প্যারিসের ল্যুভর আলোয় আমার জন্মদিন

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ভোরবেলা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশটায় ছিল হালকা কুয়াশা আর মৃদু আলো। বুকের ভেতর তখন এক অদ্ভুত টান, একদিকে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে জার্মানিতে প্রিয় মেয়ে ও আড়াই মাসের নাতনি রূপকথাকে দেখার অশেষ আনন্দ।

স্টুটগার্টে মেয়ে ও জামাতা আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল ১২ তারিখ বিশ্বের তৃতীয় দ্রুতগামী বুলেট ট্রেনে প্যারিস ভ্রমণ, এক মাস আগেই প্যারিসের ব্যস্ততম পর্যটন এলাকায় ৭ দিনের জন্য বেলেভিলে (Belleville) এলাকায় এয়ার বিএনবির একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিল। আইফেল টাওয়ার, জাহাজে সেইন নদী ক্রুজ, ভার্সাই মিউজিয়াম, ল্যুভর মিউজিয়াম এসব দর্শনীয় স্থানের টিকিট অনেক আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিল। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওরা আমার সহধর্মিণীর জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছিল সুইজারল্যান্ডের রাইন ফলসে। ওদের বায়না ‘তোমার জন্মবার্ষিকী এবার একটু অন্যভাবে কাটাব, বাবা। এবার চলো প্যারিস যাই!’ তাই ১২ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে আমরা ৪ জনে তিন মাসের ছোট্ট নাতনি রূপকথাকে নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় গতিসম্পন্ন বুলেট ট্রেনে রওনা হলাম প্যারিসের উদ্দেশে।

স্টুটগার্ট থেকে প্যারিসে পৌঁছানো—

জার্মানির স্টুটগার্ট শহর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে প্যারিস শহর। ট্রেন ছুটে চলার সেই সময় যেন এক চলমান চিত্রকর্ম। সূর্য ডোবার পূর্বে জানালার বাইরে রঙের বিস্তৃতি—আঙ্গুরলতা, সোনালি মাঠ, প্রাচীন গ্রাম, গির্জার ঘণ্টা দাগ কেটে আছে। মাত্র ৩টা ১৩ মিনিটে আমরা স্বপ্নের নগরীতে রাতের আলোয় যখন প্যারিসে পৌঁছালাম, শহরটা যেন মনে হচ্ছিল আলোয় গড়া। মনে হচ্ছিল, এই শহর যেন নিজেই এক শিল্পকর্ম।

আমরা ১৩ অক্টোবর আইফেল টাওয়ার, নটডেম ক্যাথেড্রাল এবং রাত ৯টা পর্যন্ত সেইন নদী ক্রুজ, রাতের আইফেল টাওয়ারের আলোঝলসানো উপভোগ করলাম। ১৪ অক্টোবর প্যারিস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ৮০০ হেক্টর (২ হাজার একর) ১৬২৩ সালে রাজা লুই চতুর্দশ তাঁর ব্যবহারের জন্য ২ হাজার ৩০০টির বেশি কক্ষ, হলঘর চিত্রকর্ম ও বিশাল এলাকাজুড়ে বাগান—এই ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ ভার্সাই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। সারা দিনেও আমরা প্রাসাদের সবকিছু দেখতে পারিনি।

প্যারিসের ল্যুভর সকাল: জন্মবার্ষিকীর দিনটি—

২০২৫ সালের ১৫ অক্টোবর সকাল ১০টার মধ্যেই আমরা বিশ্বের সর্ব্ববৃহৎ চিত্রশালা ল্যুভর প্রাসাদে পৌঁছালাম। ১৭৯৩ সালের ১০ আগস্ট ৫৩৭টি শিল্পকর্মের প্রদ্ররশনীর মাধ্যমে ল্যুভর জাদুঘরটির উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি শিল্পকর্ম রয়েছে এই জাদুঘরে। আমার জীবনের বিশেষ একটি দিন আজ ১৫ অক্টোবর। সর্বকনিষ্ঠ পর্যটক নাতনি রূপকথাকে স্ট্রলারে নিয়ে, সবাই মিলে স্বপ্নের ল্যুভর জাদুঘরের বিভিন্ন ইতিহাস, শিল্প আর বিস্ময়ের এক মিলনক্ষেত্র দেখছিলাম। জাদুঘরের ভেতরে ঢুকতেই এক গভীর নীরবতা। বিভিন্ন দেয়ালে রঙের স্তরে স্তরে শত শত বছরের ইতিহাস, চোখে যেন এক অজানা বিস্ময়।

এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মোনালিসার চোখের সামনে—

যখন ল্যুভরের ‘Salle des tats’ নামের ঘরে প্রবেশ করি, তখনই বোঝা গিয়েছিল, আমি এক বিশেষ জায়গায় এসেছি। আলো একটু মৃদু, আর সামনে অনেক মানুষ—সবার চোখ এক জায়গায়: ছোট্ট এক ছবির দিকে। বেশির ভাগ মানুষই প্রথমে অবাক হয় ছবির আকার দেখে—ভাবনার চেয়ে অনেক ছোট (প্রায় ৭৭ দশমিক ৫৩ সেন্টিমিটার)। দূর থেকে কাচের ভেতর রাখা, সুরক্ষিত কক্ষের কেন্দ্রে, যেন এক রাজকন্যা পাহারায় আছে।

দীর্ঘ সারি পেরিয়ে যখন পৌঁছালাম বিশ্ববিখ্যাত লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা চিত্রের সামনে, মনে হলো আমি সময়ের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। ছবিটা ছোট, কিন্তু তার প্রভাব অগাধ—যেন সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আবার নয়ও। আমার স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওর চোখে কী রহস্যই না আছে?’ আমি নীরবে তাকিয়ে রইলাম, সত্যিই, সে যেন জানে এমন কিছু, যা কেউ জানে না। মোনালিসার সেই রহস্যময় দৃষ্টি আমাকে মনে করিয়ে দিল, শিল্প আসলে এক নীরব চিরকাল।

রাজমুকুটের ঘরে–গ্যালেরি দ’আপোলন

এরপর আমরা পৌঁছালাম এক রাজকীয় গ্যালেরি দ’আপোলন প্রদর্শনী কক্ষে। সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড়, আলো আর ছায়ার মধ্যে ঝলমল করছে এক ফরাসি রাজমুকুট। রুবি, নীলা, সোনার কাজ—যেন আলো নিজের রূপ ভুলে গেছে তার কাছে। আমি মোবাইল হাতে নিলাম, সময় তখন বেলা ১টা ৯ মিনিট। ক্লিক—এক, দুই, তিন গ্যালারি—অনেকগুলো ছবি তুললাম। তখন কে জানত, এই ছবিগুলোই একদিন ইতিহাসের শেষ আলো হয়ে থাকবে? ফ্রান্সের প্যারিসে ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রথম তলায়, সাইন নদীর দিকে মুখ করে এই গ্যালারি অবস্থিত। এটি ল্যুভরের সবচেয়ে গৌরবময় কক্ষগুলোর অন্যতম। প্রারম্ভ (সতেরো শতাব্দী) ১৬৬১ সালে ফরাসি রাজা লুই চতুর্দশ রাজপ্রাসাদের অংশ হিসেবে এটি নির্মাণের নির্দেশ দেন। স্থপতি ছিলেন লুই লে ভো এবং চিত্রশিল্পী চার্লস লে ব্রঁ পুরো ছাদের পৌরাণিক থিম ডিজাইন করেন। গ্যালারিটির নাম রাখা হয় সূর্যের দেবতা ‘আপোলন’-এর নামে। কারণ, লুই চতুর্দশ নিজেকে ‘সূর্যরাজা’ হিসেবে দেখতেন। আজ এটি ল্যুভরের সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক কক্ষগুলোর একটি, যেখানে শিল্প, পুরাণ ও রাজকীয় ঐশ্বর্যের মেলবন্ধন ঘটে।

২০২৫ সালের ১৯ অক্টোবরে ল্যুভরের ‘আপোলন’–এর অংশ থেকে একটি দুঃসাহসিক রত্ন চুরি সংঘটিত হয়েছে। এই গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছিল গ্রিকদেবতা ‘আপোলন’-এর নামে—যিনি সূর্য, সংগীত, শিল্প ও আলোর দেবতা। পুরো গ্যালারির ছাদে আপোলনের জীবন ও ক্ষমতা নিয়ে পৌরাণিক দৃশ্যাবলি অঙ্কিত আছে। যেমন সূর্যের আলো, শিল্প ও সভ্যতার প্রতীক হিসেবে তাঁর ভূমিকা। চমৎকার সোনালি ছাদ, জটিল অলংকরণ ও রঙিন পেইন্টিং—একে প্রায়ই বলা হয় ‘ল্যুভরের সবচেয়ে রাজকীয় গ্যালারি।’

এই দুর্ধর্ষ চুরি সংঘটিত হয় ২০২৫ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে। চুরির সময় প্ল্যান ছিল খুবই দ্রুত। মাত্র কয়েক মিনিটে অভিযুক্তরা কার্য করেছিল। চুরি গেছে ৮টি রত্ন। একটি রত্ন পাওয়া গেছে (ভাঙা অবস্থায়) মূল রত্নসংগ্রহ থেকে বহুদূরে যাওয়া হতে পারে। চুরি যাওয়া রত্নের আনুমানিক মূল্য (বাজারমূল্যে নয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যে) প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ইউরো (১০২ মিলিয়ন ডলার) বলা হচ্ছে।

চোরেরা ক্রেন লিফট/ মোবাইল ল্যাডার ব্যবহার করে গ্যালারির এক জানালা দিয়ে প্রবেশ করে এবং পেরেছে দ্রুত র‍্যাপিড অ্যাকশন করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। (Reuters <https://www.reuters.com/graphics/FRANCE-CRIME/LOUVRE/byprezooove/?utm_source=chatgpt.com>)

ল্যুভর থেকে মুকুট নিখোঁজ: আলোর ফাঁদে বন্দী শেষ প্রতিচ্ছবি

১৭ অক্টোবর রাতে আমরা ট্রেনে ফিরে এলাম স্টুটগার্টে। মনে হচ্ছিল, প্যারিস তখনো আমার ভেতরে রয়ে গেছে—আলো, মোনালিসা আর সেই রাজমুকুটের ঝলক। জন্মদিনের সপ্তাহ শেষ হলো, কিন্তু এক অদ্ভুত অনুভূতি রয়ে গেল—যেন ইতিহাসের এক নিঃশব্দ স্পর্শ আমাকে ছুঁয়ে গেছে।

১৯ অক্টোবর হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় চোখ আটকে গেল, ‘ল্যুভর থেকে নেপোলিয়নের রাজমুকুট চুরি!’ মাথা ঘুরে গেল। ছবিতে দেখানো সেই ঘর, সেই কাচের বাক্স, কিন্তু মুকুট নেই। রাজকীয় ঐতিহ্যের প্রতীক, শতাব্দীপ্রাচীন একটি রাজমুকুট দিনের আলোতে চুরি হয়েছে। ঘটনাটি শুধু শিল্পজগৎ নয়, গোটা ইউরোপের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হাতের ভেতর যেন শূন্যতা জমে উঠল। আমি আমার ফোন খুলে দেখলাম, সেই ছবিগুলো এখন যেন নিঃশব্দে আমাকে তাকিয়ে দেখছে। আমি জানি না, এটা কাকতালীয় নাকি নিয়তি, কিন্তু আমার ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল মুকুটের শেষ প্রতিচ্ছবি।

আমার চোখে ইতিহাসের শেষ আলো

জীবনে অনেক ছবি তুলেছি, অনেক দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু সেই দিনের মতো মুহূর্ত আর কখনো পাইনি। কখনো কখনো এক ক্লিকই সময়কে থামিয়ে দেয়। আর আমি জানি, ১৫ অক্টোবর বেলা ১টা ৯ মিনিটে, আমি সময়কে থামিয়ে দিয়েছিলাম। ১৫ অক্টোবরের সেই দুপুর ছিল সাধারণ এক দিন; কিন্তু ইতিহাসে আজ তা হয়ে উঠেছে অসাধারণ। আমার স্যামসাং মোবাইল ক্যামেরা হয়তো অজান্তেই সংরক্ষণ করেছে এমন এক রাজকীয় উত্তরাধিকার, যা আজ হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। ল্যুভর দেয়ালে এখন নিস্তব্ধতা, কিন্তু আমার ছবিগুলোতে জড়িয়ে রয়েছে সেই মুকুটের দীপ্তি, যেন সময়ের শেষ আলোয় ধরা পড়া এক বিস্মৃত স্মৃতি।

শেষ মন্তব্য: চুরির ঘটনা এখন তদন্তাধীন। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত, যা হারিয়ে গেছে, তা হয়তো ফিরে আসবে না। তবে আমার মোবাইলে বন্দী সেই আলোর মুকুটটি আজও জীবিত— ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে।