কোথায় আছে কেমন আছে মা
হ্যালো! হ্যালো!
কী খেলে আজ?
ছোট মাছের চচ্চড়ি।
কি মজা করে খেলাম…কত দিন পর।
আজ শরীরটা ভালো লাগছে মা? হঠাৎ একটু নীরবতা।
ওপাশে আবার মায়ের হাসি হাসি গলা,
হ্যাঁ, কি ভীষণ ভালো লাগছে। পেট ভরে খেলাম কত দিন পর! এত চিন্তা করিস না তো, ভালো আছি।
অনেক কষ্টে থেকেও কি ভীষণ পজিটিভ কণ্ঠস্বর।
আমার দুশ্চিন্তার চোরকাঁটা তবু খুঁচিয়ে ওঠে বুকের মধ্যে।
‘দেখি টিকিট কেটে দেশে আসতে পারি কি না’
‘নারে, আসিস না বারবার।’ মা আমার সজোরে বলে ওঠে, ‘এই না সেদিন এলি। নতুন চাকরি, বিদেশবিভুঁই, বারবার ছুটি নিস না। টাকাগুলো নষ্ট করিস না।’ একটা লুকোনো দীর্ঘশ্বাস চেপে নিই বুকের গোপন প্রকোষ্ঠে। মধ্যবিত্ত সেই জীবন। মরণের আগপর্যন্ত শুধুই বেতন আর চাকরি।
মনে পড়ে যায় স্কুলজীবনের কত স্মৃতি। এই যে আমার মা, আজ কত অসুস্থ। বিছানায় পরে আছে। অথচ একটা সময় তাকে রাতের আগে কখনো ঘুমাতে দেখিনি। সকাল ছয়টায় উঠে হাতে-গড়া রুটি, আলুভাজা, ডিমভাজা বানাত। আমরা সবাই উঠে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার আগেই মায়ের নাশতা রেডি। কোনো দিন টের পাইনি। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম রোগা। সারা বছর টনসিল, জ্বর। খেতাম অ্যান্টিবায়োটিক। খাবারের রুচি হতো না। আম্মা যেন আমাকে তুলায় মোড়া পুতুলের মতো বড় করেছে। একটু ঠান্ডা পড়লেই গলাব্যথা হতো। তাই বুনে দিয়েছিলেন একটা গোলাপি মাফলার। গলায় পেঁচিয়ে রাখতাম। কিচ্ছু খেতে ভালো লাগত না, তাই বানাতেন নিত্যনতুন খাবার। সারা বছর তেমন পড়াশোনা করতে পারতাম না, তাই যখন সুস্থ থাকতাম ধুমায়ে পড়তাম। আম্মা খুব বলত, ‘চিন্তা করিস না, দেখিস পারবি।’ কথাটা যেন ম্যাজিকের মতো আমাকে শক্তি দিত। এত অসুস্থতা সত্ত্বেও স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যত অর্জন, সবকিছুর পেছনে আসলে আমার মায়ের সেই একটি ম্যাজিক ওয়ার্ড। মধ্যবিত্ত সংসার। তাই ঈদের সময় সারা দিন আম্মার সেলাই মেশিন চলত। দোকান থেকে বা দরজিকে দিয়ে জামা বানানোর সামর্থ্য আমাদের ছিল না। সৎ শিক্ষকের সংসারে সততার মূল্য দিতে আমার মায়ের যে কি কষ্ট হতো, এখন বুঝতে পারি।
কিন্তু এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। ভাবিনি আমার ম্যাজিক ওয়ার্ড হারিয়ে যাবে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে কিছু দেওয়ার আগেই! সেদিন দুটি বেশি কথা বলার আগেই কেটে যায় ফোন। সবকিছু জানার আগে ক্যানসারের কালো নিকষ ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে গেল আমার মা! যদি জানতাম এটাই শেষ ফোনকল, তাহলে তো লাইনটা কাটতেই দিতাম না।
জানো মা, এখনকার সময় হলে প্রতিদিন ভিডিওতে দেখতাম তোমায়। কল করতাম ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে। লাইন কাটার ঝামেলাই নেই। এক লাইন কেটে গেলে আরেক লাইনে ঠিকই পেয়ে যেতাম। কল করতাম আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েডে। কত শত স্মার্টফোন এসে গেল! দেশে এখন কত সহজেই ভিডিও কল চলে যায়! তবু তোমার কাছে ফোনকলটা পৌঁছানোর উপায় হলো না আজও। কত কথা জমে হিমবাহ হয়ে আছে, বলা হলো না তোমাকে আর। কত বছর চলে গেল, বেদনার ক্ষতটুকু রয়ে গেল এখনো তেমনই সজীব! শেষ ফোনকলটা কেন শেষ হয়ে গেল সবকিছু বলার আগেই? আমার অব্যক্ত কথামালা নিয়ে বসে আছি, শুধু ফোনকলটা পৌঁছানোর অপেক্ষায়। ফোনটা না পৌঁছাক, তবু যেন আমার দোয়াটুকু পৌঁছে যায় তোমার কাছে, আর কিছু পৌঁছানোর সামর্থ্য আর নেই যে মা!
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]