলমলে চোখে অন্য রকম চমক এনেছে। লোকজন দিনরাত ওর কাছে আসছেই। কেউ ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে, কেউ জ্ঞান ধার করতে, কেউ কেউ হয়তো ওর জীবনের সাথি হতে চায়। কিন্তু ওর মন চাইছে একটু বাঁধনহীন জীবন কাটাতে। সেসব দিনের মতো যখন দায়িত্বের বোঝা ওর মাথায় চাপেনি।

বাসার বড় ছেলে কাব্য। বাবা বেঁচে ছিলেন তখন। আমেরিকাতে পাঠিয়েছিলেন কাব্যকে ইঞ্জিনিয়ার হতে। অল্প বয়সে বিদেশে এসে কী আনন্দ ওর! মায়ের বকুনি নেই, বাবার শাসন নেই, যখন-তখন বাসে–ট্রেনে করে কত কত সুন্দর জায়গা দেখতে পেরেছে আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পাশাপাশি বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পড়েছে। কী ভীষণ ভালো লাগছে ওর সবকিছু একসঙ্গে পড়তে! মা–বাবা অনেক সন্দিহান ছিলেন, কাব্য আসলেই এত কিছু একসঙ্গে পড়ছে তো ঠিকমতো? কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনে এসে ডাবল মেজর হচ্ছে দেখে বাবার সেকি আনন্দ! খুশি হয়ে ছোট ভাইবোনদেরও পাঠালেন কাব্যর কাছে। ওরা পড়বে ভাইয়ের ছায়ায় থেকে। তখন থেকে ভীষণ দায়িত্বশীল ও। কিন্তু বোহেমিয়ান মন প্রায়ই ওকে নিয়ে চলে যেতে চায় প্রকৃতির কাছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিস্কো আর স্যানহোসে শহর চষে বেড়িয়েছে ও পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। দুই ভাই–বোনও ওর কাছে থেকেই মাস্টার্স করেছে। দেশে যেত ও প্রতিবছরই। বাবা বলতেন, আমি থাকতে থাকতে ব্যবসা বুঝে নে, বাবা। কাব্য হাসত। বলত, তুমি দেখো না, বাবা। সময় তো শেষ হয়ে যায়নি ব্যবসা দেখার।

কিন্তু এক কাপড়ে বছর কয়েক পরে কাব্যকে ঠিকই ফিরতে হয়েছিল। বাবা চলে গিয়েছিলেন বেহেশতের বাগান আলোকিত করতে। দেশে ফিরে কান্নারত মাকে বুকে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল ও অনেক হয়েছে বিদেশে থাকা। মা আর মাটি ওকে ডাকছে। এ আহ্বান উপেক্ষা করা ওর পক্ষে অসম্ভব।

ব্যবসা তখনো বড় ছিল ওদের, কিন্তু মহিরুহ করে তুলেছে কাব্য একা। কতগুলো বছর কেটেছে তারপর। আজ সব কোম্পানির ম্যানেজারদের ডেকে তাই কাব্য বললেন, মাসখানেকের জন্য সে বাইরে যাচ্ছে, সময়-সময় সবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে। ভাই–বোন এত দিনে আমেরিকায় বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। আপাতত ওর সাহায্য আর কারও লাগবে না।

এবার কাব্য ঠিক করেছে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে ঘুরতে যাবে, মূলত ন্যাশনাল পার্কগুলোয়। দেশ থেকে প্লেন জার্নিটা ভীষণ ক্লান্তিকর, কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে নেমে ওর সব ক্লান্তি কেটে গেল। হাজারটা কাজের বোঝা ওর মাথায় নেই। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ও খোঁজ নিতে শুরু করল কীভাবে কাছের পার্কগুলোয় যাওয়া যায়, শুনল সেকোয়া ন্যাশনাল পার্ক আর কিংস ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের কথা। দুই দিন পর একটা গ্রুপ যাচ্ছে ট্যুর বাসে। কাব্য টিকিট কিনে ফেলল। দিনের বেলায় হলিউডে ট্যুর নিয়ে নিল তারকাদের বাসা ঘুরে। ঠিক করেছে, জেট ল্যাগ গুরুত্ব দেবে না। রাতে ঘুমাল। পরদিন গেল ইউনিভার্সাল স্টুডিও ঘুরতে। মোটামুটি অভ্যস্ত হয়েছে ও দিনে না ঘুমিয়ে থাকতে। রাত আর দিনের তফাত দেশের সঙ্গে তবে অন্যান্যবারের মতো এতটা কষ্ট হচ্ছে না ওর।

পরদিন সকালে হোটেল থেকে চেক আউট করে আর পাঁচ দিন পর ফিরে আসবে বলে হোটেল বুকিং সেরে কাব্য বের হলো। উবার নিয়ে পৌঁছে গেল ট্যুর বাস এরিয়ায়। আরও ২০ জন যাত্রী যাচ্ছে ওর মতো। কাব্যর পাশের সিটটা খালি ছিল, বাস ছাড়ার আগের মুহূর্তে ওর পাশে এসে বসল একটা মেয়ে। স্প্যানিশ হবে হয়তো। ভীষণ চঞ্চল। যাক, ওদের বাস চলতে শুরু করল। পাহাড় আর সমুদ্রের অপূর্ব ক্যালিফোর্নিয়া কাব্যকে সব সময় মুগ্ধ করে। বিশাল বিশাল গাছ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। তার মাঝে স্বপ্নময় রাস্তা। শুধু একটাই ছন্দপতন, পাশে বসা মেয়েটার বারবার ফোন আসছে, রিংগার বন্ধ, কিন্তু বাজনা শব্দটা বিরক্ত করছে কাব্যকে। এমন সময় মেয়েটা ফোন ধরল। বাংলা ভাষায় বলল, আম্মু, আরও ১৯ জন ট্যুরিস্টের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি। কেন চিন্তা করছ? প্লিজ মা, একটু বোঝার চেষ্টা করো, আমার পাশের ইতালিয়ান ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে ফেলছেন যতবার তুমি কল করছ। রিনঝিন নাম দিয়েছ, একটু চঞ্চল তো হবই। মা, পার্কে অনেক জায়গায় ওয়াই–ফাই নেই। ফোনে কানেক্ট করতে না পারলে চিন্তা কোরো না, প্লিজ মা।
কাব্য মনে মনে হাসল। রিনঝিন–টিনঝিন যা–ই হোক, ওকে ইতালিয়ান ভেবেছে। বাংলা কথা বলে ঝামেলা করবে না। দুপুরে লাঞ্চ করা ছাড়া আর কোথাও থামল না ওদের বাস। বিকেলে ওরা পৌঁছাল ক্রিস্টাল কেইভে। কেইভ ট্যুরের টিকিট আগেই সংগ্রহ করেছে ট্যুর কোম্পানি। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে এলিভেটরে নেমে কেইভে নামছে ওরা। রিনঝিনের ভাব দেখে কাব্য বুঝল, মেয়েটা একটু মনে হয়ে আনকম্ফোর্টেবল। যাক, ওর তাতে কী আসে–যায়? আসবে কেন একা একা সে মেয়ে মোমের পুতুল হলে। মায়ের আঁচলের নিচে যাক।

কেইভে নেমে ওরা মুগ্ধ হয়ে গেল। ছাদ থেকে ঝুলে আছে সাদা বা লাইটের রিফ্লেকশনে হলুদ ক্রিস্টাল। হাজার বছর ধরে। গাইড বলে চলেছেন কীভাবে তৈরি হয়েছে ওগুলো। কী কী বিপদ হতে পারে সঠিক পথ চিনে কেইভ থেকে বের না হতে পারলে। ১৫ মিনিটের মাথায় রিনঝিন এসে ফিসফিস করে কাব্যকে ইংরেজিতে বলল, আমার আর ভালো লাগছে না। কাব্য ওকে ইংরেজিতেই জানাল ট্যুরটা এক ঘণ্টার। সুতরাং ধৈর্য ধরে দেখতে হবে। তারপর বিভিন্ন কেইভ হয়ে ওরা অন্ধকার একটা হলে পৌঁছাল। গাইড বলল, একটু পর সব লাইট বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্ধকারে চুপ করে জীবনকে বোঝার একটা মুহূর্ত এটা। রিনঝিন কাব্যর পাশ ঘেঁষে বসল। তারপর বলেই ফেলল, তোমার টি–শার্টের হাতাটা কি আমি একটু ধরে থাকতে পারি? কাব্য ওর দিকে তাকাল, এত মায়া কেন এ চেহারায়? ওর মনে বাজছে গান—
লিটিল কুইনি

আই অ্যাম ইয়োর ফুল কাম অন

টিচ মি রুলস...

অসম্ভব একটা ব্যাপার। হয়তো পরিবেশ ওকে এমন করেছে। কাব্য বলল, সিওর। সব লাইট নিভে গেল। এক মিনিট একটা হাত ওর টি–শার্টের হাতা ছুঁয়ে থাকল। কাব্য খুব রোমান্টিক কেউ নয়। কিন্তু রিনঝিনকে ওর ভালো লাগছে কেন?

ওরা কেইভ থেকে বের হয়ে দেখল, দিনের আলো শেষ হয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। ট্যুর বাস ওদের কিংস ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কে নিয়ে যাবে। রিনঝিন এসে বসেছে কাব্যর পাশে বাসে। অনেকে ক্যাম্পিং করবে লেকের পাশে বনের মাঝে। কাব্য সব সময় ঝকঝকে হোটেলে থাকতে অভ্যস্ত। ও হোটেলে বুকিং করেছে। লক্ষ করল, রিনঝিনও হোটেলে যাবে বলে ঠিক করেছে। বাসে কাব্যর পাশে বসে বকবক করেই যাচ্ছে। বনের মাঝে তাঁবুতে যদি ভালুক আসে? কাব্যর মাথা ব্যথা করছে। খেয়াল করল, ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। এর মাঝে বাসচালক বলে চলল, বাসের গ্যাস নিতে হবে। কারও ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। বনের গভীরে চলল ওরা গাড়ির গ্যাসের খোঁজে। চালক বলে দিলেন, রাত হয়ে যাচ্ছে, যাঁরা ক্যাম্পিং করছেন, তাঁদের সমস্যা নেই, যাঁরা হোটেলে যাবেন, তাঁদের চাবি বাইরে দরজার পাশে দেওয়া থাকবে। কিন্তু খাবারের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। কাব্য বুঝল খিদে লেগে ওর মাথা ব্যথা করছে।

গ্যাসস্টেশনে বাস থামাতেই রিনঝিন নেমে গেল। গহিন বনে ওরা থেমেছে। মেয়েটা গেল কই? ৪০ মিনিট পর বাস ছেড়ে দেবে, রিনঝিনের দেখা নেই। কাব্য যতই চিন্তা করছে, গেল কই বুনো মেয়েটা, ততই অবাক হচ্ছে। একজন পথের সাথি মেয়ে, ওর জন্য এত চিন্তা লাগছে কেন? ওর মনে হচ্ছে, ও নেমে যাবে, রিনঝিনকে খুঁজে নিয়ে আসবে। কাব্য মন স্থির করে ফেলল, ও যাবে। এত অগোছালো সিদ্ধান্ত ও কখনো নেয়নি। উঠে দাঁড়াতেই দেখল লাফিয়ে বাসে উঠেছে রিনঝিন। হাতে ছোট্ট একটা পিৎজার প্যাকেট। বসতে বসতে বলল পিৎজার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু ওরা একটা পিৎজা বেক করে দিল। এত বড় রাত না খেয়ে থাকলে মাথাব্যথায় মারা যাব। কাব্য হাসল। ছোট্ট খাদকটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ওর খুব ইচ্ছে করল। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে পাশে তাকাতেই দেখল রিনঝিন পিৎজা সাধছে, বলছে খান। আপনাকে দেখে সঙ্গে খাবার কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। কাব্য নিল, এতটা ঘোরের মধ্যে খেল। এ মেয়েটা হয়তো ওকে খুব যত্ন করে দেখে রাখবে আজীবন। এ মেয়ের আমান্তে আছে কি না কে জানে।

ক্যাম্প সাইটে বেশির ভাগ লোক নেমে গেল। হোটেলে পৌঁছে কাব্য খেয়াল করল রিনঝিনের চাবিও একই হোটেলের। রিনঝিন ঝলমল করে বলে উঠল আশপাশে কি ঝরনা আছে? কী সুন্দর ঝমঝম পানির শব্দ! কাব্য খেয়াল করল, আসলেই তো। রুমে পৌঁছে কাব্য বুঝল ওয়াই–ফাই নেই। ঝরনার শব্দে ঘুমাল, ঘুমের ঘোরে মনে হলো রিনঝিন একটা শাড়ি পরে ওকে ডেকে তুলছে। ওঠো, আমান্তে (প্রিয়তম)। কাব্য ঘুম থেকে উঠল, এমন স্বপ্ন ও কখনো দেখেনি। রেডি হয়ে বাইরে বের হতেই দেখল খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। নদীর পাশে পাথর নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাথর ছুড়ছে রিনঝিন। এতটা সময় একসঙ্গে থাকার পরও রিনঝিন ওর নাম জানে না। ওকে দেখে বলে উঠল, হেই ইতালিয়ান ফেলো, রাতে ঘুম হয়েছে তোমার?

কাব্য হাসল, বলল হুম্‌। নদীর পাড়ে বসে রিনঝিনকে জিজ্ঞেস করল, মাকে জানিয়েছ তুমি ভালো আছ? সে বলল, অবশ্যই। তারপর বলল, মা সব সময় বলে, একজন আমান্তে আমার কেন নেই। কাব্য চমকে তাকাল। স্প্যানিশ ভালোবাসার এ নামেই স্বপ্নে ওকে ডেকে তুলেছে এ মেয়ে। রিনঝিন বলে চলেছে, আমি বিয়ে করব আমার বাংলাদেশের কাউকে, যার সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলব। বলব ভালোবাসি। বুঝেছ, ইতালিয়ান ফেলো?

এরপর নাশতা খাওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল ওকগাছের বনে ঘুরে বেড়ানো, হাইকিং—সবকিছু কাব্য ভালোবাসার কী এক ঘোর নিয়ে করল। এ চোরাবালি থেকে ওর আর উদ্ধার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাঁচটা দিন কেমন করে কেটে গেল কাব্য জানেন না। ফেরার পথের তিন ঘণ্টা চিন্তা করল অনেক কিছু কাব্য। তারপর বাংলায় রিনঝিনকে বলল, খুব সিনেমাটিক শোনালেও আমার কিছু করার নেই, রিনঝিন। আমি তোমার আমান্তে হতে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাংলাদেশি একজন মানুষ আমি। আজ পয়লা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আমার হাতটা তুমি সারা জীবনের জন্য ধরে রাখো। রিনঝিন চুপ করে গেল। একটা কথাও বলল না সারা পথ।

বাসস্ট্যান্ডে নেমে চলে যাচ্ছে কাব্য, কেউ একজন এসে ওর হাতটা ধরল। বলল, আমান্তে, আমার উত্তরটা শুনে যাও। ভালোবাসি, জান। তোমাকে অনেক ভালোবাসি।