হিমু ও হিরো আলম

হিরো আলম।
ছবি:সংগৃহীত

অন্যকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিস্থাপন করে সুখানুভূতির ক্ষমতাবল শুধু মানুষেরই আছে। জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে, আমরা যা না তা কল্পনা করে সুখানুভূতি নিই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে হ‌ুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সবাই হিমু হতে চায়। আমি নিজেও।

হিমুর অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণ হলো প্রত্যেক পাঠকই হিমুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সুখানুভূতি পায়। হিমুর লাইফস্টাইল ঈর্ষান্বিত। কাজকাম নেই অথচ দিব্যি জীবন চলে যায়। শুধু তা–ই নয়, তার আবার শিষ্যও আছে। কারণ, সে মহাপুরুষ। অথচ বাস্তব পৃথিবীর প্রায় সব মহাপুরুষের জীবনই ভয়াবহ ও সীমাহীন কষ্টের। যেকোনো ধর্মের মহাপুরুষদের জীবন ছিল চরম চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতায় ভরপুর।

অথচ বাস্তবতার নিরিখে পৃথিবীতে হিমু একটা ‘ভাদাইমা’, অলস ও কল্পনাপ্রসূত যুবক। সে নিজের, পরিবার–এলাকা–সমাজের বা রাষ্ট্রের কোনো ধরনের দায়িত্ব নেয় না বা নিতে চায় না। অথচ তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ধরনের জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায় সহজেই। তার কল্পনা ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও প্রখর। সেই ক্ষমতা দিয়েও সে অনেক ভবিষ্যৎ বাণী করে। যেকোনো ধরনের বিপদ–আপদে ছাড় পেয়ে যায় সহজেই। হোক তা পুলিশ বা ছিনতাইকারী।

তার বিপদ–আপদে উদ্ধারকারী দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে আসে। অর্থ বা ক্ষমতা দেখিয়ে তাকে বিপদ থেকে নিমেষেই উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কদাচিৎ মন ও দেহের ওপর কিছুটা পুলিশি অত্যাচার পরিলক্ষিত হলেও বেশির ভাগ সময়ই সে জানে বেঁচে যায়। তার পরিবারকে কখনো হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয় না।

তার প্রেমিকাও অনেক ধনী পরিবারের। সে নিজে থেকে প্রেম খুঁজে বেড়ায় না। প্রেম তাকে খুঁজে বের করে। চাহিবামাত্র প্রেমিকা এসে ধরা দেয়। কী চমৎকার এক জীবন! কে না চায় এ জীবনের অংশীদার হতে।

‘হিমু’ চরিত্র ও নাসির আলী মামুনের তোলা হুমায়ূন আহমেদের (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি অবলম্বনে অলংকরণ: আরাফাত করিম

কিন্তু বাস্তবের পৃথিবীতে হিমুর পরিবর্তে আমরা দেখি হিরো আলমের মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষ। কেউ ডিশ ব্যবসা, কেউ সবজি বিক্রি, কেউ খাবার ডেলিভারি, কেউ বাসের হেলপার কিংবা কেউ অন্য পেশায় দিনরাত কাজ করে। হিমুর মতো হাজারো যুবককে প্রতিনিয়ত রিকশার গ্যারেজ, লঞ্চ টার্মিনাল বা রেল-বাস স্টেশনে শুয়ে-বসে দিন কাটাতে দেখা যায়।

বাস্তবের হিমুরা কখনো ট্রাকের হেলপার, কখনো পাসপোর্ট অফিসের দালাল, কখনো সে মাছ বিক্রেতা। যখন সে রিকশা চালায়, তখন প্রতি রাতে মহাজনের গ্যারেজে রিকশা জমা রেখে বস্তিতে যায় ঘুমাতে। রিকশা ভাড়া নিয়ে গন্ডগোল করলে প্রায়ই সে গল্পের হিমুর সুন্দরী প্রেমিকা রুপার মতো মানুষের হাতে চড় খায়। ভরা পূর্ণিমায় রাস্তায় হাঁটতে থাকলে পুলিশ তাকে ধরে প্রথমেই লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত করে। তারপর থানায় নিয়ে যায়। পরের দিন সোজা কোর্টে চালান। বাস্তবের হিমুকে ছাড়াতে কেউ ফোন করে না কিংবা উকিল নিয়ে থানায় হাজির হয় না। বাস্তবের হিমুর খালা-খালু, হবু শ্বশুর, প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই।

কালজয়ী হিন্দি সিনেমা ‘সোলে’তে গাব্বার সিংয়ের নাম কে না শুনেছে। দুর্ধর্ষ ডাকাতের ভূমিকায় আমজাদ খান দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সে অট্টহাসি দিলে পাহাড় পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। শান্ত নদীর জলেও ঢেউ ওঠে। পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার ৪০ বছর পরও সিনেমা হলগুলোতে সিট নেই বা হাউসফুল হয়ে দাপিয়ে বেড়াত বা এখনো হয়তো ভারতের কোথাও কোথাও তা–ই হচ্ছে।

কোনো সিনেমা বা গল্পের চরিত্রে অনেক ভালো ডাকাত বা ভালো খুনিকেও মানুষ নিজের চরিত্রে কল্পনা করে। তাই বলে ভালো ডাকাত বলতে অবশ্যই গাব্বার সিং নয়। সে আসলেই কুখ্যাত ও ভয়ংকর। ভালো বলতে যে ডাকাত মানুষের বাড়িতে ডাকাতি করে গরিবের মধ্যে সেই সম্পদ বিলিয়ে দেয়। ভালো খুনি বলতে যে খুনি তার ছোটবেলায় খুন হওয়া বন্ধুর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে অনুরূপভাবে খুন করে। কোনো রাষ্ট্র যখন নাগরিক অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্রের নাগরিকেরা অন্য পথ খুঁজতে সচেষ্ট থাকে। এ ক্ষেত্রে মানুষ রাষ্ট্রীয় বা আইনের শাসনের তোয়াক্কা করে না। আর এভাবেই একজন ডাকাত ও খুনি মানুষের দুর্বল মনে স্থান করে নেয়। দর্শক সেই ‘ভালো’ ডাকাত বা ‘খুনি’র স্থানে নিজেকে কল্পনা করে।

হিরো আলম ডাকাত বা খুনি কিছুই নন। তিনি স্রেফ গ্রামে বেড়ে ওঠা কষ্টসহিষ্ণু একজন বাস্তবের হিমু। গল্পের হিমুর মতো তিনিও কল্পনাবিলাসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এগুলো হতে কাউকে ধনী পরিবার থেকে আসা, গায়ের রং ফরসা হওয়া বা স্কুল-কলেজের শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। মানুষ তার স্বপ্ন বা জীবনের চেয়েও বড় কিছু হতে পারে এবং হয়ও।

হিরো আলমের পেশা মানুষকে বিনোদন দিয়ে অর্থ উপার্জন করা। সেই বিনোদনে আমি–আপনি বিনোদিত হই বা না হই, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিনোদন করা ও বিনোদিত হওয়ার অধিকার নিয়ে। একজন নাগরিক হিসেবে সবার অধিকার আছে বিনোদন দেওয়ার এবং বিনোদিত হওয়ার যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের চোখে সেগুলো গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। হিরো আলমের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবেই আইনের নামে বেআইনি নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। তাঁকে তলব করা হয়েছিল তাঁর কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে। লিখিত কাগজে তাঁকে মুচলেকা দিতে হয়েছে। সেই কাগজে কী কী লেখা ছিল, সেটা জানার অধিকার দেশের সাংবাদিকেদের রয়েছে। সাংবাদিকদেরও উচিত, সেটা নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়া, যাতে তারা আইনের সেই উচিত-অনুচিত অংশগুলো সম্বন্ধে অবগত হতে পারে। আবার সেই উচিত-অনুচিত অংশগুলো কি শুধু হিরো আলমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ও বিবেচনায় আনা উচিত।

আমেরিকার বিখ্যাত র‍্যাপার, অভিনেতা ও প্রডিউসারের নাম ফিফটি সেন্ট। তিনি যদি বাংলাদেশে জন্মিয়ে হিরো আলমের মতো বিখ্যাত হতেন, তাহলে হয়তো তাঁর নাম হতো ‘পঞ্চাশ পয়সা’। কেউ যদি চান, লোকজন তাঁকে চিনুক বা জানুক ‘পঞ্চাশ পয়সা’ নামে, তাহলে সেটা কি তাঁর নাগরিক অধিকার নয়, নাকি রাষ্ট্র এসে তার নাম নির্ধারণ করে দেবে কী নামে ডাকা উচিত বা অনুচিত?